আগরতলা, 25 জুন : মুকুল রায়ের ঘর ওয়াপসির পর থেকে বারবার শিরোনামে উঠে আসছে ত্রিপুরার কথা । ত্রিপুরার রাজনীতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, কোন নেতার গতিবিধি কীরকম... প্রতিটি খুঁটিনাটি এখন আতস কাঁচের তলায় । যখন ত্রিপুরার রাজনীতি নিয়ে এই ধরনের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ চলছে, তখন বেশ কিছু মজাদার তথ্য উঠে আসছে ত্রিপুরা বিধানসভার অধ্যক্ষের বিষয়ে । 2018 সালে ত্রিপুরায় বিপ্লব দেবের সরকার গঠন হলে, নতুন বিধানসভার অধ্যক্ষ হন রেবতীমোহন দাস । শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক পাশ । ত্রিপুরার বিধানসভার ওয়েবসাইটে অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত বিবরণে তেমনটাই উল্লেখ রয়েছে ।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভারতের রাজ্যগুলির বিধানসভার অধ্যক্ষদের মধ্যে স্বল্পশিক্ষিত রেবতীমোহন দাস । জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লায় । পরে চলে আসেন ভারতে । ত্রিপুরায় । অধ্যক্ষ নিজে অবশ্য দাবি করেন, এককালে তিনি শিক্ষকতা করতেন । কিন্তু কোন স্কুলে পড়াতেন, ভারতের কোনও স্কুলে, নাকি বাংলাদেশের... সে সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই । যদিও বা শিক্ষকতা করে থাকেন, তা বেশিদিন নয় । রাজনীতিতে পদার্পনের আগে, মাছ বিক্রি করেই তাঁর সংসার চলত । এমনকি রাজনীতিতে আসার পরেও দীর্ঘদিন এই পেশার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন রেবতীমোহন । অধ্যক্ষ নিজেও এটি স্বীকার করেন ।
রেবতীমোহন দাস নিজেকে তপসিলি গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতিনিধি বলে দাবি করেন । রাজনীতিতে আসা 1969-70 সালে । বাম রাজনীতি দিয়ে হাতেখড়ি । মানিক সরকারের আমলে আটবারের বিধায়ক ও মন্ত্রী অনিল সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন একসময়ে । ত্রিপুরার রাজনীতিতে কানাঘুষো শোনা যায়, অনিল সরকারের ছায়াতেই রেবতী রাজনীতিতে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছেন । কিন্তু হঠাৎ করেই 2018 সালে ত্রিপুরা বিধানসভা ভোটের আগে আগে দলবদল । চলে গেলেন বিজেপিতে । টিকিটও পেলেন । এতদিন মানিক সরকারের দল করলেও বিধানসভার টিকিট পাননি । সেই নিয়ে ক্ষোভ যে রেবতীর মনে মনে ছিল, তা নিয়ে পরবর্তী সময়ে নিজেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলেছেন ।
![Rebati Mohan Das](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/12258961_wb_jnfjnwefjkl.jpg)
আরও পড়ুন : কোন পথে ত্রিপুরায় মমতার সমীকরণ ?
ত্রিপুরার রাজনীতিতে রেবতীমোহন কোনওদিনই সেভাবে দাগ কাটতে পারেননি । প্রয়াত বাম নেতা অনিল সরকারের অনুগামী হিসেবেই যেটুকু যা পরিচিতি ছিল । কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিজেপিতে গিয়ে কীভাবে বিধানসভার অধ্যক্ষ হয়ে গেলেন তিনি ? তাও আবার বাম রাজনীতি থেকে লাফিয়ে পুরো ভিন্ন ঘরানার দক্ষিণপন্থী দলে গিয়ে । রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেন, 2018 সালে ত্রিপুরায় বিজেপির যে ঝড় এসেছিল, তাতেই বয়ে গিয়ে বিধায়ক হয়েছেন রেবতী । আলাদাভাবে তাঁর নিজস্ব কোনও ক্যারিশ্মা সেখানে ছিল না বলেই মনে করেন অনেকে ।
ত্রিপুরায় 2018 সালে যাঁরা বিজেপির টিকিটে বিধায়ক হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় সিংহভাগই শিক্ষাগত যোগ্যতার নীরিখে রেবতীমোহনের থেকে অনেকটাই উপরের সারিতে । অতুল দেববর্মা এমবিবিএস, এলএলবি । বিনয়ভূষণ দাস বিএ, এলএলবি । দিলীপকুমার দাস এমবিবিএস, এমডি । কল্যাণী রায় বিএসসি, এলএলবি । মনোজকান্তি দেব, বিএসসি (জিওলজি) । রতনলাল নাথ বিএ, এলএলবি । মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লবকুমার দেব নিজেও কলাবিভাগে স্নাতক । বিপ্লবের বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে পরিচিত সুদীপ রায়বর্মণ, তিনিও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন । বিই, মেকানিক্যাল । সঙ্গে আবার এলএলবি ডিগ্রি । এছাড়া আরও অনেক বিধায়ক রয়েছেন যাঁরা অন্ততপক্ষে স্নাতক । স্নাতক স্তর অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছে এমন বিধায়কও রয়েছেন অনেকে ।
