মালদা, 4 জুলাই : আষাঢ় চলছে৷ কলা জুটলেও এখনও দুধে আমসত্ত্ব পড়েনি৷ মন খারাপ বাঙালির৷ কারণ, এই রসের স্বাদ যে একবার পেয়েছে, সে কখনও ভুলতে পারবে না৷ বাঙালির গর্ব রবীন্দ্রনাথের আমসত্ত্ব প্রীতির কথাও অজানা নয় কারোর৷
এই রাজ্যে আমসত্ত্বের উৎপাদন মূলত তিনটি জেলায় হয়৷ মালদা, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ায়৷ তবে স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধে বাকি দুই জেলাকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে দিয়েছে মালদার আমসত্ত্ব৷ মালদার প্রায় সব জায়গাতেই আমসত্ত্ব তৈরি হয়৷ তবে সবচেয়ে ভালো আমসত্ত্ব পাওয়া যায় ইংরেজবাজার ব্লকের কয়েকটি গ্রামে৷ তার মধ্যে রয়েছে জোত আরাপুর, সদানন্দপুর, কাঞ্চনপুর, ঢাকুনিয়া, জোতগোপাল প্রভৃতি গ্রাম৷ বছরের এই সময় এই গ্রামগুলিতে ঢুকলেই দেখা যায়, গ্রামের রাস্তার দু’ধারে, বাড়ির ছাদ ভরে রয়েছে আমসত্ত্বের ডালায় (আমসত্ত্ব তৈরির জন্য বিশেষভাবে তৈরি বাঁশের পাত্রবিশেষ)৷ কিন্তু এবার কোনও গ্রামেই সেসবের দেখা নেই৷ কোরোনার জেরে থমকে গিয়েছে মালদার এই কুটিরশিল্প৷ যার জেরে অনেকেই মনে করছেন এইবছর প্রকৃত আমসত্ত্বের স্বাদ থেকে ব্রাত্যই থাকতে হবে আমবাঙালিকে৷
প্রতি বছর মালদা জেলায় প্রায় 10 কোটি টাকার ব্যবসা হয় আমসত্ত্বের৷ শুধু জেলা বা রাজ্য নয়, জেলার এই কুটিরশিল্প পাড়ি দেয় দেশ ও বিদেশেও৷ মূলত গ্রামের মহিলারা এটি তৈরির কাজ করে থাকেন৷ তবে অনেক পুরুষও এখন এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত৷ এক কিলো আমসত্ত্ব তৈরি করতে প্রায় সাত থেকে আট কিলোগ্রাম আমের প্রয়োজন৷ মালদায় প্রধানত চার প্রজাতির আমের আমসত্ত্ব তৈরি হয়৷ গোপালভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া ও ফজলি৷ তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আমসত্ত্ব হয় গোপালভোগের৷ তবে বর্তমানে এই প্রজাতির আম খুব কমই পাওয়া যায়৷
প্রথমে আমের খোসা কেটে কয়েক ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়৷ সেই আম চটকে রস বের করতে হবে৷ এরপর রসকে কাপড় কিংবা নেটে ছেঁকে নিতে হবে৷ যাতে আমসত্ত্বের মধ্যে আমের কোনও আঁশ না থেকে যায়৷ এরপর সেই রস কাপড়ের উপর নির্দিষ্ট স্তরে প্রলেপ দিতে হবে৷ খেয়াল রাখতে হবে, কোথাও যেন স্তর বেশি-কম না হয়৷ প্রথম স্তর শুকানোর দ্বিতীয় স্তর, এভাবে 8 থেকে 10টি স্তরে রসের প্রলেপ পড়বে৷ কড়া রোদে শুকিয়ে তৈরি হবে আমসত্ত্ব৷ আবহাওয়া ঠিক থাকলে আমসত্ত্ব তৈরি করতে 12 থেকে 15 দিন লাগে৷ কিন্তু কোরোনা ও লকডাউনের জেলার এই কুটিরশিল্পকে কার্যত পথে বসিয়ে ছেড়েছে৷
