ETV Bharat / state

থমকে ট্রেনের চাকা, বন্ধ রোজগার; আত্মহত্যা একাধিক হকারের

লকডাউন শেষে আনলক ফোর শুরু হয়েছে । এখনও স্তব্ধ রেলের চাকা । অথচ মাস কয়েক আগেই ছবিটা ছিল অন্য ।

থমকে ট্রেনের চাকা, বন্ধ রোজগার; আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন ট্রেনের হকাররা
থমকে ট্রেনের চাকা, বন্ধ রোজগার; আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন ট্রেনের হকাররা
author img

By

Published : Sep 1, 2020, 9:26 PM IST

Updated : Sep 1, 2020, 10:52 PM IST

বর্ধমান, 1 সেপ্টেম্বর : আসানসোলের দিক থেকে বর্ধমান স্টেশনে দূরপাল্লার ট্রেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকে । প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে এঁকেবেঁকে বেশ কয়েকটা লাইন বদলে ট্রেন 5 নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকে । ট্রেন যখন রেলের লাইনগুলি বদলে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোয় সেইসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেলের ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে হাতে খাবারের পসরা নিয়ে ছুটতে থাকেন হকাররা । শুধু দূরপাল্লার নয়, লোকাল ট্রেনের ক্ষেত্রেও এই ছবি দেখা যায় বর্ধমান স্টেশনে । হাওড়া বা আসানসোলের দিকে ট্রেন ছুটতে থাকলে হকাররা পৌঁছে যায় ডেইলি পাসেঞ্জারের কামরায় । তাঁরা কারও খান দা, কারও কাছে ব্যানার্জিদা । প্যাসেঞ্জারেরাও উদগ্রীব হয়ে থাকেন কখন আসবে বাপির চা কিংবা ভীমের কচুরি । এমনই সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে শীতের পিকনিকেও তাঁদের ডাক পড়ে । কোরোনা পরিস্থিতির জেরে আজ বদলে গেছে হকারদের জীবন । পরিস্থিতি এমনই যে বর্ধমান স্টেশনের ছয়জন হকারকে বেছে নিতে হয়েছে আত্মহত্যার পথ ।

পাঁচমাস বন্ধ রেলের চাকা
পাঁচমাস বন্ধ রেলের চাকা

লকডাউন শেষে আনলক ফোর শুরু হয়েছে । এখনও স্তব্ধ রেলের চাকা । অথচ মাস কয়েক আগেই ছবিটা ছিল অন্য । হাওড়া মোকামা ফাস্ট প্যাসেঞ্জার রাত দেড়টা নাগাদ নিউজ পেপার নিয়ে বর্ধমান স্টেশনে আসতেই শুরু হয়ে যেত হকারদের দৌড়াদৌড়ি । তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাতে চা, কফি নিয়ে ছুটতেন রাকেশ শর্মা, রাজু রজকেরা । ভোর হতে না হতেই আঁচ ধরিয়ে চায়ের জল চাপাতেন শর্মা । হকারদের কলতানে মুখর হয়ে উঠত বর্ধমানের আটটি প্ল্যাটফর্ম । ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে যাঁরা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়তেন তাঁদের ঘুম থেকে তুলে হাতে চা ধরিয়ে দিতেন শেখ আনসারেরা । শুরু হত সারাদিনের লড়াই । লকডাউনের জেরে হঠাৎ করেই বদলে গেছে চেনা সেই ছবিটা । রেললাইনের আঁকাবাঁকা লাইনগুলো কেমন যেন থমকে গেছে । নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে গোটা স্টেশনকে । এর মধ্যেই দু'পয়সা রোজগারের আশায় বসে থাকেন বছর পঞ্চাশের দিলওয়ার খান । মাঝেমধ্যে মালগাড়ির আওয়াজ ও স্পেশাল ট্রেনের ঘোষণা হলেই তাঁর চোখ চিকচিক করে ওঠে । যদি স্পেশাল ট্রেনের কোনও রেলকর্মী ট্রেন থেকে নামেন । তাঁর হাতে দু'কাপ চা তুলে দিতে পারলে অন্তত দশ টাকা তো মিলবে । আসলে এখন বাড়িতে থাকা মানেই নিত্য অশান্তি । বাড়িতে চাল বাড়ন্ত, সবজির দাম আকাশছোঁয়া । বাড়ির শিশুদের মুখে দুধ, বিস্কুট তুলে দেবেন সেই সাধ্যও নেই তাঁদের । এরপর তো ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, ওষুধের খরচ তো রয়েইছে । বাড়ির ছোট্ট সদস্যের আবদার আছে । কিছু দিতে না পারলেই স্ত্রী পরিবারের অন্যদের সঙ্গে অশান্তি শুরু । যা সহ্য করতে না পেরে লকডাউনের মধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন রেলের ছয়জন হকার । এঁদের মধ্যে রাকেশ শর্মা (28), শেখ লাডলা(52), রাজু রজক (32), শেখ আনসার (32) ও পল্টু সিং (27) মালগাড়ির সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন । বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন বিজয়ন সরকার(40) । রাকেশ শর্মা, রাজু রজকেরা বংশ পরম্পরায় রেল স্টেশনে হকারি করে আসছেন । হকারদের মধ্যে অনেকেই এসেছেন বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে । ফলে, বেশিরভাগ হকারই অন্য পেশায় যেতে পারেননি । এরমধ্যে তাঁরা মাল তোলার জন্য চড়া সুদে ধারও নিয়েছেন । পাঁচ মাস ধরে সব বন্ধ থাকায় সেই লোন তাঁরা শোধ দিতে পারেননি । মহাজনরা লাগাতার তাগাদা দিচ্ছেন ।

