আসানসোল, 9 নভেম্বর: মাসখানেক আগেই ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যাচে ভারতের কাছে ধরাশায়ী হয়েছে পাকিস্তান ৷ সেমিফাইনালেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের খেলার ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে ৷ সেই সম্ভাবনা সত্যি হলে সেই ম্যাচেও ধারে-ভারে এগিয়ে থাকবে ভারতই ৷ এই পরিস্থিতিতে অন্য একটি প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের কাছে হারতে হল ভারতকে ৷
সেই প্রতিযোগিতা আবার ছিল শিক্ষকদের ৷ সম্প্রতি ইউনেস্কো, ভারকি ফাউন্ডেশন ও দুবাই কেয়ারের যৌথ উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড । আর সেখানেই জিতেছে পাকিস্তান ৷ ভারত থেকে আসানসোলের শিক্ষক দীপনারায়ণ নায়ক মনোনয়ন পেয়েছিলেন । প্রথম দশেও তাঁর নাম উঠে এসেছিল । সেই মতো প্যারিস যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি । কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের শিক্ষিকা তথা সমাজকর্মী সঙ্গে সিস্টার জেফ এই পুরস্কার জিতেছেন ৷ দীপনারায়ণ সফল না হওয়ায় মন খারাপ শিল্পাঞ্চলবাসীর ।
পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়ার তিলকা মাঝি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপনারায়ণ নায়ক । আদিবাসী পিছিয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন তিনি । তবে তাঁর কাজ ছড়িয়ে পড়ে কোভিডের সময় । কোভিডের সময় যখন স্কুল বন্ধ হয়ে চারিদিকে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়, তখন দীপনারায়ণ নায়ক ভেবেছিলেন এই সমস্ত আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে কোনও অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই । ফলে অনলাইন ক্লাস তারা করতে পারবে না । কিন্তু এমতাবস্থায় স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে এই প্রথম প্রজন্মের যারা পড়াশোনা করতে আসছে, পড়ার অভ্যাসটুকু যাদের শুরু হয়েছে, তারা পরে আর স্কুলমুখী হবে না । ফলে তাদের পঠনপাঠন অচিরেই বন্ধ হতে পারে ।
তাই স্কুল বন্ধ হলেও রাস্তার উপরেই ক্লাস শুরু করেন । শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের বসিয়ে, আদিবাসী মাটির বাড়ির দেওয়ালে ব্ল্যাকবোর্ড তৈরি করে ক্লাস করান তিনি । তাঁর নাম হয়ে যায় ‘রাস্তার মাস্টার’ । এরপর শুধু ছাত্র-ছাত্রী নয় ছাত্র-ছাত্রীদের মা-ঠাকুমা তিনটি প্রজন্মকে শিক্ষার আলো নিয়ে আসতে তিনি রাস্তার উপরেই অভিনব নানা উপায়ে পঠন-পাঠন করাতে শুরু করেন । এছাড়াও আদিবাসী সমাজে সচেতনতার নানা পাঠ দিতে শুরু করেন । ধীরে ধীরে তাঁর স্কুল ছড়িয়ে যেতে শুরু করে একটি গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে । এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ।
ইতিমধ্যেই বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন দীপনারায়ণ নায়ক । তাঁর এই কাজ নিয়ে দুর্গাপুজোর থিম করা হয়েছিল কলকাতার একটি বিখ্যাত পুজোমণ্ডপে । গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড পেলে সেই লড়াই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেত ৷
উল্লেখ্য, ইউনেস্কো, ভারকি ফাউন্ডেশন এবং দুবাই কেয়ার যৌথভাবে এই গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড দেয় প্রতিবছর । 2023 সালে ভারত থেকে শুধুমাত্র দীপনারায়ণ নায়ক এই মনোনয়ন পেয়েছিলেন । শুরু দিকে প্রথম 50 জনের মধ্যে তাঁর নাম ছিল । পরে প্রথম দশে উঠে আসে তাঁর নাম । আর তখনই গোটা শিল্পাঞ্চল, জেলা এবং রাজ্যের মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে আদিবাসী স্কুলের এই শিক্ষকই পুরস্কার পাবেন ৷ সোশাল মিডিয়ায় তাঁকে অগ্রিম শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দেওয়া হয় ।
গত 6 নভেম্বর প্যারিসে যান ওই শিক্ষক ৷ গতকাল 8 নভেম্বর সেই গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠিত হয় । গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন পাকিস্তানের শিক্ষিকা এবং সমাজকর্মী সিস্টার জেফ । জানা গিয়েছে, পাকিস্তানের পিছিয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার আলো নিয়ে আসতে নিজেই স্কুল খুলেছিলেন সিস্টার জেফ । অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি পিছিয়ে পড়া দুঃস্থ শিশুদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিয়েছেন ।
একই কাজ করেন দীপনারায়ন নায়ক । হয়তো জয়ের স্বীকৃতির দিক দিয়ে তিনি সামান্য পিছিয়ে গেলেন । কিন্তু দীপনারায়ণের সমাজসেবা, আর্ত আদিবাসী মানুষদের পাশে থাকা তাঁকে মানবিকতার স্বীকৃতি এনে দিয়েছে । সাময়িক মন খারাপ আসানসোলের এই রাস্তার মাস্টারের ।
প্যারিস থেকে ইটিভি ভারতের প্রতিনিধিকে তিনি বলেন, "পুরস্কার অবশ্যই একটি কাজের স্বীকৃতি । তবে পুরস্কার না পেলেও কাজ থেমে থাকবে না । যে কাজের জন্য আমি এতদূর এসেছি । আমি ফিরে গিয়ে সেই কাজ আবার চালিয়ে যেতে চাই । আরও ভালো করে আদিবাসী দুঃস্থ শিশুদের শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসা আমার প্রধান কাজ ।’’
আরও পড়ুন: আদিবাসী সমাজে অভিনব উপায়ে শিক্ষাদান, আন্তর্জাতিক পুরস্কারের দৌড়ে 'রাস্তার মাস্টার'