![Rebati Mohan Das](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/12258961_wb_new2.jpg)
কিন্তু সবাইকে বাদ দিয়ে ত্রিপুরার বিধানসভার স্পিকার করা হল রেবতীমোহন দাসকে । রেবতীবাবু নিজে অবশ্য একজন 'স্বঘোষিত' কবি । বেশ কিছু কবিতার বইও লিখেছেন বলে শোনা যায় । কিন্তু বিধানসভার অধ্যক্ষ রেবতীমোহন দাসকে মাঝেমধ্যেই হোঁচট খেতে হয় । কখনও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খান । তো আবার কখনও নোটবন্দির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয় । মাঝে তো একবার ত্রিপুরার এক স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে গিয়ে রামায়ণ, মহাভারতকে পর্যন্ত ধর্মগ্রন্থ বানিয়ে ফেলেছিলেন । কোনটা মহাকাব্য, কোনটা ধর্মগ্রন্থ... তাই এখনও স্পষ্ট নয় রেবতীর কাছে । ড্যামেজ কন্ট্রোলে আবার আরও আজব যুক্তি । যাঁরা এগুলি লিখেছেন, তাঁরা ভাষাটাকে ভালবেসে লিখেছেন । তাই এগুলি "কাল্পনিক" হলেও রেবতীবাবু শ্রদ্ধা করেন । সেই কারণেই ধর্মগ্রন্থ বলেন ।
![Rebati Mohan Das](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/12258961_wb_5.jpg)
আরও পড়ুন : মুকুলের পথে ঘরে ফিরে সুদীপ কি ত্রিপুয়ায় তৃণমূলের সুদিন ফেরাবেন ?
রেবতীবাবুর কাছে এখন দেশের সবথেকে বড় সমস্যা বলতে বেকারত্ব বা কর্মসংস্থানের অভাব নয়, বরং মানুষের মধ্যে উদারতার অভাবটাই নাকি এখন দেশের সবথেকে জলজ্যান্ত সমস্যা । 2018 সালে ত্রিপুরা বিধানসভার অধ্যক্ষ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে এমন বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন রেবতীমোহন দাস । আর এইসব মন্তব্যের জেরে শুধুমাত্র ত্রিপুরার রাজনীতিতেই নয়, দেশের রাজনীতিতেও চর্চা হয়েছে ত্রিপুরার বিধানসভার অধ্যক্ষকে নিয়ে । লোপ্পা বলে ছক্কা হাঁকাতে ছাড়েননি বিরোধীরাও । এখন ত্রিপুরার বিজেপি বিধায়ক দলে একাধিক এলএলবি পাশ রয়েছেন । যদি আইনজ্ঞ এমন কোনও বিধায়ককে অধ্যক্ষ করা হত, তাহলে হয়ত এই ধরনের চর্চা এড়িয়ে যেতে পারত বিজেপি ।
![Rebati Mohan Das](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/12258961_wb_4.jpg)
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, রেবতীমোহনের আগে যিনি ত্রিপুরা বিধানসভার অধ্যক্ষ ছিলেন, তিনি রমেন্দ্রচন্দ্র দেবনাথ । সিপিএম বিধায়ক । 2003 সাল থেকে 2018 সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ত্রিপুরা বিধানসভার অধ্যক্ষ । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতক । পেশায় আইনজীবী । অধ্যক্ষ হওয়ার আগে ত্রিপুরার মন্ত্রীও ছিলেন ।
আর এখন ত্রিপুরা বিধানসভায় রেবতীর ডেপুটি হিসেবে রয়েছেন বিশ্ববন্ধু সেন । তাঁরও শিক্ষাগত যোগ্যতা রেবতীর থেকে বেশি । কলাবিভাগে স্নাতক ।
![Rebati Mohan Das](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/12258961_wb_6.jpg)
বিধানসভার অধ্যক্ষ হতে গেলে শিক্ষাগত যোগ্যতা কী হওয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে অবশ্য আলাদা করে কিছু বলা নেই । একজন বিধায়কের ক্ষেত্রেও শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনও উল্লেখ নেই । একজন বিধায়কের অন্যান্য যা যা যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন, বিধানসভার অধ্যক্ষের ক্ষেত্রেও সেগুলিই প্রযোজ্য ।
আরও পড়ুন : ত্রিপুরায় কোনও বিদ্রোহ নেই, দাবি বিজেপি সভাপতির
