ETV Bharat / state

অবসরের আট বছর পরেও পড়ুয়াদের টানে স্কুলে হাজির নিঃসন্তান দিদিমনি

Malda Retired Teacher: অবসর নিয়েছেন আট বছর হল ৷ তবু প্রতিদিন ঘণ্টা বাজলেই সঠিক সময়ে পড়ুয়াদের টানে স্কুলে হাজির দিদিমনি ৷ দিয়ে চলেছেন অংক ও ভৌত বিজ্ঞানের পাঠ ৷ একমাত্র অসুস্থ না-হলে এই রোজনামচায় কোনও ছেদ নেই স্বপ্না ঘোষ রায় দাসের জীবনে ৷

author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Dec 13, 2023, 10:15 PM IST

Malda Retired Teacher
স্বপ্না ঘোষ রায় দাস
অবসরের পরেও পড়ুয়াদের টানে স্কুলে হাজির নিঃসন্তান দিদিমনি

মালদা, 13 ডিসেম্বর: হাজারো সন্তানের ভার যিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তাঁর আবার নিঃসন্তান হওয়ার দুঃখ কোথায় ! না, সেই দুঃখ নেই তাঁরও ৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাজার হাজার প্রতিনিধিকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন তিনি ৷ হাতে ধরে সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার পথে তাদের হাঁটতেও শিখিয়েছেন 68 বছরের স্বপ্না ঘোষ রায় দাস ৷ শিখিয়েছেন বলা ভুল, এখনও শিখিয়ে যাচ্ছেন ৷ অবসর গ্রহণের আট বছর পরেও রোদ-ঝড়-জল উপেক্ষা করে আজও প্রতিটি দিন দৌড়চ্ছেন বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে তাঁর পুরনো স্কুলে এবং নির্দিষ্ট সময়ে ৷ একমাত্র অসুস্থ না হলে এই রোজনামচায় কোনও ছেদ নেই ৷ তাঁকে শিক্ষক সমাজের অনুপ্রেরণা বলেই মনে করেন স্বপ্নার সহকর্মীরা ৷ স্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি মাতৃসমা দিদিভাই ৷

পুরো নাম স্বপ্না ঘোষ রায় দাস ৷ বাড়ি মালদা শহরের দুই নম্বর গভর্নমেন্ট কলোনিতে ৷ স্বামী মিউচুয়াল ফান্ডের অ্যাডভাইজর ৷ এখনও কর্মক্ষম তিনি ৷ পরিবারে রয়েছেন বিশেষভাবে সক্ষম এক ভাসুর ৷ পরিবারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে ৷ সেই দায়িত্ব সামাল দিয়েই প্রতিদিন ঘণ্টা বাজার আগে পৌঁছে যান ইংরেজবাজার ব্লকের যদুপুর 2 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাঁধাপুকুর মোড়ে থাকা কমলাবাড়ি হাইস্কুলে ৷ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্লাস করেন ৷ পরীক্ষা নেন, খাতা দেখেন ৷ এখন তৃতীয় মূল্যায়ণ পর্বের খাতা দেখছেন ৷ কাজ শেষে সহকর্মীদের সঙ্গেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন ৷

Malda Retired Teacher
পরীক্ষা নেন এবং খাতাও দেখেন তিনি

1989 সালে এই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন স্বপ্না ৷ অংক আর ভৌত বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন তিনি ৷ এখনও ওই দুই বিষয়েরই ক্লাস নেন ৷ তাঁর কথায়, "2015 সালের 28 ফেব্রুয়ারি আমি কাগজে কলমে অবসর নিয়েছি ৷ কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়াতে খুব ভালো লাগে ৷ আমি নিঃসন্তান ৷ পড়ুয়ারাই আমার ছেলেমেয়ে ৷ ওদের টানেই এখনও রোজ স্কুলে আসি ৷ মনের টান না থাকলে কোনও কাজই ভালো করে করা যায় না ৷ তবে এই কাজে পয়সার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই ৷ ভালোবাসি বলেই কাজ করি ৷ পেনশন যেটুকু পাই, তাতে আমার চলে যায় ৷ ওতেই আমার হয়ে যাবে ৷ এই কাজে আমার স্বামী আমাকে 100 শতাংশ সমর্থন করেন ৷ তাঁর জন্যই এখনও আমি নিজের স্বপ্ন পূরণ করে চলেছি ৷ যতদিন শরীর ঠিক থাকবে, ততদিন আমি স্কুলে আসব, ছেলেমেয়েদের পড়াব ৷ এতে আমি আনন্দ পাই ৷"

