মালদা, 14 জুলাই : একে কোরোনা আবহে রক্ষে নেই, দোসর অতিবৃষ্টি এবং নদীর জলস্তর বৃদ্ধি৷ প্রবল সংকটে পড়েছেন জেলার সবজি চাষিরা ৷ লকডাউন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেই তাঁদের ভাঁড়ার শূন্য হয়ে গিয়েছিল ৷ তার উপর প্রকৃতির বিরূপতায় দিশেহারা তাঁরা ৷ অন্য কোনও কাজের উপায় না পেয়ে, এই পরিস্থিতিতে চাষিরা সরকারি সাহায্যের দিকে মুখ তুলে রয়েছেন ৷ জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তরও সবজি চাষিদের সমস্যা নিয়ে চিন্তিত ৷ তবে এই মুহূর্তে বিপন্ন চাষিদের সরকারি আর্থিক সহায়তা করা সম্ভব নয় বলেই দপ্তরের তরফে জানানো হয়েছে৷ অর্থাৎ, আগামী কিছুদিন জেলার সবজি বাজারে যে আগুন জ্বলবে, তা বলাই বাহুল্য৷
জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, মালদা জেলায় 9435 হেক্টর জমিতে বর্ষাকালীন সবজি চাষ করা হয়৷ প্রায় 65 হাজার কৃষক সবজি চাষ করে থাকেন ৷ লকডাউন পর্বে এবার চাষ করতে সমস্যায় পড়েছিলেন তাঁরা৷ সময়মতো বীজ, সার কিংবা ওষুধের সংস্থান করতে পারেননি ৷ জমিতে কাজ করার জন্য শ্রমিকও ঠিকমতো পাওয়া যায়নি৷ লকডাউন শিথিল হলে তাঁরা বর্ষাকালীন বিভিন্ন সবজির বীজ ছড়ান৷ কিছু ক্ষেত্রে গত বছরের চারা রোপণ করেন৷ কিন্তু এবারের আগাম বর্ষা, অতিবৃষ্টি ও নদীর জলস্তর বৃদ্ধি তাঁদের প্রবল সমস্যায় ফেলেছে৷ এই মুহূর্তে জেলার প্রতিটি নদীর জলস্তর অনেকটা বেড়েছে৷ সেই জল ঢুকে পড়েছে সবজি খেতে৷ অনেক জমিতে বৃষ্টির জল আটকে রয়েছে৷ সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন পটল, ঝিঙে, করলা, লঙ্কা, কুমড়ো ও শশাচাষিরা৷ কারণ, এসব সবজি বালিমাটিতে ভালো হয়৷ ফলে এসব চাষের জমি মূলত নদী তীরবর্তী৷
জেলার প্রতিটি ব্লকে সবজি চাষ হলেও রতুয়া, পুরাতন মালদা, মানিকচক ও ইংরেজবাজার ব্লকে সবচেয়ে ভালো সবজি চাষ হয়৷ কিন্তু বর্ষাকালীন সবজি মরশুমের প্রায় শুরুতেই জমিতে জল ঢুকে যাওয়ায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে বেশিরভাগ গাছ৷ এক সবজিচাষি মুসলিম মোমিন বলেন, “এবার লকডাউন আর নদীর জল বেড়ে যাওয়ায় আমার প্রচুর ক্ষতি হয়েছে৷ খেতে শশা, করলা, পটল, মিষ্টি কুমড়ো ও লাউয়ের চাষ করেছিলাম৷ লকডাউনে বাজারে সবজি নিয়ে যেতে পারিনি৷ এবার অকাল বন্যায় জমিতে জল ঢুকে গেল ৷ তিন বিঘা জমি 9 হাজার টাকায় লিজে নিয়ে চাষ শুরু করেছিলাম ৷ এখন জমি মালিকের টাকা শোধ করতে পারছি না ৷ সরকার থেকে এখনও কোনও সাহায্য পাইনি ৷ পঞ্চায়েতে সাহায্যের কথা বলেছিলাম৷ কিন্তু তারা কোনও গুরুত্ব দিচ্ছে না৷ এই অবস্থায় কোনওরকমে সংসার চালাচ্ছি৷ আমার দাবি, এই পরিস্থিতিতে আমাদের সরকারি সহায়তা করা হোক ৷”
ইংরেজবাজারের দুর্গাপুর গ্রামের চাষি চারু সবজি বলেন, “আমি 10 বছর ধরে সবজি চাষ করছি৷ জমি লিজ নিয়েই চাষ করি৷ অন্যান্য বছর সব খরচ বাদ দিয়ে মরশুমে অন্তত 20 হাজার টাকা লাভ থাকে৷ সংসার চালিয়ে এই টাকা সঞ্চয় হয়৷ কিন্তু এবার নদীর জলে সব ভেসে গেল৷ লকডাউনে খুব অসুবিধেয় পড়েছিলাম৷ উৎপাদিত সবজি বাজারে নিয়ে যেতে পারিনি৷ বাজারে নিয়ে গেলেও ফেলা দামে বিক্রি করতে হয়েছে৷ এখন যা পরিস্থিতি তাতে খাবার কীভাবে জোটাব, সেটাই চিন্তার৷ সরকারি সাহায্য না পেলে পথে বসতে হবে৷ জমিতে পটল, লাউ, লংকা, ঝিঙে প্রভৃতি সবজি লাগিয়েছিলাম৷ সব শেষ৷ এখনও পর্যন্ত কোথাও থেকে কোনও সাহায্য পাইনি৷ সবজি চাষ ছাড়া অন্য কোনও কাজ করি না৷ ভিনরাজ্যেও কখনও কাজে যাইনি৷ এখন কী করব, বুঝতে পারছি না৷”
