আসানসোল, 11 অগস্ট: আসানসোলের প্রান্তিক এলাকা সূর্যনগর-ঢাকেশ্বরীতে গেলে চোখে পড়বে ভেঙেচুরে পড়ে আছে একটি রাস্তার ফলক । তাতে লেখা বিমলপ্রতিভা দেবী স্মরণী । কিন্তু কে এই বিমলপ্রতিভা দেবী ? এই প্রজন্মের কেউ চেনেই না তাঁকে । অথচ এই শিল্পাঞ্চল ও কয়লাঞ্চলে একদা ঘোড়া ছুটিয়ে যেতেন তিনি । কোমরে গোঁজা বন্দুক, হাতে থাকত চাবুক, মুখে জ্বলন্ত সিগার । এ দেশীয় শ্রমিকদের উপর ইংরেজদের অত্যাচারের খবর পেলেই ছুটতেন বিমলপ্রতিভা । চাবুকহাতে বিমলপ্রতিভাকে দেখলেই ইংরেজরা তটস্থ হয়ে যেত । যমের মতো ভয় করত তারা বিমলপ্রতিভাকে । স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে সেই বীরাঙ্গনার মুছে যাওয়া ইতিহাস খুঁজে দেখল ইটিভি ভারত ।
ছিল দেশপ্রেমের নেশা: 'হান্টারওয়ালি' বিমলপ্রতিভার জন্ম হয়েছিল 1901 সালের ডিসেম্বরে, ওড়িশার কটক শহরে । নেতাজির মতো একই শহরে জন্মে নেতাজিকে আদর্শ করেই বীরাঙ্গনা হয়ে উঠেছিলেন বিমলপ্রতিভা । বাবার নাম ছিল সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় । তিনি বিভিন্ন স্বদেশি আন্দোলনকে সমর্থন করতেন ও বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন । বাবার কাছে গল্প শুনেই স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন বিমলপ্রতিভা দেবী । পরবর্তীকালে তাঁর বিয়ে হয় কলকাতায় একটি বনেদি রক্ষণশীল বাড়িতে । কিন্তু তিনি বেশিদিন সংসারে আটকে থাকতে পারেননি । দেশপ্রেমের নেশায় যোগ দেন স্বদেশি আন্দোলনে ।
ডেকে পাঠান ভগৎ সিং: চিরকাল ডাকাবুকো বিমলপ্রতিভা মনে করেছিলেন, অহিংস আন্দোলনে স্বাধীনতা আসবে না । তাই বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি যোগ দেন সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে । কয়েকদিনেই তাঁর খবর পৌঁছে যায় বিপ্লবী নেতৃত্বদের কাছে । বিমলপ্রতিভা দেবীকে ডেকে পাঠান ভগৎ সিং । ভগৎ সিংয়ের বামপন্থী বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন বিমলপ্রতিভা । যোগ দেন ভগৎ সিংয়ের নওজওয়ান সভায় । একইসঙ্গে কংগ্রেসেও যোগ দিয়েছিলেন বিমলপ্রতিভা দেবী । যদিও নরমপন্থী আন্দোলনে বেশিদিন স্থির থাকতে পারেননি ।
আরও পড়ুন: কালনার জ্ঞানানন্দ মঠে যাতায়াত ছিল নেতাজি থেকে মাস্টারদার
ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ: বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ঘেঁটে জানা যায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বোন ঊর্মিলা দেবীর প্রতিষ্ঠিত নারী কর্মমন্দিরেরও তিনি সদস্য ছিলেন । 1930 সালে আইন অমান্য আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে যোগ দেন বিমলপ্রতিভা । শুধু তাই নয়, 1931 সালে ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরুর ফাঁসির প্রতিবাদে বাংলায় তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন বিমলপ্রতিভা । নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করলে বিমলপ্রতিভা ফরওয়ার্ড ব্লকেও যোগ দেন ।