Malda Retired Teacher
68 বছর বয়সেও সমানভাবে পড়িয়ে চলেছেন অবসরপ্রাপ্ত দিদিমনি

কমলাবাড়ি হাইস্কুলে প্রায় 900 পড়ুয়া ৷ স্থায়ী শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন 13 জন ৷ তবে দু'জন পার্শ্বশিক্ষক এবং একজন কম্পিউটার শিক্ষকও রয়েছেন ৷ তাঁরা প্রত্যেকেই স্বপ্নাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ৷ প্রধান শিক্ষক মহম্মদ মতিউর রহমানের গলায় সেকথাই শোনা গেল ৷ তাঁর বক্তব্য, স্বপ্না শিক্ষক সমাজের কাছে এক অনুপ্রেরণা ৷ অবসর গ্রহণের পরেও তিনি প্রতিদিন স্কুলে আসেন ৷ ক্লাস নেন, পরীক্ষা নেন, তার খাতা দেখেন ৷ রেজাল্টও তৈরি করেন ৷ এই পেশাকে ভালোবাসার পাশাপাশি পড়ুয়াদের নিজের ছেলেমেয়ে মনে না করলে এমনটা হয় না ৷ তাঁকে কোনও সাম্মানিক দেওয়া হয় না ৷ তিনি নিজের পয়সা খরচ করেই স্কুলে আসেন ৷ এমনকি টিফিনের খরচটুকুও তাঁকে দেওয়া হয় না ৷ তাঁকে আসা-যাওয়া এবং টিফিন খরচ দেওয়ার একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ৷ কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন ৷ এমন একজন শিক্ষিকাকে পেয়ে পড়ুয়ারাও ভীষণ খুশি ৷

তিনি বলেন, "স্বপ্নাদেবী ছেলেমেয়েদের জায়গায় নিজেকে নিয়ে গিয়ে শিক্ষাদান করেন ৷ তাঁকে প্রত্যেক পড়ুয়া খুব ভালোবাসে ৷ বিষয়টি আমরা জেলা শিক্ষা দফতরকে জানাইনি ৷ তার প্রয়োজন মনে করিনি ৷ তারাও কোনওদিন জানতে চায়নি ৷ আসলে স্বপ্নাদেবী যখন অবসর নিয়েছিলেন, তখনই স্বপ্নাদেবীর অবসরের পর স্কুলে ক্লাস করার বিষয় নিয়ে তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটি রেজুলেশন নিয়েছিল ৷"

এমন একজন শিক্ষিকাকে পেয়ে পড়ুয়ারা তো খুশি হবেই ৷ সেটাই জানাল নবমের ছাত্রী আবিদা খাতুন ৷ সে বলে, "স্বপ্না দিদিভাই আমাদের অংক শেখান ৷ তিনিই আমাদের বলেছেন, তিনি আট বছর আগেই অবসর নিয়েছেন ৷ আমাদের টানে তিনি এখনও স্কুলে আসেন ৷ অংক আর ভৌত বিজ্ঞানের ক্লাস নেন ৷ তাঁর ক্লাস করতে খুব ভালো লাগে ৷ বিশেষ করে তিনি খুব ভালো অংক শেখান ৷ উনি যেমন আমাদের ভালোবেসে প্রতিদিন স্কুলে আসেন, আমরাও তাঁকে ভীষণ ভালোবাসি ৷ আমরা তাঁকে আরও অনেকদিন স্কুলে চাই ৷"

আরও পড়ুন:

  1. গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড অধরা ‘রাস্তার মাস্টার’-এর, জয়ী পাকিস্তানের শিক্ষিকা
  2. দেদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে 40 বছর বয়সে মার্শাল আর্ট শিখছেন আদিবাসী শিক্ষিকা
  3. শিক্ষিকা-ছাত্রীদের যৌথ উদ্যোগে দেওয়াল চিত্রে সেজেছে স্কুল, ছাদ বাগানের সবজিতে মিড ডে মিল

অবসরের পরেও পড়ুয়াদের টানে স্কুলে হাজির নিঃসন্তান দিদিমনি

মালদা, 13 ডিসেম্বর: হাজারো সন্তানের ভার যিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তাঁর আবার নিঃসন্তান হওয়ার দুঃখ কোথায় ! না, সেই দুঃখ নেই তাঁরও ৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাজার হাজার প্রতিনিধিকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন তিনি ৷ হাতে ধরে সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার পথে তাদের হাঁটতেও শিখিয়েছেন 68 বছরের স্বপ্না ঘোষ রায় দাস ৷ শিখিয়েছেন বলা ভুল, এখনও শিখিয়ে যাচ্ছেন ৷ অবসর গ্রহণের আট বছর পরেও রোদ-ঝড়-জল উপেক্ষা করে আজও প্রতিটি দিন দৌড়চ্ছেন বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে তাঁর পুরনো স্কুলে এবং নির্দিষ্ট সময়ে ৷ একমাত্র অসুস্থ না হলে এই রোজনামচায় কোনও ছেদ নেই ৷ তাঁকে শিক্ষক সমাজের অনুপ্রেরণা বলেই মনে করেন স্বপ্নার সহকর্মীরা ৷ স্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি মাতৃসমা দিদিভাই ৷

পুরো নাম স্বপ্না ঘোষ রায় দাস ৷ বাড়ি মালদা শহরের দুই নম্বর গভর্নমেন্ট কলোনিতে ৷ স্বামী মিউচুয়াল ফান্ডের অ্যাডভাইজর ৷ এখনও কর্মক্ষম তিনি ৷ পরিবারে রয়েছেন বিশেষভাবে সক্ষম এক ভাসুর ৷ পরিবারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে ৷ সেই দায়িত্ব সামাল দিয়েই প্রতিদিন ঘণ্টা বাজার আগে পৌঁছে যান ইংরেজবাজার ব্লকের যদুপুর 2 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাঁধাপুকুর মোড়ে থাকা কমলাবাড়ি হাইস্কুলে ৷ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্লাস করেন ৷ পরীক্ষা নেন, খাতা দেখেন ৷ এখন তৃতীয় মূল্যায়ণ পর্বের খাতা দেখছেন ৷ কাজ শেষে সহকর্মীদের সঙ্গেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন ৷

Malda Retired Teacher
পরীক্ষা নেন এবং খাতাও দেখেন তিনি

1989 সালে এই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন স্বপ্না ৷ অংক আর ভৌত বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন তিনি ৷ এখনও ওই দুই বিষয়েরই ক্লাস নেন ৷ তাঁর কথায়, "2015 সালের 28 ফেব্রুয়ারি আমি কাগজে কলমে অবসর নিয়েছি ৷ কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়াতে খুব ভালো লাগে ৷ আমি নিঃসন্তান ৷ পড়ুয়ারাই আমার ছেলেমেয়ে ৷ ওদের টানেই এখনও রোজ স্কুলে আসি ৷ মনের টান না থাকলে কোনও কাজই ভালো করে করা যায় না ৷ তবে এই কাজে পয়সার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই ৷ ভালোবাসি বলেই কাজ করি ৷ পেনশন যেটুকু পাই, তাতে আমার চলে যায় ৷ ওতেই আমার হয়ে যাবে ৷ এই কাজে আমার স্বামী আমাকে 100 শতাংশ সমর্থন করেন ৷ তাঁর জন্যই এখনও আমি নিজের স্বপ্ন পূরণ করে চলেছি ৷ যতদিন শরীর ঠিক থাকবে, ততদিন আমি স্কুলে আসব, ছেলেমেয়েদের পড়াব ৷ এতে আমি আনন্দ পাই ৷"

