বরাকর, 13 সেপ্টেম্বর: রাত ফুরোলেই যখন হয় বিজয়ার তোড়জোড়, সেই বিদায়ের সন্ধিক্ষণেও নবমীতে দেবী দুর্গাকে আগমনী গান শোনানো হয় বরাকরের মুখোপাধ্যায় পরিবারে । নবমীর সারারাত মা'কে জাগিয়ে রাখা হয় গান শুনিয়ে । অন্যথা হলেই ঘটেছে বিপদ । জমিদারি বাড়ি হলেও মুখোপাধ্যায় পরিবারের দেবী দুর্গা আড়ম্বর পছন্দ করেন না । বরং আড়ম্বরহীন আটপৌড়ে, সাবেকী নিষ্ঠা সহকারে পুজো দেখার ইচ্ছে হলে বরাকরের মুখোপাধ্যায় পরিবারে যেতেই পারেন । আন্তরিকতায় ও আপ্যায়নে এই পরিবারের জুড়ি মেলা ভার ।
329 বছর ধরে বরাকরের মুখোপাধ্যায় পরিবারে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে বলে জানালেন পরিবারের সপ্তম পুরুষ কানাইলাল মুখোপাধ্যায় । এক সময় কাশেম বাজার রাজার এস্টেটের নায়েবিয়ানা করতে বরাকরে এসেছিল এই মুখোপাধ্যায় পরিবার । উদ্দেশ্য ছিল রাজার দেবতাদের সেবা করা । বরাকরে মুখোপাধ্যায় পরিবারে রয়েছে প্রাচীন শিবমূর্তি ৷ বহু বছর ধরে রয়েছে লক্ষ্মীনারায়ণ জিউয়ের শালগ্রাম শিলা । দৈনিক অন্নভোগ হয় গোপালের । যদিও দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরাই ।
এই পুজোর বিশেষত্বই হচ্ছে অনাড়ম্বরহীন সাবেকী গ্রাম বাংলার দুর্গাপুজো । একসময় প্রচুর প্রতিপত্তি ছিল বরাকরের এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের । কিন্তু পুজোতে কখনও আড়ম্বরের ছাপ ফেলেনি তারা । চেষ্টা করলেই অন্যথা হয়েছে বলে পরিবারের দাবি । বরাকরে মুখোপাধ্যায় পরিবারে অধিষ্ঠিত দেবী দুর্গা আড়ম্বর পছন্দ করেন না বলে পরিবার দাবি করেছে ৷
সপ্তমীর সকালে বরাকর নদী থেকে দোলা নিয়ে আসা হয় । এরপর শুরু হয় পুজো । এই পুজোয় কোনও বলিদান হয় না । পুজোর ভোগও তাই নিরামিষ । বংশানুক্রমিকভাবে তিন পুরুষ ধরে মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গা প্রতিমা গড়ে আসছে পুরুলিয়ার বেরো থেকে আসার সূত্রধর পরিবার । বর্তমানে যিনি প্রতিমা শিল্পী, সেই বিশ্বনাথ সূত্রধর জানালেন, তিনিও প্রায় 30-35 বছর ধ'রে এই প্রতিমা গড়ে আসছেন । একই রকম ভাবে বর্তমানে তাঁর ছেলেকেও নিয়ে আসছেন । আগামী দিনে বিশ্বনাথের ছেলে প্রতিমা তৈরির কাজ করবেন ।
আরও পড়ুন: হাতেগোনা আর মাত্র কয়েকটা দিন, চূড়ান্ত ব্যস্ততায় প্রতিমা তৈরি করছেন মৃৎশিল্পীরা
শুধু তাই নয়, প্রতিমা নিরঞ্জনও হয় বংশানুক্রমিকভাবে কৃষকদের কাঁধে বহন করে । মুখোপাধ্যায় পরিবারের জমিতে যে সমস্ত কৃষকরা চাষ করেন, তাঁরাই দশমীর দিন দেবী দুর্গাকে কাঁধে বহন করে পরিবারেরই মধুবাঁধ পুকুরে নিরঞ্জন করেন । তবে পরিবারের দাবি, সন্ধে নামার আগেই মা'কে বিদায় দিতে হয় । সন্ধে নেমে গেলে মা আর যেতে চান না । তখন এত ভারী হয়ে যায় দেবী প্রতিমা, যে তুলে নিয়ে যেতে সবারই কষ্ট হয় ।
তবে এত কিছুর মাঝেই মুখোপাধ্যায় পরিবারের নবমীর রাত একেবারেই অন্যরকম । নবমীর সারারাত ধরে দেবী দুর্গাকে গান শুনিয়ে জাগিয়ে রাখার নিয়ম মুখোপাধ্যায় পরিবারে । রয়েছে পারিবারিক নাট মঞ্চ । সেখানেই পরিবারের লোকেরা, পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই গান, নাচ ক'রে দেবী দুর্গাকে জাগিয়ে রাখেন । সন্ধের থেকে সাধারণ গান, আধুনিক গান হলেও বিজয়া দশমীর ভোরবেলা হয়ে আসতেই মাকে আগমনী গান শোনানো হয় । বিদায় বেলাতেও যেন আগমনের সুর বেজে ওঠে বরাকরের মুখোপাধ্যায় পরিবারে । কখনও অন্যথ্যা করতে গেলেই কিন্তু প্রতিবারই বিপদ ঘটেছে । এমনই দাবি করলেন পরিবারের কর্তা কানাইলাল মুখোপাধ্যায় ।
তিনি জানান, কখনও হ্যালোজেন লাইট ফেটে গিয়েছে, কখনও ভিসিআর সহযোগে সিনেমা দেখার আয়োজন করলে সেই ভিসিআরও পুড়ে গিয়েছে । তারপর থেকে আর অন্য কিছু করার চেষ্টা করেননি তাঁরা । নবমীর রাতে সবাই জেগে থাকেন, মাকেও জাগিয়ে রাখেন গান শুনিয়ে । আগে বসত পুজো উপলক্ষে যাত্রা পালা, পালা কীর্তনের আসর ৷ বর্তমানে সব ম্রিয়মান ।
পরিবারের গৃহবধূ কাবেরী মুখোপাধ্যায় জানালেন, "পরিবারের লোকেরা যেমন ভোগ রান্নায় অংশ নেন, তেমনই পাড়ার মহিলারাও আসেন এই পুজোয় ভোগ রান্না করতে এবং পুজো সামগ্রী জোগাড় করতে ।"
এক কথায় এই পুজো শুধু মুখোপাধ্যায় পরিবারের নয়, আশেপাশের পাড়া অঞ্চল এবং যেহেতু বরাকর ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী একটি শহর, তাই পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকেও বহু মানুষ আসেন বরাকরের এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো দেখতে ।