বড়ঞা, 9 সেপ্টেম্বর : ভাদু গান ৷ গ্রাম বাংলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির মধ্যে অন্যতম ৷ ভাদুর জীবনী নিয়ে নানা লোককথা প্রচলিত আছে ৷ তবে দু'রকম জনশ্রুতি সবচেয়ে বেশি শোনা যায় ৷ কারোর মতে, মানভূমের পঞ্চকুট বংশের রাজা নীলমণি সিংহের কন্যা ভাদুর আসল নাম ভদ্রাবতী । বিয়ের রাতে ভদ্রাবতীর হবু বর ও বরযাত্রীরা গভীর জঙ্গলে ডাকাতের হাতে প্রাণ হারান । হবু স্বামীর মৃত্যুতে শোকে কাতর হয়ে তাঁর জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দেন ভদ্রাবতী । কন্যা ভদ্রাবতীর এই আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নীলমণি সিংহ ভাদু উৎসবের সূচনা করেন ।
আবার কিছুজনের মতে, পুরুলিয়ার রাজার মেয়ে ভাদু । রাজা বাল্যকালে বিয়ের ঠিক করায় অভিমানে ঘর ছাড়ে ভাদু । আশ্রয় নেয় এক দুঃস্থের কুটিরে । তারপর থেকে আর ঘরে ফেরেনি সে । কথিত আছে সেই সময় থেকেই নারীকল্যাণ ও নারীমুক্তির প্রচার শুরু করে ভাদু ৷ তাই ভাদুগানের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে ।
আবার অনেকের ধারণা, ভাদু আসলে একটি কাল্পনিক চরিত্র । ভাদ্র মাসে কৃষিকাজ না থাকায় কৃষিজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েন । সংসার চালাতে মাটির একটি কাল্পনিক মূর্তি তৈরি করে তাঁরা বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতেন উপার্জনের আশায় । ভাদু গান শুনে সামর্থ্য মতো চাল, ডাল, সবজি, পয়সা শিল্পীদের হাতে তুলে দিতেন গ্রামবাসীরা । তা থেকেই সংসার চালাতেন তাঁরা ৷ সেই থেকেই গ্রামেগঞ্জে ভাদু গানের প্রচলন ৷
আরও পড়ুন : মিলেছে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, পেটের তাগিদে মেলায় হকারি করেন পটশিল্পী
তবে জনশ্রুতি যাই হোক না কেন, ভাদু যে গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে ঐতিহ্যবাহী একটি সংস্কৃতি তা বলাই বাহুল্য় ৷ প্রাচীন মানভূম থেকে ভাদু উৎসবের উৎপত্তি বলে মনে করা হলেও বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, ঝাড়খণ্ডের রাঁচি ও হাজারিবাগ জেলায় অন্তজ শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভাদু গান ও উৎসবের প্রচলন রয়েছে । গোটা ভাদ্র মাসজুড়ে ভাদু উৎসব পালিত হয় এই গানের মাধ্যমে ।
গ্রামের গৃহবধূদের জীবনকথা, পৌরাণিক ও সামাজিক বিভিন্ন কাহিনী অবলম্বনে গান রচনা করে পাঁচালির সুরে মাটির তৈরি ভাদু মূর্তিকে কোলে নিয়ে নৃত্যের মাধ্যমে ভাদু গান পরিবেশন করা হয় । এই ঐতিহ্যই আজ শিল্পীর অভাবে ধুঁকতে বসেছে ৷ এখন অনেক ভাদু শিল্পীরা এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও, মুর্শিদাবাদের বড়ঞা ব্লকে এখনও টিকে রয়েছে এই লোকসংস্কৃতি ৷
বংশপরম্পরায় পেটের তাগিদে এই পেশা চালিয়ে আসছেন বড়ঞা ব্লকের উৎপল দাস ৷ তাঁর কথায়, "কোনওরকমে ভাদুগান করে সংসার চলে ৷ পিতৃপুরুষদের থেকে পাওয়া পেশা, তাই এখনও বাঁচিয়ে রেখেছি ৷ তবে এভাবে আর কতদিন চলবে তা জানি না ৷ খরচের তুলনায় উপার্জন হয় না ৷"
এই বিষয়ে এলাকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জীতেন ঘোষ জানান, মূলত শিল্পীর অভাবেই আজ অস্তিত্ব সংকটে ভাদু গান ৷ গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের উচিত অবিলম্বে ভাদু শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো ৷
আরও পড়ুন : বর্ধমান জেলায় বাল্যবিবাহ ও শিশু নির্যাতন রোধে পথনাটিকা