বর্ধমান , 26 জুন : শিথিল হয়েছে লকডাউন । স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সমস্ত পরিষেবা । 8 জুন থেকে বড় বড় রেস্তরাঁ-র পাশাপাশি খুলে গেছে রাস্তার ছোটো ছোটো খাবারের দোকানগুলি । পূর্ব বর্ধমান জেলাতেও চায়ের দোকান থেকে শুরু করে ছোটো ছোটো খাবারের দোকানগুলি খুলে গেছে । কিন্তু প্রশ্ন একটাই । পরিষেবা স্বাভাবিক হলেও ব্যবসা কি আগের মতো হচ্ছে ? ছোটো ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন , ব্যবসা আগের থেকে কমে গেছে । সংক্রমণের ভয়ে খদ্দের আসা কমে গেছে । ফলে খাবার ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা ।
জেলার বর্ধমান , কালনা , কাটোয়া , মেমারি , জামালপুর , রায়না , খণ্ডঘোষ , পূর্বস্থলী প্রভৃতি জেলায় এরকম কয়েক হাজার খাবারের দোকান রয়েছে । তার মধ্যে কোথাও চায়ের দোকান কোথাও ছোটো ছোটো খাবারের দোকান , কোথাও বা মিষ্টির দোকান । লকডাউনের আগে এই দোকানগুলিতে সবসময় ভিড় থাকত । প্রাতঃভ্রমণ সেরে কেউ হয়ত ফেরার সময় বাড়ি নিয়ে যেতেন গরম গরম কচুরি , মিষ্টি । কেউ বা চায়ের গ্লাসে চুমুকে আড্ডার ঝড় তুলতেন । এছাড়া অফিস যাত্রীদের ভিড় তো লেগেই থাকত । কিন্তু এখন কোথায় সেই আড্ডা । পরিস্থিতি মাঝেমধ্যে এমন অবস্থায় গিয়ে পৌঁছাত যে দোকানদারেরা বোর্ড ঝুলিয়ে রাখতেন যাতে চায়ের বা খাবারের দোকানে অন্য কোনও আলোচনা না হয় । বেশিরভাগ দোকানেই দেখা গেছে একজন কিংবা দু'জন মিলে দোকান সামলাচ্ছেন । কিন্তু ক্রেতার ভিড় এত হত যে তা সামলাতে হিমশিম খেতে হত দোকানদারদের । লকডাউনের জেরে সেই ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে । মানুষ বাড়ি থেকেই বেরোতে ভয় পাচ্ছেন । খাবার খাওয়া তো দূরের কথা । ফলে চায়ের দোকানগুলিতে আর সেই ভিড় নেই । কচুরি , পরোটা , ঘুগনি-মুড়ির দোকানগুলিতে মাছি তাড়ানোর মতো অবস্থা । খাবার রীতিমতো নষ্ট হচ্ছে । ফেলে দিতে হচ্ছে । ব্যবসায়ীদের কথায় , দুই মাস পরে দোকান খোলা হলেও ব্যবসায় লাভ তো হচ্ছেই না, উলটে লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে । ফলে কীভাবে সংসার চলবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা ।
দোকানদাররা বলছেন , কোরোনা সংক্রমণের ভয়ে বেশিরভাগ মানুষজন বাইরের খাবার কিনে খেতে চাইছেন না । তবে যাঁরা খেতে আসছেন , তাঁদের আবার আর্থিক সামর্থ্য কম । সেই কারণে তাঁরা বেশি খাবারও কিনছেন না । অথচ মহাজনের কাছ থেকে জিনিস কেনার জন্য সেই টাকা মিটিয়ে দিতে হয় । কিন্তু ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে ।
