রানিগঞ্জ, 21 অগস্ট: অবশিষ্টাংশ চারটে দেওয়ালের ভাঙাচোরা ইঁটের গাঁথনি । এখানেই নাকি ছিল ভারতের প্রথম কয়লা খনির প্রবক্তা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাংলো । এই মাটিতে একদা পা পড়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের । এই নির্মাণ গর্ব ভরে যেন ঘোষণা করে বাণিজ্যে বাঙালিও সেরা । কিন্তু আজ স্রেফ ধ্বংসস্তূপ । শুধু দ্বারকানাথের বাংলো নয় । রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে ভারতের প্রথম কয়লা খনির ।
রানিগঞ্জের নারায়ণকুড়ি । ভারতের প্রথম কয়লা খনি এই নারায়ণকুড়িতেই গড়ে উঠেছিল, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের হাত ধরে । আর আজ সেই ইতিহাস ধ্বংসের মুখে । রানিগঞ্জের এগারা পঞ্চায়েতের অন্তর্গত নারায়ণকুড়ি গ্রামে 1832 সালে গড়ে উঠেছিল প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রথম কয়লা খনি । বন্ধু উইলিয়াম কারের সঙ্গে যৌথভাবে দ্বারকনাথ তৈরি করেছিলেন কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানি । ঐতিহাসিক এই তথ্য হয়তো ইতিহাস বইয়ে স্থান পাবে বা পেয়েছে । কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হতে চলেছে প্রিন্স দ্বারকানাথের স্মৃতি বিজরিত কয়লা কুঠি ।
নারায়ণকুড়ি গ্রামে গেলে আজও দেখা মিলবে প্রিন্স দ্বারকনাথের কয়লাকুঠির নানা নিদর্শনের । কিন্তু সব কিছুই প্রায় শেষ । ভাঙাচোরা ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে দ্বারকানাথের বাংলো । জনশ্রুতি আছে, এই বাংলোতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । বর্তমানে বাংলোর কয়েকটি দেওয়াল শুধু কঙ্কালসার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । বাংলো ঘেঁষেই গড়ে উঠছে ইসিএল-এর নারায়ণকুড়ি খোলামুখ খনি প্রকল্প । চারিপাশ ইসিএল-এর খোলামুখ খনি গ্রাস করেছে । ওইটুকু ছেড়ে বাকি এলাকায় চলছে খনন । তবে যেভাবে গোটা এলাকাকে গ্রাস করছে কয়লা খনি, তাতে এই ভাঙাচোরা অস্তিত্ব আর কতদিনই থাকবে, সেটাই সন্দেহ বাসিন্দাদের ।
আরও পড়ুন: অমৃত আজাদিতেও আদিবাসী সমাজে উপেক্ষিত 'নেহরুর বউ' বুধনি মেঝান
নারায়ণকুড়িতে দামোদরের তীরে রয়েছে ঐতিহাসিক জেটি ঘাট । একদা এখান থেকেই হাওড়ার আমতা-সহ বিভিন্ন জায়গায় কয়লা সরবরাহ হত । নৌকায় করেই তখন কয়লা সরবরাহ করা হত । পরে বাস্পচালিত জাহাজেও হত কয়লা সরবরাহ । ঐতিহাসিক জেটি ঘাটের অল্প কিছু অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে । যদি এই জেটি এখনই সংরক্ষণ না হয়, তবে দামোদরের গ্রাসে শেষ হয়ে যাবে ইতিহাসের আরও একটি দলিল । যদিও সরকারি উদ্যোগ ও আসানসোল দুর্গাপুর ডেভলপমেন্ট অথরিটির অর্থানুকূল্যে সেই জেটির পাশেই প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের একটি মূর্তি বসেছে । সৌন্দর্যায়ন হয়েছে দামোদরের ধারে মথুরাচণ্ডী ঘাটের ।
নারায়ণকুড়ি গ্রামে আজও হদিশ মেলে ভারতের প্রথম কয়লা খনির হলেজ ঘর ও কুয়ো আকৃতির কয়লা তোলার সুড়ঙ্গের । প্রবীণ মানুষজনেরা জানালেন, সেই সময় কয়লা খনি থেকে কয়লা বোঝাই ডুলি গাড়ি ঘোড়ায় টেনে নিয়ে আসত । ঐতিহাসিক সেই ছবি গ্রামবাসীরা যত্ন করে রেখেছেন । কয়লা উত্তোলন হত সেই কয়লা খনি থেকে, পরে তা নদী পথ দিয়ে পৌঁছে যেত কলকাতায় ।
জেটিঘাট দিয়ে নৌকা করে কয়লা সরবরাহের মাঝেই উৎপাদন যখন বাড়ে এবং বিদেশে কয়লার চাহিদা বাড়ে, তখনই কয়লা সরবরাহ করার জন্য পুর্ব ভারতে প্রথম রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয় । 1855 সালে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জে রেল চলাচল শুরু হয় । নারায়ণকুড়ি গ্রামের কয়লাখনিকে ঘিরেই এই রেল চলাচল শুরু হয় । তাই লেখা আছে রানিগঞ্জ স্টেশনে ঢোকার মুখে একটি বোর্ডে । একদা রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব এসেছিলেন । তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছেন পর্যটন মানচিত্রে আসবে নারায়ণকুড়ি ।
আরও পড়ুন: নর্মাল ডেলিভারি অথচ নেই কোনও যন্ত্রণা, নজির গড়ল আসানসোল জেলা হাসপাতাল
রানিগঞ্জের বিধায়ক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "রাজ্য সরকার ও এডিডিএ প্রায় আড়াই কোটি টাকা খরচ করে জেটি ঘাট এলাকাটিকে সৌন্দর্যায়ন করেছে । বাকি নিদর্শনগুলিকেও যথাযথ ভাবে সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে । রাজ্য পর্যটন ওয়েবসাইটে নারায়ণকুড়িকে নিয়ে আসা হলে মানুষ তার বিষয়ে জানতে পারবে ।"
স্থানীয় মানুষজনের দাবি, প্রাচীন এই নিদর্শনকে রক্ষা করতে রাজ্য সরকার আরও উদ্যোগী হোক । নইলে এ বার ধ্বংসের অতলেই তলিয়ে যাবে প্রিন্স দ্বারকানাথের এই কয়লা কুঠির ইতিহাস ।