খদ্দেরের আশায় দিলওয়ার খান
খদ্দেরের আশায় দিলওয়ার খান


"পাঁচ মাস ধরে রোজগার বন্ধ । সংসার চলছে না । তাও স্টেশনে এসে বসে থাকি । স্পেশাল ট্রেন থেকে রেলের কর্মীরা যখন ট্রেনে ওঠানামা করেন সেই সময় দু এক কাপ চা বিক্রি হয় । দিনে বিশ, পঞ্চাশ টাকা যা হয় তাই নিয়েই বাড়ি যাই ।" বলছিলেন বর্ধমান স্টেশনে খদ্দেরের আশায় বসে থাকা দিলওয়ার খান ৷ এই স্টেশনেই স্টল রয়েছে সন্তোষ মণ্ডলের ৷ তিনি বলছেন, "প্ল্যাটফর্মে আমার স্টল আছে। কিন্তু রেল বন্ধ থাকায় আর সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না । পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে হকাররা আত্মহত্যা করেছেন । অনেকেই লোন নিয়ে রেখেছেন । কিন্তু রোজগার না থাকায় সেই লোন তাঁরা শোধ করতে পারছেন না ।" রেলের INTTUC-র পক্ষ থেকে এইসব হকারের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে । এবিষয়ে জেলা INTTUC-র সভাপতি ইফতিকার আহমেদ বলেছেন, "আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে হকারদের জন্য পাঁচ মাস ধরে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেছি । তাঁদের পাশে আছি আমরা ।"

থমকে ট্রেনের চাকা, বন্ধ রোজগার; আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন ট্রেনের একাধিক হকার

রেল পরিষেবা থমকে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে স্টেশন সংলগ্ন সাইকেল স্ট্যান্ড, খাবারের দোকান, নিউজ পেপারের স্টলগুলি । ফলে, রেলের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ আজ চরম সমস্যায় ।

বর্ধমান, 1 সেপ্টেম্বর : আসানসোলের দিক থেকে বর্ধমান স্টেশনে দূরপাল্লার ট্রেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকে । প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে এঁকেবেঁকে বেশ কয়েকটা লাইন বদলে ট্রেন 5 নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকে । ট্রেন যখন রেলের লাইনগুলি বদলে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোয় সেইসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেলের ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে হাতে খাবারের পসরা নিয়ে ছুটতে থাকেন হকাররা । শুধু দূরপাল্লার নয়, লোকাল ট্রেনের ক্ষেত্রেও এই ছবি দেখা যায় বর্ধমান স্টেশনে । হাওড়া বা আসানসোলের দিকে ট্রেন ছুটতে থাকলে হকাররা পৌঁছে যায় ডেইলি পাসেঞ্জারের কামরায় । তাঁরা কারও খান দা, কারও কাছে ব্যানার্জিদা । প্যাসেঞ্জারেরাও উদগ্রীব হয়ে থাকেন কখন আসবে বাপির চা কিংবা ভীমের কচুরি । এমনই সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে শীতের পিকনিকেও তাঁদের ডাক পড়ে । কোরোনা পরিস্থিতির জেরে আজ বদলে গেছে হকারদের জীবন । পরিস্থিতি এমনই যে বর্ধমান স্টেশনের ছয়জন হকারকে বেছে নিতে হয়েছে আত্মহত্যার পথ ।