বর্ধমানের কোর্ট চত্বরে এলাকায় বহুদিনের চা ও খাবারের দোকান দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের । কিন্তু লোকজন সেভাবে বেরোচ্ছেন না । তাই আগের মতো বিক্রি হচ্ছে না । তিনি বলেন , "ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ । লকডাউনের পর দোকান খোলা হলেও বিক্রি হচ্ছে না । বাড়ি থেক লোকজন বেরোচ্ছেন না । বাস কম চলছে । কোর্ট চত্বরে ভিড় কম । যার জন্য যা তৈরি করছি তার বেশিরভাগটাই ফেলে দিতে হচ্ছে । আগে 1000-1500 টাকা বিক্রি হলেও এখন হচ্ছে 400 টাকা মতো । " পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করে খাবার দেওয়া হলেও মানুষ আসছেন না বলে জানাচ্ছেন তিনি । তাঁর কথায়, "খাবার দেওয়ার সময় থালা বাসন সব স্যানিটাইজ় করছি । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে খাবার দিচ্ছি । কিন্তু কোরোনা সংক্রমণের ভয়ে কেউ কিছু খেতে চাইছেন না । "
প্রদীপ ঘোষ একজন মিষ্টি ব্যবসায়ী । তিনি বলেন , "আগের মতো বাজার নেই । এখন কেউ বাইরের খাবার খেতে চাইছেন না । মাস্ক খুলে কেউ খেতে চাইছেন না । অনেক কচুরি , জিলিপি , মিষ্টি ফেলা যাচ্ছে । খুব সমস্যা হচ্ছে । "
বর্ধমানে দীর্ঘদিন ধরে ঘুঘনি , মুড়ি, ঝালমুড়ি, চপ , মিষ্টি বিক্রি করেন রাজকুমার নাগ । তিনি বলেন , " আগে এক হাতে ভিড় সামলাতে পারতাম না । আজ এমনই অবস্থা কোনও খদ্দের নেই । ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ । " তেমনি চা বিক্রেতা হারাধন কুণ্ড । শুধুমাত্র চা , কেক , বিস্কুট বিক্রি করেন তিনি । আগে তাঁর চা বিক্রি হত 800-1000 টাকার মতো । এখন তারও অর্ধেক হচ্ছে কি না সন্দেহ । তাঁর কথায় , "মানুষ বাইরে বেরিয়ে ভয়ে চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে । ব্যবসা খারাপ হওয়ায় কীভাবে সংসার চালাব ভেবে উঠতে পারছি না । দোকান খুলতে হয় খুলছি । বাড়িতে বসে থেকে কী আর করব !"
প্রাতঃভ্রমণ সেরে বেশিরভাগদিন চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শিশিরকুমার দত্ত । ভোরের অন্ধকার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়তেন মর্নিংওয়াকে । সকালে বাড়ি ফেরার পথে মাঝেমধ্যে চায়ের দোকানে গিয়ে চায়ে চুমুক দিতেন । তাঁর সঙ্গী সাথীরা কেউ কেউ আবার কচুরি কিংবা দু-একটা মিষ্টিও মুখে পুরে দিতেন । বাড়িতে মিষ্টি খাওয়া নিয়ে আছে কড়াকড়ি । তাই সুযোগ পেলেই মিষ্টি খেতেন তিনি । কিন্তু এখন তাও বন্ধ । তিনি জানাচ্ছেন সংক্রমণের ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না । খাওয়া তো দূরের কথা ।
খাবার বেচেই সংসার চালান এই ছোটো ছোটো ব্যবসায়ীরা । দিন আনা দিন খাওয়ার মতো । কিন্তু লকডাউন ও কোরোনার প্রভাবে এখন তা বন্ধ হওয়ার মুখে । বিক্রি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে । ফলে লাভের থেকে লোকসান বেশি হচ্ছে । পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে , কবে দোকানে আবার ব্যস্ততা ফিরে আসবে , সেই আশায় রয়েছেন এইসব খাবার বিক্রেতারা । রোজগারের জায়গা তাঁদের হয় এইসব দোকান থেকেই ।