রায়না, 15 অগাস্ট : জলকাদা ভরতি ৷ ভরা বর্ষায় রাস্তা দিয়েই হাঁটাই সমস্যা ৷ সেই রাস্তা দিয়ে কিছুটা গেলেই চোখে পড়বে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর আবক্ষ মূর্তি ৷ ঝকঝকে, তকতকে ৷ সেখান থেকে মেরেকেটে 300 মিটার দূরে তাঁর জন্মভিটে ৷ অবশ্য যে বাড়িতে জন্মেছিলেন দেশের এক বীর সন্তান, সেই বাড়িটির অস্তিত্বই নেই ৷ স্মৃতি বলতে একাকী, নিঃসঙ্গ, ভাঙাচোরা একটি শৌচাগার৷ তার মধ্যে ডাঁই করে রাখা খড় ৷ এভাবেই চরম অবহেলার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে রাসবিহারীর জন্মভিটে সুবলদহ ৷
1886 সালের 25 মে সুবলদহ গ্রামে জন্ম রাসবিহারী বসুর ৷ সেখানেই কেটেছে ছেলেবেলা ৷ পড়েছিলেন গ্রামেরই পাঠশালায় ৷ প্রায় 14 বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে চন্দননগরে চলে যান ৷ তারপর থেকে আর জন্মভিটেতে পা পড়েনি রাসবিহারী বসুর ৷ তবে অনেকের বক্তব্য, ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে প্রায়ই সুবলদহে আসতেন ৷ কয়েকদিন আত্মগোপন করে থাকতেন, আবার চলে যেতেন ৷ ইতিমধ্যে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর রাসবিহারী বসু 1915 সালের 21 জানুয়ারি পাড়ি দেন জাপানে ৷ সেখানে 1945 সালের 21 জানুয়ারি জাপানেই মারা যান ৷ দু'বছর পর স্বাধীন হয় দেশ ৷ কিন্তু, অনাদরেই দিন কাটতে থাকে সুবলদহ গ্রামের ৷
এই সংক্রান্ত আরও খবর : বিপ্লবীদের অনুশীলন সমিতি এখন ব্যাডমিন্টন ক্লাব, আগামীতে সংগঠনের ব্যাটন কে ধরবে তা নিয়ে প্রশ্ন
দেশের 73 তম স্বাধীনতা দিবসের আগে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, এতদিনে এতটুকু বদলায়নি গ্রামের ছবিটা ৷ যে গ্রামে জন্মেছিলেন আজ়াদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাতা, সেই গ্রামে নেই পাকা রাস্তা ৷ প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা থেমে গেছে রাসবিহারী বসুর জন্মভিটের 6-7 কিলোমিটার আগেই ৷ লাল মাটির রাস্তাই একমাত্র ভরসা ৷ বৃষ্টি নামলে মাটির রাস্তাতে হাঁটা-চলাই দায় হয়ে ওঠে ৷ বাইক বা গাড়ি নিয়ে যাওয়া তো দূর অস্ত ৷ গ্রামের মাঝেই একটি জায়গায় গড়া হয়েছে রাসবিহারী বসুর মূর্তি ৷ এক পলক দেখলেই বোঝা যাবে, তা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় ৷ ব্যস, ওইটুকুই ৷ বাকিটা হতাশার, অবহেলার চিত্র ৷
এই সংক্রান্ত আরও খবর : ব্রিটেশের গুলিতে ঝাঁঝরা সতীর্থরা,প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামীর আক্ষেপ, সেদিন আমি কেন মরলাম না?