একই বক্তব্য আরেক সবজিচাষি অধীর হালদার বলেন, “সবজি চাষে অনেক খরচ ৷ জৈব ও রাসায়নিক সারও বেশি লাগে৷ এবার নির্দিষ্ট সময়েই বর্ষাকালীন সবজির চাষ শুরু করেছিলাম৷ গাছে কেবল ফল আসতে শুরু করেছিল ৷ মাসখানেক কিছু রোজগার করতে পেরেছি ৷ কিন্তু তারপরেই নদীর জল বেড়ে যায় ৷ জমিতে জল ঢুকে গিয়েছে ৷ আরও দু’মাস সবজির ভালো ফলন হত ৷ আমরা মূলত ঋণের উপরেই নির্ভর করি ৷ সমিতি থেকে 40 হাজার টাকা ঋণ নিয়ে জমি লিজ নিয়ে চাষ শুরু করেছিলাম ৷ ফসল বিক্রি করে ঋণ শোধ করার কথা৷ কিন্তু এবার আগাম বন্যায় আমাদের সব শেষ করে দিল৷ লকডাউনে ঠিকমতো বীজ, সার কিংবা শ্রমিক পাইনি৷ ফলে এবার প্রথম থেকেই সমস্যায় ছিলাম৷ এখন কী করে ঋণ শোধ করব, সংসারই বা চালাব কী করে, জানি না৷ আমার কৃষাণ ক্রেডিট কার্ড নেই৷ তার জন্য আবেদন জানিয়েছি৷ কবে পাব জানি না৷ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি সাহায্য কিংবা ঋণ না পেলে আমি একেবারে শেষ হয়ে যাব৷”
সবজি খেতের ক্ষতিতে জেলার বাজারে আগুন লেগে গিয়েছে৷ প্রতিটি সবজির দামই আকাশছোঁয়া৷ বাজারে গিয়ে হাত পুড়ছে সাধারণ মানুষের৷ মালদা শহরের ঝলঝলিয়া পৌর বাজারের সবজি বিক্রেতা অরুণকুমার প্রামাণিক বলেন, “এখন সবজির চড়া দাম৷ আলু 26, পটল 20 থেকে 30, বেগুন 25 থেকে 40, ঢ্যাঁড়শ 15 থেকে 30, ঝিঙে 25-30 টাকা কিলো৷ অন্যান্য বছরের থেকে এবার প্রতিটি সবজির দাম বেশি৷ কারণ, একদিকে লকডাউন, অন্যদিকে অতিবৃষ্টি ও আগাম বন্যার জল চাষের জমিতে ঢুকে গিয়েছে৷ চাষিদের সবজি খেত নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু চাষের জন্য তাদের ভালো টাকা খরচ হয়েছে৷ ফলে তারা কম দামে আমাদের সবজি দিচ্ছে না৷ এমন পরিস্থিতি কতদিন চলবে, আমরাও তা বুঝতে পারছি না৷ কোরোনা আবহে এবার বাজারের খুব খারাপ অবস্থা৷”
লকডাউন, আগাম বন্যা কিংবা অতিবৃষ্টিতে সবজিচাষিরা সমস্যায় পড়লেও এখনই তাদের সরকারি আর্থিক সহায়তা মিলছে না ৷ সেকথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দরের ডেপুটি ডিরেক্টর কৃষ্ণেন্দু নন্দন ৷ তিনি বলেন, “লকডাউন ও কোরোনা আবহে এই মুহূর্তে আমরা ঠিকমতো ফিল্ড ভিজিট করতে পারছি না৷ অতিবৃষ্টি কিংবা নদীর জলস্তর বৃদ্ধিতে সবজিচাষের ক্ষয়ক্ষতির কোনও রিপোর্ট এখনও আমাদের কাছে আসেনি৷ তবে আমরা প্রতি ব্লকে সবজি বীজ পাঠিয়েছি৷ বর্ষায় কোনও কারণে চাষিদের ক্ষতি হলে যাতে তাঁরা সেই বীজ বপন করতে পারেন, তার জন্যই আমরা আগাম সতর্কতা হিসাবে এই বীজ পাঠিয়েছি৷ জল জমলে বালিমাটির সবজি বেশি ক্ষতি হয়৷ অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বর্ষা আগাম এসেছে৷ নদীর জলও আগাম বেড়েছে৷ যেসব জমিতে জল ঢুকে গিয়েছে কিংবা জল দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে জল নামার পর নতুন চাষ করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই৷ আমরা আমফানের ক্ষতপূরণের জন্য একটা রিপোর্ট রাজ্যে পাঠিয়েছি৷ তবে কবে সেই টাকা আসবে জানা নেই৷ সবজিচাষিদের জন্য শীতকালীন চারটি ফসলের বীজ আমাদের রয়েছে৷ সেসব আমরা দিতে পারব৷ এছাড়া এই মুহূর্তে আমাদের কিছু করার নেই ৷”