লকডাউন চলাকালীন আম চাষিরা সঠিকভাবে বাগান পরিচর্চা করতে পারেনি৷ তার প্রভাব পড়েছিল আম উৎপাদনে৷ তার উপর একের পর এক ঝড় ও শিলাবৃষ্টি আম চাষের দফারফা করে দিয়েছে৷ সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এবার মালদায় আম উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে৷ লক্ষমাত্রার চেয়ে অন্তত দেড় লক্ষ মেট্রিক টন কম আম উৎপাদন হয়েছে মালদায়৷ আর এর প্রভাব পড়েছে আমসত্ত্ব উৎপাদনেও৷ এ বছর বাজারে আমের দাম বেশ চড়া৷ 40 টাকা কেজি নীচে কোনও আম নেই৷ গোপালভোগের মতো কুলীন আম বিকিয়েছে 60 থেকে 70 টাকা কেজি দরে৷ আরও বড় সমস্যা, লকডাউনের ভয়ে এবার পরিপক্ক হওয়ার আগেই আম গাছ থেকে পেড়ে নিয়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা৷ ফলে আমের সেই স্বাদ এবার নেই৷ তাই এবার আমসত্ত্ব তৈরি থেকে বিরতই থেকেছেন অসংখ্য মানুষ৷
সদানন্দপুর গ্রামের ঝন্টু দাস বলেন, "এবার লকডাউনে কেউ বাগান ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারেনি৷ আমের দামও অনেকটাই বেশি৷ চাষি ও পাইকারি বিক্রেতারা লকডাউনের ভয়ে আম পরিপক্ক হওয়ার আগেই গাছ থেকে পেড়ে নিয়েছেন ৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দুই বেলা পেট ভরে খাবার জোগাড় করাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আমসত্ত্ব তৈরির জন্য আম কেনার পয়সা কোথায়? এবার আসমত্ত্বের বাজারদর কী হবে, আদৌ বিক্রি হবে কিনা তা নিয়েও চিন্তা রয়েছে৷ এসব ভেবেই এবার গ্রামের কেউ আমসত্ত্ব তৈরি করেনি৷" তিনি আরও বলেন, "আমসত্ত্ব শুধুমাত্র একটা ব্যবসা নয়, এটা মালদার একটা শিল্প, একটা ঐতিহ্য৷ কোরোনার জন্য এবার এই শিল্পটাই নষ্ট হতে বসেছে৷ আমসত্ত্ব বানিয়ে আমরা প্রতি বছর বেশ ভালোই রোজগার করি৷ কিন্তু কোরোনার জন্য এবার মানুষের হাতে টাকার অভাব৷ জেলার পাইকারি আমবাজারও তেমন জমেনি৷ তাই আমরাও এবার নিজেদের গুটিয়ে রেখেছি৷ আমরা কোনও দিন কোনও সরকারি সহায়তা পাইনি৷ অনেকে এই শিল্পকে আরও বড় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ সেসব বাস্তবায়িত হয়নি৷ দু’একজন ব্যবসায়ী এখান থেকে আমসত্ত্ব নিয়ে কলকাতা কিংবা অন্য কোনও মেলায় নিয়ে গিয়েছেন কয়েকবার৷ সেটুকুই৷ এই কাজের জন্য আমরা কোনও ব্যাংক ঋণ পাই না৷ আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই, এই শিল্প, ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের কিছু সাহায্য করা হোক৷"
এই বছর কাঞ্চনপুর গ্রামে আমসত্ত্ব তৈরি করেছেন একমাত্র 64 বছরের গায়েত্রী দাস৷ তিনি বলেন, "এবার শুধু হিমসাগর আমের পাঁচ ডালা আমসত্ত্ব তৈরি করেছি৷ আবহাওয়ার সঙ্গে আমের উৎপাদনও এবার অত্যন্ত খারাপ৷ এ বছর আম কিনে আনার পর বেশিদিন ভালো থাকছে না৷ পচে যাচ্ছে৷ পচা আমের আমসত্ত্ব হয় না৷ 40 টাকা কেজি দরে আম কিনে এনে আমাকে ফেলে দিতে হয়েছে৷ সেই আম গোরুকে খাওয়াতে হয়েছে৷ অন্য বছর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাড়ি থেকে 700-800 টাকা কেজি দরে আমসত্ত্ব কিনে নিয়ে যায়৷ কিন্তু এবার যা পরিস্থিতি, তাতে দু’হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে না পারলে পোষাবে না৷"
