হবিবপুর, 9 মার্চ : ঝড়ের প্রাথমিক ধাক্কার পর পেরিয়েছে 24 ঘণ্টা ৷ তবে আফটার শকে এখনও মাঝেমধ্যে কেঁপে উঠছে হবিবপুর কেন্দ্রের রাজনৈতিক হাওয়া ৷ আজও মানুষের মধ্যে চর্চা তুঙ্গে, কী হল সরলার ? প্রার্থী হওয়ার পরেও কেন দল ছাড়লেন তিনি ? তবে ক্যামেরা দেখলেই আলোচনা বন্ধ ৷ এমনকি চায়ের দোকানগুলিতেও একই চর্চা ৷ সেখানকার ঘাসফুল শিবিরগুলিতেও ৷ এরই মধ্যে আজ কলকাতা থেকে এলাকায় ফিরে এসেছেন নয়া তৃণমূল প্রার্থী প্রদীপ বাস্কে ৷ বিভিন্ন জায়গায় সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে তাঁকে ৷ আজ বুথভিত্তিক কয়েকটি দলীয় সভাও করেন তিনি ৷
হবিবপুর বিধানসভা কেন্দ্রটি দুটি ব্লক নিয়ে গঠিত ৷ হবিবপুর ও বামনগোলা ৷ বামনগোলা ব্লকের 6টি এবং হবিবপুর ব্লকের 8টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে এই কেন্দ্রে ৷ প্রায় 76 শতাংশ বাসিন্দা তপশিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত ৷ ভোটারের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ ৷ শুধুমাত্র 1967 সাল ছাড়া 1962 সাল থেকে 2016 সাল পর্যন্ত এই কেন্দ্র ছিল বামেদের দখলে ৷ সেই অর্থে হবিবপুরের রাজনৈতিক মাটির রং দীর্ঘদিন ধরেই লাল ৷ কিন্তু 2016 সালের পর থেকেই লাল রং দ্রুত ফিকে হতে শুরু করে৷ বামের সমর্থন যেতে শুরু করে রামে ৷ সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে ঊনিশের লোকসভা ভোটে বিধায়ক থেকে সাংসদ হন খগেন মুর্মু ৷ রাজনীতির ঘূর্ণিতে ঊনিশের উপনির্বাচনে এই কেন্দ্র পুরোপুরি গেরুয়া হয়ে যায় ৷ জয় পান বিজেপির জয়েল মুর্মু ৷ তিনি পেয়েছিলেন প্রায় 51 শতাংশ ভোট ৷ একধাক্কায় বিজেপির ভোট বেড়েছিল 28 শতাংশের বেশি ৷ ফলে একুশের ভোটে নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে থেকে খেলা শুরু করবে রাম শিবির ৷
হবিবপুর কেন্দ্রের 96 শতাংশের বেশি মানুষ গ্রামে বসবাস করেন ৷ ফলে যে কোনও ভোটে গ্রামীণ সমস্যাই এখানে প্রাধান্য পায় ৷ এলাকার মূল সমস্যা, জলসেচের অপ্রতুলতা ৷ প্রতি ভোটেই বিষয়টিকে ইশু করে সব রাজনৈতিক দল ৷ কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি এখনও ৷ সম্প্রতি বিষয়টি সংসদেও উত্থাপন করেছিলেন খগেনবাবু ৷ কিন্তু কেন্দ্র থেকে কী আশ্বাস মিলেছে, তা এখনও জানা যায়নি ৷
তবে সব ছাপিয়ে এখন রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা হবিবপুর কেন্দ্রে একটিই প্রশ্ন, তৃণমূলের প্রার্থী হওয়ার পরেও কেন দলবদল করে বিজেপিতে গেলেন সরলা মুর্মু ৷ তৃণমূলের তরফে বলা হচ্ছে, শারীরিক অসুস্থতার কারণেই গতকাল তাঁর পরিবর্তে এই কেন্দ্রে প্রদীপ বাস্কেকে প্রার্থী করা হয় ৷ কিন্তু শাসকদলের সেই দাবি খাটে না ৷ কারণ, যে সময় এই দাবি করা হয়েছে, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সশরীরে বিজেপি কার্যালয়ে গিয়ে কমলবনে নেমে পড়েন তিনি ৷ এনিয়ে আজ প্রশ্ন করা হয়েছিল, শাসকদলের হবিবপুর ও বামনগোলার ব্লক সভাপতি উজ্জ্বল মিশ্র এবং অশোক সরকারকে ৷