পাঁচমাস বন্ধ রেলের চাকা
পাঁচমাস বন্ধ রেলের চাকা

লকডাউন শেষে আনলক ফোর শুরু হয়েছে । এখনও স্তব্ধ রেলের চাকা । অথচ মাস কয়েক আগেই ছবিটা ছিল অন্য । হাওড়া মোকামা ফাস্ট প্যাসেঞ্জার রাত দেড়টা নাগাদ নিউজ পেপার নিয়ে বর্ধমান স্টেশনে আসতেই শুরু হয়ে যেত হকারদের দৌড়াদৌড়ি । তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাতে চা, কফি নিয়ে ছুটতেন রাকেশ শর্মা, রাজু রজকেরা । ভোর হতে না হতেই আঁচ ধরিয়ে চায়ের জল চাপাতেন শর্মা । হকারদের কলতানে মুখর হয়ে উঠত বর্ধমানের আটটি প্ল্যাটফর্ম । ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে যাঁরা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়তেন তাঁদের ঘুম থেকে তুলে হাতে চা ধরিয়ে দিতেন শেখ আনসারেরা । শুরু হত সারাদিনের লড়াই । লকডাউনের জেরে হঠাৎ করেই বদলে গেছে চেনা সেই ছবিটা । রেললাইনের আঁকাবাঁকা লাইনগুলো কেমন যেন থমকে গেছে । নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে গোটা স্টেশনকে । এর মধ্যেই দু'পয়সা রোজগারের আশায় বসে থাকেন বছর পঞ্চাশের দিলওয়ার খান । মাঝেমধ্যে মালগাড়ির আওয়াজ ও স্পেশাল ট্রেনের ঘোষণা হলেই তাঁর চোখ চিকচিক করে ওঠে । যদি স্পেশাল ট্রেনের কোনও রেলকর্মী ট্রেন থেকে নামেন । তাঁর হাতে দু'কাপ চা তুলে দিতে পারলে অন্তত দশ টাকা তো মিলবে । আসলে এখন বাড়িতে থাকা মানেই নিত্য অশান্তি । বাড়িতে চাল বাড়ন্ত, সবজির দাম আকাশছোঁয়া । বাড়ির শিশুদের মুখে দুধ, বিস্কুট তুলে দেবেন সেই সাধ্যও নেই তাঁদের । এরপর তো ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, ওষুধের খরচ তো রয়েইছে । বাড়ির ছোট্ট সদস্যের আবদার আছে । কিছু দিতে না পারলেই স্ত্রী পরিবারের অন্যদের সঙ্গে অশান্তি শুরু । যা সহ্য করতে না পেরে লকডাউনের মধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন রেলের ছয়জন হকার । এঁদের মধ্যে রাকেশ শর্মা (28), শেখ লাডলা(52), রাজু রজক (32), শেখ আনসার (32) ও পল্টু সিং (27) মালগাড়ির সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন । বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন বিজয়ন সরকার(40) । রাকেশ শর্মা, রাজু রজকেরা বংশ পরম্পরায় রেল স্টেশনে হকারি করে আসছেন । হকারদের মধ্যে অনেকেই এসেছেন বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে । ফলে, বেশিরভাগ হকারই অন্য পেশায় যেতে পারেননি । এরমধ্যে তাঁরা মাল তোলার জন্য চড়া সুদে ধারও নিয়েছেন । পাঁচ মাস ধরে সব বন্ধ থাকায় সেই লোন তাঁরা শোধ দিতে পারেননি । মহাজনরা লাগাতার তাগাদা দিচ্ছেন ।

খদ্দেরের আশায় দিলওয়ার খান
খদ্দেরের আশায় দিলওয়ার খান


"পাঁচ মাস ধরে রোজগার বন্ধ । সংসার চলছে না । তাও স্টেশনে এসে বসে থাকি । স্পেশাল ট্রেন থেকে রেলের কর্মীরা যখন ট্রেনে ওঠানামা করেন সেই সময় দু এক কাপ চা বিক্রি হয় । দিনে বিশ, পঞ্চাশ টাকা যা হয় তাই নিয়েই বাড়ি যাই ।" বলছিলেন বর্ধমান স্টেশনে খদ্দেরের আশায় বসে থাকা দিলওয়ার খান ৷ এই স্টেশনেই স্টল রয়েছে সন্তোষ মণ্ডলের ৷ তিনি বলছেন, "প্ল্যাটফর্মে আমার স্টল আছে। কিন্তু রেল বন্ধ থাকায় আর সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না । পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে হকাররা আত্মহত্যা করেছেন । অনেকেই লোন নিয়ে রেখেছেন । কিন্তু রোজগার না থাকায় সেই লোন তাঁরা শোধ করতে পারছেন না ।" রেলের INTTUC-র পক্ষ থেকে এইসব হকারের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে । এবিষয়ে জেলা INTTUC-র সভাপতি ইফতিকার আহমেদ বলেছেন, "আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে হকারদের জন্য পাঁচ মাস ধরে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেছি । তাঁদের পাশে আছি আমরা ।"

থমকে ট্রেনের চাকা, বন্ধ রোজগার; আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন ট্রেনের একাধিক হকার

রেল পরিষেবা থমকে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে স্টেশন সংলগ্ন সাইকেল স্ট্যান্ড, খাবারের দোকান, নিউজ পেপারের স্টলগুলি । ফলে, রেলের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ আজ চরম সমস্যায় ।

Last Updated : Sep 1, 2020, 10:52 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.