মেদিনীপুর, 28 জুলাই: মেদিনীপুর শহরে এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠল । জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক, জেলা পুলিশ সুপার ও জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন এক দম্পতি । আর কোনও দম্পতি যাতে তাঁদের মতো মারাত্মক ভুলের শিকার না হন এবং ওই চিকিৎসকের যাতে যথোপযুক্ত শাস্তি হয়, সেই আবেদন করেছেন তাঁরা ৷ ওই চিকিৎসক অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও স্বাস্থ্য আধিকারিক জানালেন, অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
প্রসূতিকে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ও তার জেরে নতুন করে আবার মা হওয়ার ক্ষেত্রে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে মুখোপাধ্যায় দম্পতির । আর তাতেই তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে অভিযোগ দায়ের করেন পুলিশ সুপার, স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং জেলাশাসকের দফতরে । তাঁদের দাবি, অবিলম্বে চিকিৎসকের শাস্তি এবং তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ।
দেওয়া হয়নি অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন: মেদিনীপুর শহরের হবিবপুর এলাকার বাসিন্দা সুমন ও স্বাগতা মুখোপাধ্যায় । এই দম্পতির অভিযোগ, 2015 সালে তাঁরা যখন সন্তান নেবেন বলে ঠিক করেন, ঠিক সেই সময় তাঁরা মেদিনীপুরের প্রসূতি চিকিৎসক কাঞ্চন ধাড়াকে দেখাচ্ছিলেন ৷ তাঁরই রবীন্দ্রনগরের সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টারে দেখাতেন ওই দম্পতি । কিন্তু অভিযোগ, স্বাগতার নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত থাকায় শিশুটি জন্মানোর পর প্রয়োজনীয় অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন 72 ঘণ্টার মধ্যে মাকে দেননি চিকিৎসক ।
ফিটাল অ্যানিমলি টেস্ট হয়নি: আরও অভিযোগ, সন্তান গর্ভে থাকাকালীন প্রসবের আগে শিশুর ফিটাল অ্যানিমলি টেস্ট করাননি চিকিৎসক ৷ এই পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর গঠনগত ত্রুটি থাকলে তা ধরা পড়ে । যার ফলস্বরূপ পরবর্তীকালে সেই শিশু হার্টের সমস্যা নিয়ে জন্মায় । এরপর কাঞ্চন ধাড়া ওই দম্পতিকে তাঁদের সন্তানকে তাঁর স্ত্রী তথা শিশু চিকিৎসক সন্ধ্যা ধাড়াকে দেখাতে বলেন । তাঁর অধীনে চিকিৎসার পরেও হৃদযন্ত্রে ত্রুটিগত সমস্যার জন্য 10 মাস বয়সে শিশুটি মারা যায় । আর এই চিকিৎসা করতে গিয়ে খরচ হয়ে যায় প্রায় 10 থেকে 12 লক্ষ টাকা ।
আরও পড়ুন: জল নয়, রক্ত বন্ধ করতে ব্যক্তির কানে এমসিল লাগানোর পরামর্শ হাতুড়ের
ভুয়ো ডিগ্রির অভিযোগ: এরপর স্ত্রীর দীর্ঘ চিকিৎসা করিয়ে সুমন মুখোপাধ্যায় অভিযোগ করেন যে, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের ভুল চিকিৎসা করেছেন মেদিনীপুরের এই কাঞ্চন ধাড়া এবং তাঁর স্ত্রী সন্ধ্যা ধাড়া । সুমন মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, এই কাঞ্চন ধাড়ার স্ত্রী সন্ধ্যা ধাড়া, যিনি নিজেকে শিশু বিশেষজ্ঞ এবং এমডি যোগ্যতার চিকিৎসক বলে উল্লেখ করেছিলেন, সেটা সঠিক নয় ৷ জালিয়াতি করা হয়েছে ।
ভুল চিকিৎসার কথা বলেন ভেলোরের বিশেষজ্ঞরা: এরপর আরটিআই করে জানা যায়, তিনি এমডি করেননি । তা সত্ত্বেও তিনি রীতিমতো সেন্টার খুলে এমডি ডাক্তার এবং শিশু চিকিৎসক লিখে হাজার হাজার রোগী দেখছেন মেদিনীপুর শহরে । এরপরই সুমন মুখোপাধ্যায় 2018 সালে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করেন ৷ এর জন্য তিনি ভেলোর নিয়ে যান স্ত্রীকে । সেখানে তিনি চিকিৎসা করিয়ে জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রীকে ভুল চিকিৎসা করা হয়েছে মেদিনীপুরে । তাঁকে সঠিক সময়ে অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন না দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা হবে, যার চিকিৎসা মেদিনীপুরে নেই । এতে আতঙ্ক তৈরি হয় ওই দম্পতির মধ্যে ৷ এরপর কেটে যায় প্রায় 4 বছর ৷
দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা: সম্প্রতি তাঁরা আবার সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করেন এবং এখন স্বাগতা মুখোপাধ্যায় 4 মাসের অন্তঃসত্ত্বা । কিন্তু সন্তান প্রসবে কোনও সমস্যা আসবে কি না, তা নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন এই দম্পতি ৷ আগের চিকিৎসকের ভুলের জন্য ইতিমধ্যে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে মাসে কয়েকবার করে কলকাতায় ছুটছেন ৷ যার জন্য খরচ হচ্ছে প্রায় 15 থেকে 20 হাজার টাকা । এই টাকা জোগাড় করতেও হিমশিম খাচ্ছেন এই দম্পতি ।
অভিযোগ ডিএম-এসপি-জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিককে: চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গর্ভাবস্থাতে অ্যানিমিয়া বা রক্তের সংকট দেখা দিতে পারে এবং সেই ক্ষেত্রে মাকে অতি জরুরি ভিত্তিতে রক্ত দিতে হবে । সেই চিকিৎসা হবে না মেদিনীপুর শহরে । আর এই আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিক, পুলিশ সুপার এবং জেলাশাসককে চিঠি দিয়েছেন দম্পতি ৷
আরও পড়ুন: ভুল চিকিৎসার অভিযোগ, ঝাড়গ্রামের নার্সিংহোমে মৃত্যু মহিলার
চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ: সুমন মুখোপাধ্যায় বলেন, "2016 সালে যখন আমি আমার স্ত্রীর ডেলিভারি করাতে যাই, প্রসূতি ডাক্তার কাঞ্চন ধাড়ার ভুলের জন্য আমার স্ত্রীর নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত থাকা সত্ত্বেও তাঁকে অ্যান্টি-ডি ইনজেকশন দেওয়া হয়নি ৷ এ ছাড়াও বাচ্চা জন্মানোর আগে হার্টগত ত্রুটি দেখার জন্য যে ফিটাল অ্যানিমলি টেস্ট করাতে হয়, তাও ডাক্তারবাবু করাননি । যার ফলে শিশুটি হার্টের সমস্যা নিয়ে জন্মায় । এরপর দীর্ঘ লড়াই করার পরইও দশ মাস বয়সি শিশুটি মারা যায় । সেই কষ্ট আমরা কাটিয়ে উঠেছি ৷ কিন্তু পরবর্তীকালে ভেলোরে অভিজ্ঞ ডাক্তারকে দেখানোয় তাঁরা বলেন পূর্বের ডাক্তারের ভুলের জন্য আগামী দিনে বাচ্চা নিতে গিয়ে সমস্যা হবে । শুধু সমস্যা হবে তা নয়, এই বাচ্চার ডেলিভারিতে অত্যন্ত উন্নত চিকিৎসা দরকার এবং যা যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ । বর্তমানে আমার স্ত্রী 4 মাসের গর্ভবতী । এখন আমরা আতঙ্কে রয়েছি এবং সেই আতঙ্কের জেরেই বিভিন্ন আধিকারিকের কাছে দ্বারস্থ হয়েছি । এই ভুল চিকিৎসার জন্য ওই ডাক্তারের শাস্তি হওয়া উচিত এবং আমাদের ক্ষতিপূরণ দরকার ।"
মানতে নারাজ অভিযুক্ত চিকিৎসক: যদিও এই ভুল চিকিৎসা নিয়ে উলটো সুর গাইছেন চিকিৎসক কাঞ্চন ধাড়া । তিনি এই প্রশ্ন শুনেই বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুল । ওই দম্পতি তাঁর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছেন । যার বাস্তবে কোনও প্রমাণ নেই । কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ওই ইনজেকশন না দেওয়াতে বাচ্চা আসা এবং না আসার কোনও সম্পর্ক নেই । কোনও জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাবারও সম্পর্ক নেই । এ ছাড়া তাঁর স্ত্রীর ভুয়ো ডিগ্রির অভিযোগের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই অভিযোগও ভিত্তিহীন । আসলে ওই দম্পতি নিজের হিংসা চরিতার্থ করার জন্য এই ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছেন তাঁর বিরুদ্ধে।
খতিয়ে দেখার আশ্বাস: যদিও এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে মেদিনীপুরের জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশংকর সড়ঙ্গী বলেন, এ রকম অভিযোগ তিনি একটি পেয়েছেন এবং সেই অভিযোগ রাজ্য স্বাস্থ্য কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছেন । কারণ এর আগে একটি একই রকম এক রোগীর পরিবার এক নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে করেছিল । যে ক্ষেত্রে প্রায় 10 লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল সেই নার্সিংহোমকে । এই বিষয়ে খতিয়ে দেখে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।