উজ্জ্বলবাবু বলেন, “আমরা মমতা ব্যানার্জিকে দেখেই দল করি ৷ তিনি সরলার উপর আস্থা রেখে প্রার্থী করেছিলেন ৷ কিন্তু সরলা তাঁর সেই আস্থা ধরে রাখতে পারেননি ৷ দীর্ঘদিন তৃণমূল থেকে সমস্ত সুযোগ সুবিধা নিয়ে তিনি বিজেপিতে চলে গিয়েছেন ৷ তবে তিনি গেলেও দলের কোনও কর্মী বিজেপিতে যায়নি ৷ যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা তৈরি ৷ এতে ভোটে কোনও প্রভাব পড়বে না ৷ আর প্রদীপ বাস্কে আমাদের ঘরের ছেলে ৷ ফলে আমরা একটু বাড়তি সুবিধে পাব ৷ প্রদীপ বাস্কেকে ব্যক্তিগতভাবে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি ৷ তিনি ষোলর ভোটে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন ৷ কিন্তু ওই দলে থেকে মানুষের উন্নয়ন করতে পারছিলেন না ৷ বিজেপির ধর্ম নিয়ে বিভাজন এবং অন্যান্য কাজ নিয়ে তিনি তিতিবিরক্ত ছিলেন ৷ তাই অনেকদিন ধরেই তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি আমার কাছে আবেদন করছিলেন ৷ ভোটাররাও বিষয়টি বুঝবে ৷ সরলা মুর্মুর নামে কিছু দেওয়াল লেখা হলেও সেখানে তাঁর নাম মুছে আমরা প্রদীপ বাস্কের নাম লিখছি ৷ আমরা এবার নেত্রীর নীতি ও আদর্শ এবং উন্নয়ন নিয়েই ভোটের প্রচার করব ৷”
এদিকে আজ দলের হিন্দি সেলের ব্লক সভাপতি শিবপ্রসাদ গুপ্তাকে পাশে বসিয়ে অশোকবাবু বলেন, “প্রথমবার প্রার্থী ঘোষণার পর 48 ঘণ্টার মধ্যেই দ্বিতীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে৷ ফলে এনিয়ে কোনও অসুবিধে হবে না৷ মানুষ এনিয়ে অত ভাবে না৷ প্রদীর বাস্কের হয়ে আমাদের নেতা ও কর্মীরা ময়দানে নেমে পড়েছেন৷ আর হবিবপুরের মাটি লাল বলে যে কথা বলা হয়, তা সঠিক নয়৷ বামেদের কিছু লোক বিজেপিকে পছন্দ করায় এবং মোদি হাওয়ায় গত উপনির্বাচনে আমাদের আশানুরূপ ফল হয়নি৷ এবার আমরা জয় নিয়ে 100 শতাংশ আশাবাদী৷ কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন দেখে আমজনতা তৃণমূলমুখী হয়ে গিয়েছে৷ তবে সরলা মুর্মু প্রার্থী থাকলে আমাদের একটু সুবিধে ছিল৷ তিনি মালদা জেলা পরিষদের সভাধিপতি ছিলেন৷ তবে প্রদীপ বাস্কে তরুণ প্রার্থী৷ শিক্ষক৷ তিনি নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে পারবেন৷ পাঁচ বছর আগে তিনি বিজেপির প্রার্থী ছিলেন ঠিক৷ কিন্তু এই সময়ের মধ্যে টাঙন-মহানন্দা দিয়েও তো অনেক জল গড়িয়েছে৷ মানুষ আমাদের প্রতীকে ভোট দেবে৷ কারণ, এই রাজ্যের সব কেন্দ্রের প্রার্থীই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ আর প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধে যে মামলা রয়েছে, তা আদতে কতটা সঠিক, তা দেখার বিষয়৷ মানুষ বোধহয় এত কিছু দেখবে না৷”
আজই কলকাতা থেকে জেলায় ফিরেছেন প্রদীপ বাস্কে৷ জানা গিয়েছে, একসময় নারীঘটিত মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ সেই মামলা এখনও চলছে৷ এনিয়ে প্রশ্ন করায় খানিকটা বিব্রত হয়ে পড়েন তিনি৷ বলেন, “মিথ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে সেই মামলা হয়েছিল৷ সেটা প্রমাণিতও হয়েছে৷” তিনি আরও বলেন, “এবার এই কেন্দ্রে প্রার্থী হতে চেয়ে আমি আগেই তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে আবেদন করেছিলাম৷ ষোলর ভোটে বিজেপির প্রার্থী হলেও ওই দল আমাকে কিছু দেয়নি৷ আমি মানুষের কাজ করতে চাই৷ তাই এই দলে এসেছিলাম৷ প্রথমে সরলার নাম প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করা হলেও আমার কাছে খবর ছিল, সে দল ছেড়ে দেবে৷ তাই আমি প্রার্থী হিসাবে মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম৷ আশা করি, এবার আমরা এই কেন্দ্রে জয় পাব৷”