কিন্তু, কোথায় রাসবিহারী বসুর বাড়ি? খোঁজ করতেই গ্রামবাসীদের উৎসুক চোখ ঘিরে ধরল ৷ দৃষ্টিতে অবিশ্বাস ! বৃষ্টির মধ্যে কাদা মাড়িয়ে তাঁদের গ্রামের সোনার ছেলে ভিটে দেখতে এসেছে? ইতিমধ্যে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে তাঁর বাড়ি ৷ যেখানে বাড়ি ছিল, সেখানে এখন কার্যত খড়ের গাদা ৷ সেটাই জানান দিচ্ছে, এখানেই জন্মেছিলেন রাসবিহারী বসু ৷ যিনি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন ৷ সেখানে কয়েক মিটার দূরে ইটের একটি শৌচাগার ৷ সংরক্ষণ যে লেশমাত্র নেই, তা বোঝা যায় ভাঙাচোরা ইট দেখে ৷ দেওয়ালে ফাটল ধরেছে, দরজাও নেই ৷ চারপাশের অগাছার জঙ্গল ৷ তারাই যেন রাসবিহারী বসুর জন্মভিটেকে মনে রেখেছে ৷ আর সর্বক্ষণের সঙ্গী বলতে একটি ছোটো গার্ডওয়াল ৷ যেটা সরকারের তরফে করা হয়েছে ৷ আর বাকি প্রকল্প যা নেওয়া হয়েছে, তা সবই রয়ে গেছে ভাবনার খাতায় ৷
এই সংক্রান্ত আরও খবর : অবহেলায় স্বাধীনতা সংগ্রামী বিমলপ্রতিভার শেষচিহ্ন
কী দেখছেন এখানের অবস্থা ? প্রশ্নটা শুনে কিছুটা ক্ষুব্ধ হলেন গ্রামবাসী শেখ আহমেদ আলি ৷ কিছুটা চড়া স্বরে বললেন, "আপনারা যা দেখছেন, আমরাও তাই দেখছি ৷ আমরা অনুভব করতে পারছি অবস্থার, আপনারা পারছেন না ৷ " কথাটা একেবারে সত্যি ৷ কম মন্ত্রী-প্রশাসনের আধিকারিকদের দেখেনি এই গ্রাম ৷ পেয়েছেন প্রতিশ্রুতি ৷ কিন্তু, বদলায়নি চিত্রটা ৷ যে জায়গাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে, তা স্রেফ অবহেলায় ধুঁকছে ৷ ওই বাসিন্দা বললেন, "বাস্তবটা তো আমাদের সামনে ৷ এখানে অনেক মন্ত্রী এসেছেন ৷ এসেছিলেন পীযূষ গোয়েল ৷ সবাই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন ৷ যা রাস্তার অবস্থা, তাতে গাড়ি ঢুকতে পারে না ৷" তাই বেশি মানুষের পা পড়ে না গ্রাম ৷ তাঁর দাবি, "সুন্দর জায়গা তৈরি হোক, টুরিস্ট স্পট তৈরি হোক ৷ হেরিটেজ তকমা দেওয়া হোক ৷" অপর এক গ্রামবাসী শ্রীমন্ত কারক বলেন, "রাস্তার যাচ্ছেতাই অবস্থা ৷ মাসকয়েক আগে গ্রামে অরূপ বিশ্বাস এসেছিলেন ৷ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাস্তা পাকা করার ৷ মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলতে চাই, আপনি রাসবিহারী বসুর জন্মভিটেতে আসুন ৷ দেখে যান, এখানের এখন কী অবস্থা? " কয়েকজনের বক্তব্য, রাজ্যে পালাবদলে গ্রামের বেহাল ছবির কিছুটা উন্নতি হয়েছে ৷ তবে, কেন্দ্রের তরফে কোনও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি ৷
এই সংক্রান্ত আরও খবর : চাকরির জন্য যুবকরা যেন অন্য দেশে চলে না যান, বলছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী চুনিলাল
বড়বৈনান গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তরুণকান্তি ঘোষ জানান, "পাকা রাস্তার জন্য জেলা পরিষদ থেকে ইতিমধ্যে অর্থ বরাদ্দ হয়ে গেছে ৷ বর্ষার জন্য কাজ শুরু করা যায়নি ৷ রাসবিহারী বসুর মূর্তির পাশ দিয়ে জন্মভিটে পর্যন্ত রাস্তাটি যাবে ৷ খুব দ্রুত কাজ শুরু হবে ৷ সংরক্ষণের জন্য রাজ্য সরকার যথেষ্ট সচেতন ৷ টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে ৷ স্থানীয় বিধায়ক জানিয়েছেন, ওখানে মুক্তমঞ্চ তৈরি করা হবে ৷" আর সেই আশাতেই বুক বেঁধে এবছর আরও একটা স্বাধীনতা দিবস কাটছে সুবলদহবাসীর ৷ আজও তেরঙ্গা উড়েছে গ্রামে ৷ কাদা পেরিয়েই তেরঙ্গা তুলেছেন গ্রামবাসীরা ৷ উড়েছে দেশের অন্যত্রও ৷ গ্রামবাসীদের আশা, এবার কি কিছু হবে !
এই সংক্রান্ত আরও খবর : ক্ষুদিরাম বসুকে বাঁচাতে লড়েছিলেন নরেন্দ্রকুমার