Malda Retired Teacher
68 বছর বয়সেও সমানভাবে পড়িয়ে চলেছেন অবসরপ্রাপ্ত দিদিমনি

কমলাবাড়ি হাইস্কুলে প্রায় 900 পড়ুয়া ৷ স্থায়ী শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন 13 জন ৷ তবে দু'জন পার্শ্বশিক্ষক এবং একজন কম্পিউটার শিক্ষকও রয়েছেন ৷ তাঁরা প্রত্যেকেই স্বপ্নাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ৷ প্রধান শিক্ষক মহম্মদ মতিউর রহমানের গলায় সেকথাই শোনা গেল ৷ তাঁর বক্তব্য, স্বপ্না শিক্ষক সমাজের কাছে এক অনুপ্রেরণা ৷ অবসর গ্রহণের পরেও তিনি প্রতিদিন স্কুলে আসেন ৷ ক্লাস নেন, পরীক্ষা নেন, তার খাতা দেখেন ৷ রেজাল্টও তৈরি করেন ৷ এই পেশাকে ভালোবাসার পাশাপাশি পড়ুয়াদের নিজের ছেলেমেয়ে মনে না করলে এমনটা হয় না ৷ তাঁকে কোনও সাম্মানিক দেওয়া হয় না ৷ তিনি নিজের পয়সা খরচ করেই স্কুলে আসেন ৷ এমনকি টিফিনের খরচটুকুও তাঁকে দেওয়া হয় না ৷ তাঁকে আসা-যাওয়া এবং টিফিন খরচ দেওয়ার একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ৷ কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন ৷ এমন একজন শিক্ষিকাকে পেয়ে পড়ুয়ারাও ভীষণ খুশি ৷

তিনি বলেন, "স্বপ্নাদেবী ছেলেমেয়েদের জায়গায় নিজেকে নিয়ে গিয়ে শিক্ষাদান করেন ৷ তাঁকে প্রত্যেক পড়ুয়া খুব ভালোবাসে ৷ বিষয়টি আমরা জেলা শিক্ষা দফতরকে জানাইনি ৷ তার প্রয়োজন মনে করিনি ৷ তারাও কোনওদিন জানতে চায়নি ৷ আসলে স্বপ্নাদেবী যখন অবসর নিয়েছিলেন, তখনই স্বপ্নাদেবীর অবসরের পর স্কুলে ক্লাস করার বিষয় নিয়ে তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটি রেজুলেশন নিয়েছিল ৷"

এমন একজন শিক্ষিকাকে পেয়ে পড়ুয়ারা তো খুশি হবেই ৷ সেটাই জানাল নবমের ছাত্রী আবিদা খাতুন ৷ সে বলে, "স্বপ্না দিদিভাই আমাদের অংক শেখান ৷ তিনিই আমাদের বলেছেন, তিনি আট বছর আগেই অবসর নিয়েছেন ৷ আমাদের টানে তিনি এখনও স্কুলে আসেন ৷ অংক আর ভৌত বিজ্ঞানের ক্লাস নেন ৷ তাঁর ক্লাস করতে খুব ভালো লাগে ৷ বিশেষ করে তিনি খুব ভালো অংক শেখান ৷ উনি যেমন আমাদের ভালোবেসে প্রতিদিন স্কুলে আসেন, আমরাও তাঁকে ভীষণ ভালোবাসি ৷ আমরা তাঁকে আরও অনেকদিন স্কুলে চাই ৷"

আরও পড়ুন:

  1. গ্লোবাল টিচার অ্যাওয়ার্ড অধরা ‘রাস্তার মাস্টার’-এর, জয়ী পাকিস্তানের শিক্ষিকা
  2. দেদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে 40 বছর বয়সে মার্শাল আর্ট শিখছেন আদিবাসী শিক্ষিকা
  3. শিক্ষিকা-ছাত্রীদের যৌথ উদ্যোগে দেওয়াল চিত্রে সেজেছে স্কুল, ছাদ বাগানের সবজিতে মিড ডে মিল
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.