ব্রিটিশ-আমেরিকান লেখক তথা মোটিভেশনাল স্পিকার সিমন অলিভার সিনেক একবার বলেছিলেন, "নেতৃত্ব শুধুমাত্র পরবর্তী ভোটের জন্যই নয়, এটি পরবর্তী প্রজন্মকে গঠন করার জন্য ।" কথাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ । একটি দেশ গঠনের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব কতটা, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না । অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো শিক্ষাও নাগরিকদের ন্যূনতম চাহিদার মধ্যে একটি । আর এইসবের মধ্যে যে প্রশ্নটি আগেও একাধিকবার উঠে এসেছে, তা হল একজন রাজনীতিবিদ বা একজন জনপ্রতিনিধির ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা কী হওয়া প্রয়োজন ।
![Rebati Mohan Das](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/12258961_wb_1.jpg)
তবে এর বিরুদ্ধেও একটি মত রয়েছে । অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন, জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি রাখাটা ঠিক নয় । তাঁদের মতে এটি বৈষম্যমূলক এবং নির্বাচনে লড়ার সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী । তাঁদের যুক্তি, এমন কোনও মাপকাঠি তৈরি হলে গ্রামীণ এলাকাগুলি, বিশেষত যেসব জায়াগায় শিক্ষার হার কম, সেখানকার মানুষ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন ।
ভারত সরকার বনাম অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস মামলায় আদালত ভোট দেওয়ার অধিকার (বিধিবদ্ধ) এবং ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা (সাংবিধানিক) -- এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছিল । বলা হয়েছিল, নির্বাচন প্রক্রিয়া কীভাবে হবে তা নির্ধারণ করার অনুমোদন আইনসভার আছে । কিন্তু এক্ষেত্রে যদি শিক্ষাগত বিষয়টি নিয়ে আসার কথা ভাবা হয়, তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হতে পারে নির্বাচন ও শিক্ষার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করা ।
আরও পড়ুন : ত্রিপুরায় আদিবাসী পরিষদের ভোটে ভরাডুবি বিজেপির
2014 সালের ডিসেম্বরে রাজস্থান সরকার একটি অর্ডিন্যাস পাস করে । সেখানে বলা হয়েছিল জেলা পরিষদ বা পঞ্চায়েত সমিতির ভোটে লড়তে হলে মাধ্যমিক শিক্ষার ন্যূনতম যোগ্যতা থাকতে হবে। আর সরপঞ্চের জন্য লড়তে হলে জেনেরাল ক্যাটেগরির ক্ষেত্রে যে কোনও স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি পাশ হতে হবে । স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে মামলা হয় । সাহী রাম বনাম রাজ্য (পঞ্চায়েতি রাজ দফতর) মামলাটি রাজস্থান হাইকোর্টে ওঠে । পরে রাজস্থানের মন্ত্রিসভা দু'টি সংশোধনী বিল অনুমোদন করে । রাজস্থান পঞ্চায়েতি রাজ (সংশোধন) বিল, 2019 এবং রাজস্থান পৌরসভা (সংশোধন) বিল, 2019 । বিল দুটির মাধ্যমে রাজস্থানের পঞ্চায়েত ও পৌরভোটে লড়ার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্তকে তুলে দেওয়া হয় । বলা হয়, এগুলি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকারকে বাধা দিচ্ছিল ।
হরিয়ানা বিধানসভাতেও পঞ্চায়েত ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উল্লেখ করে বিল পাস করা হয়েছিল । এখানেও জেনেরাল ক্যাটেগরির ক্ষেত্রে ভোট লড়তে হলে মাধ্যমিক পাশ বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয় । এবারও মামলা হয় । রাজবালা ও অন্যান্য বনাম হরিয়ানা শীর্ষক ওই মামলায় রায় যায় সরকারের পক্ষে । বিচারপতি চেলামেশ্বর তাঁর রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, যদি আইন নির্বাচনে লড়া প্রার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে তবে "অযৌক্তিক বা অবৈধ বা অসংযুক্ত" কিছু নেই । বিচারপতির যুক্তি ছিল, "একমাত্র শিক্ষাই পারে একজন মানুষকে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ -- তার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করতে । সুতরাং, সুশাসনের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যবস্থা করা কখনও অপ্রাসঙ্গিক নয় ।"
হরিয়ানা সরকারের এই বিল ভীষণভাবে প্রশংসিত হয় বিভিন্ন মহলে । পরে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টার কেন্দ্রকে একটি চিঠিও পাঠান বিধায়ক ও সাংসদদের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করার জন্য ।