গ্রেফতার বিমলপ্রতিভা: 1931 সালে উলটোডাঙায় ডাকাতি মামলা, 1930 সালে কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট হত্যা মামলায় একাধিকবার গ্রেফতার হন বিমলপ্রতিভা দেবী । এই সময় বেশ কিছুদিন জেলে ছিলেন তিনি । জেলে বসেই তাঁর প্রথম উপন্যাস লেখেন, ‘নতুন দিনের আলো’। পরবর্তীকালে 'আগুনের ফুলকি' নামে আরও একটি বই লিখেছিলেন তিনি ।
ব্রিটিশ পুলিশের ত্রাস: 1942-এ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হন বিমলপ্রতিভা । 1945-এ মুক্তি পাওয়ার পর তিনি যুক্ত হন বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে । চলে আসেন রানিগঞ্জ খনি এলাকায় । শোনা যায়, কয়লাখনির মজুরদের বস্তিতেই থাকতেন বিমলপ্রতিভা । ঘোড়া ছুটিয়ে ঘুরে বেড়াতেন । কোমরে গোঁজা থাকত রিভলভার । হাতে চাবুক আর মুখে জ্বলন্ত সিগার । শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশ অত্যাচারের কথা শুনলেই ছুটে যেতেন হান্টারওয়ালি বিমলপ্রতিভা । ব্রিটিশ পুলিশদের কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন তিনি ।
হারিয়ে যাচ্ছেন স্মৃতির অতলে: স্বাধীনতার পর শ্রমিকদের দাবিদাওয়া আদায়ে নানা আন্দোলন সংগঠিত করেন তিনি । পাশাপাশি শ্রমিক কল্যাণে নানা সমাজসেবামূলক কাজও করেন । জীবনের শেষ বয়সে তিনি হীরাপুরের ঢাকেশ্বরী সূর্যনগর এলাকায় চলে আসেন । দামোদরের ধারে একটি আবাসনে থাকতেন তিনি । স্থানীয় মানুষজনদের কথায়, শেষ জীবনটা বড় কষ্টের ছিল বিমলপ্রতিভার । আর সেই ভাবেই কষ্ট নিয়ে তিনি চলে যান । তাঁর মৃত্যুর পর ঢাকেশ্বরী সূর্যনগর এলাকায় একটি রাস্তাকে তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে বটে । কিন্তু তাঁকে কই মনে রাখল কয়লাঞ্চলের মানুষ ! স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বিমলপ্রতিভা দেবী ।
আরও পড়ুন: অনলাইন বা অফলাইন, দু'ভাবেই পাবেন জাতীয় পতাকা; সৌজন্যে ভারতীয় ডাক বিভাগ
সমাজসেবীর কথায়: আসানসোলের বিশিষ্ট সমাজসেবী চন্দনা মুখোপাধ্যায় বলেন, "আমার শ্বশুরমশাই বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনের পুরোধা চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় যখন বেঁচেছিলেন, তখন তাঁর কাছে আসতেন বিমলপ্রতিভা দেবী । শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে নানা আলোচনা হত তাঁদের মধ্যে । আমি শ্বশুর মশাইয়ের কাছে বিমলপ্রতিতভা দেবীকে নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি । তাঁর স্মৃতিকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন । তাঁর ইতিহাসকে আরও বেশি এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে নিয়ে আসার প্রয়োজন ।
শ্রমিক আন্দোলনে ভূমিকা: সিপিআইএমের পশ্চিম বর্ধমান জেলা কমিটির নেতা পার্থ মুখোপাধ্যায় বলেন, "স্বাধীনতার পূর্বতর সময় থেকে এই শিল্পাঞ্চল কয়লা অঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা উজ্জ্বল হয়ে আছে । কিন্তু আফসোস, তাঁর কোনও কিছুকেই সংরক্ষণ করে রাখা যায়নি । একটিমাত্র তাঁর ছবি পাওয়া যায় । ব্যাস সেইটুকুই । শুনছি, তাঁর নামের ফলক খুলে পড়ে রয়েছে এলাকায় । এলাকার জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে পৌরনিগমকে অনুরোধ করব, তাঁর নামাঙ্কিত রাস্তাটিকে যেন যত্ন করে তাঁর নামেই রাখা হয় ।