কালনা (পূর্ব বর্ধমান), 9 মে: পেশায় তাঁরা শিক্ষিকা ৷ তবে আর পাঁচজনের মতো তাঁদের শিক্ষাদান কেবল স্কুলের গণ্ডিতেই থেমে থাকেনি ৷ এবার তাঁরা সচেতনতার বার্তা দিতে দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন ৷ সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রচেষ্টায় তিন শিক্ষিকা কন্যাসন্তান রক্ষার বার্তা দিতে ঘুরবেন কলকাতা থেকে লাদাখ হয়ে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ৷
তিন শিক্ষিকার বয়স 40 থেকে 65-এর মধ্যে ৷ এই বয়সে সকলে যখন তীর্থযাত্রার কথা ভাবেন, তখন এই তিন শিক্ষিকা দেশ ঘুরে উন্নত ভারত গড়ার লক্ষ্যে কন্যাসন্তান রক্ষার বার্তা দিচ্ছেন ৷ অনেকটা হয়ত এটাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন,'আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ৷'
7 মে রবিবার নিজের গ্রাম থেকে এই যাত্রা শুরু করেছেন কালনার বাঘনাপাড়া সিকেডি গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা সুতপা দাস ৷ তিনিই এই যাত্রার মূল উদ্যোক্তা ৷ সাহসিকতার এই কাজে তাঁর হাত ধরেছেন একদা তাঁরই দুই প্রবীণ সহকর্মী ৷ হরিণঘাটা নদিয়ার বাসিন্দা তথা শিক্ষিকা তপতী দেবনাথ ও উত্তর 24 পরগনার উত্তর দমদমের বাসিন্দা তথা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা ঝর্ণা মালাকার ৷
পেশায় যেহেতু তাঁরা শিক্ষিকা তাই ছুটিই একমাত্র ভরসা ৷ তাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের বেড়ানোয় যেন সমাজ উপকৃত হয় ৷ তাই সমাজ সচেতনতার বার্তা নিয়ে এই ভারত ভ্রমণে বেরিয়েছেন ৷ রবিবার সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ যাত্রা শুরু করে ইতিমধ্যেই মঙ্গলবার তাঁরা উত্তরপ্রদেশ পৌঁছে গিয়েছেন ৷
শুধু কি সচেতনতার বার্তা দিতেই এই ভারত সফর ? পথচলতি মানুষরা কী বলছে ? সমাজে প্রভাব কেমন পড়ছে ? এই সব প্রশ্নের পাশাপাশি সচেতনতার এই সফরনামা নিয়ে ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি পূজা মণ্ডল ফোনে কথা বলেন শিক্ষিকা সুতপা দাসের সঙ্গে ৷
শিক্ষিকার কথায়, একটা প্রকৃত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে ওঠে নারী-পুরুষ উভয়ের উন্নতিতে ৷ কিন্তু এখনও আমরা বেশিরভাগ জায়গাতেই দেখি একটা বাড়িতে ছেলে ও মেয়ে থাকলে ছেলেটার প্রতি যতটা যত্ন নেওয়া হয় বা নজর দেওয়া হয় তার ভবিষ্যতের দিকে মেয়েটার প্রতি ততটা থাকে না ৷ ছেলেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এটাই যেন মূল মন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় ৷ আর মেয়েদের যেন বিয়ে দিলেই দায়িত্ব শেষ ৷ আমাদের উদ্দেশ্য এটাই যে, এই ছেলে-মেয়ের বিভেদ যাতে না করা হয় ৷ কন্যাসন্তানও যে পুত্রসন্তানের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেও যে তার দাদা বা ভাইয়ের মতো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারে তা বোঝানো ৷
এই সচেতনতার বার্তায় আমরা বলছি, "কন্যাসন্তানকে রক্ষা করুন ৷ ভবিষ্যতের মা কে বাঁচান ৷ বিশ্বকে বাঁচান ৷ তবেই সুন্দর একটা রাষ্ট্র গড়ে উঠবে ৷ আর সেই সুন্দর ভারত গড়ার লক্ষ্যেই আমাদের এই যাত্রা ৷ আর আমি দেখেছি অনেক রাজ্য যেখানে 10 বছরের নিচেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয় ৷ আর এর জন্য অনেকাংশে দায়ী থাকে মেয়েটার নিজের পরিবারই ৷ তাই আমরা চাই এই মানসিকতা বিলুপ্ত হোক ৷ আর তা বিলুপ্ত করার একমাত্র উপায় সচেতনতা ৷ যতদিন না আমরা সচেতন হব ততদিন আমাদের সমাজ সচেতন হবে না ৷ আর সমাজ সচেতন না হলে দেশ পিছিয়েই থাকবে ৷ ঠিক যেমনটা আলোর নিচে থাকে অন্ধকার ৷"
আমরা সোশাল মিডিয়ায় কন্যাভ্রুণ বা কন্যাসন্তান রক্ষার পোস্ট শেয়ার করে অনেক কথা লিখি ৷ কিন্তু সত্যিই কী আমরা মেয়েরা নিজেদের পরিবারকে বোঝাতে পেরেছি যে আমরা বোঝা নই ৷ আমরাও ঠিক মতো গাইড পেলে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সংসারের হাল ধরতে পারি, পরিবারের পাশে থাকতে পারি ৷ শুধু বাবা ও স্বামীর পরিচয় বহন করা নয়, আমাদেরও একটা নিজস্ব পরিচয় হতে পারে ৷ আমাদেরও স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আছে ৷ আর এই কথাটাই দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন এই তিন শিক্ষিকা ৷ তবে এই বয়সে দীর্ঘপথে তাঁদের শারীরিকভাবে ফিটনেসের রহস্য কী ? এই প্রশ্ন করতেই এক গাল হেসে দিদিমণির উত্তর,"365 দিন এক্সারসাইজ আর যোগ ব্যায়াম ৷"
আরও পড়ুন : বর্ধমান জেলায় বাল্যবিবাহ ও শিশু নির্যাতন রোধে পথনাটিকা