মালদা ম্যাঙ্গো মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উজ্জ্বল সাহা৷ তিনি বলেন, "কোরোনা আবহে এবার জেলার মূল অর্থনীতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত৷ প্রতিকুল আবহাওয়ায় এবং লকডাউনে আমের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে৷ আমের উপর নির্ভর করে জেলার লক্ষাধিক গ্রামীণ মহিলা আমসত্ত্ব তৈরি করেন৷ আমসত্ত্ব তৈরি মালদা জেলার অন্যতম প্রধান কুটিরশিল্প৷ কিন্তু এবার মহিলারা সেই কাজ করতে পারছেন না৷ তাঁদের হাতে আম কেনার টাকা নেই৷ আমসত্ত্ব তৈরির পর বিক্রি হবে কিনা তা নিয়েও তাঁরা চিন্তায় রয়েছেন৷ এই জেলার তৈরি আমসত্ত্ব জেলা, রাজ্য ও দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও যায়৷ কিন্তু এই বছর গ্রামীণ মহিলারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন৷ অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভাগকে বারবার চিঠি দিয়েছি৷ জানিয়েছি, এই শিল্পে মূলত মহিলারাই জড়িত৷ তাঁদের আর্থিক সাহায্য করলে মহিলারাই স্বনির্ভরতার দিকে এগোতে পারবেন৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, কেন্দ্রীয় সরকার এখনও পর্যন্ত আমাদের আবেদনে সাড়া দেয়নি৷"
আমসত্ত্ব শিল্পীদের নিয়ে চিন্তিত জেলার বণিকসভা, মালদা মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সও৷ সংগঠনের সম্পাদক জয়ন্ত কুণ্ডু বলেন, "মালদা জেলার অর্থনীতি আম ও রেশমের উপর নির্ভর করে৷ আম শুধু ফলের ব্যবসা নয়, এর সঙ্গে রয়েছে অনেক অনুসারি শিল্পও৷ তার মধ্যে অন্যতম আমসত্ত্ব৷ এটা বিদেশের বাজারেও যায়৷ আমসত্ত্ব মূলত গ্রামীণ মহিলারা তৈরি করেন৷ এবার লকডাউনের জন্য বাগানগুলি ঠিকমতো পরিচর্যা করা যায়নি৷ তারপর ঝড়ে জেলার আম বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ ফলে এবার আম তেমন নেই৷ তার প্রভাব পড়েছে আমসত্ত্ব শিল্পের উপরেও৷ কোরোনা আবহে মানুষের হাতে টাকা নেই৷ আমফানের পর আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি রেখেছিলাম, জেলার ক্ষতিগ্রস্ত আম চাষিদের আর্থিক সহায়তা করা হোক৷ কিন্তু রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় সরকার আম চাষি কিংবা আমের সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা ভাবেনি৷ ফলে আমের অনুসারি শিল্পগুলি ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷"যদিও জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তরের সহকারী ডেপুটি ডিরেক্টর রাহুল চক্রবর্তী ফোনে জানিয়েছেন, "বিষয়টির উপর তাঁদের নজর রয়েছে৷ আমসত্ত্ব শিল্পীদের নিয়ে একটি ক্লাস্টার তৈরি করা যায় কিনা তার চিন্তাভাবনা চলছে৷ তাঁরা এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বলছেন ৷"