ETV Bharat / state

গঙ্গার গ্রাসে ভিটে মাটি, পেটে নেই খাবার, পুনর্বাসনের আশায় কালিয়াচকের মানুষ - গঙ্গার গ্রাসে ভিটে মাটি

রাতভর বৃষ্টি মাথায় দিন কাটাচ্ছে গঙ্গা ভাঙনে গৃহহীন মানুষ । পেটে খাবার নেই । আজও নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে নিজেদের ঘরের ঠিকানা । নদীর কোত্থেকে বাঁচতে নিজের হাতে ঘর ভাঙছেন এলাকার পঞ্চায়েত সদস্যও।

malda news
malda news
author img

By

Published : Sep 22, 2020, 10:49 PM IST

মালদা, 22 সেপ্টেম্বর : গতকাল সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি । বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কোথায় যাবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না সাবেনুর বিবি । নদীতে যখন বাড়ি তলিয়ে যায়, তখন খানকতক জিনিস ঘর থেকে বের করতে পেরেছিলেন । কোলে বাচ্চা নিয়ে সেসব নদী থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরাতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায় । এদিকে নিজে অন্তঃসত্ত্বা । বেশি কাজকর্ম করতে পারছেন না । তবু ভবিষ্যৎ ভাবনায় তাঁকে কাজ করে যেতে হয়েছিল । রাতটা একজনের বারান্দায় কোনওরকমে কাটিয়েছেন । আজ সকাল থেকে শুরু হয়েছে অস্থায়ী আস্তানার খোঁজ । শেষ পর্যন্ত নদী থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক আমবাগানে একটা ত্রিপল টাঙিয়ে ফের চলে এসেছেন নদীর ধারে । বাড়িটা কোথায় ছিল, সেটাই ঠাহর করার চেষ্টা করছেন তিনি । সকাল থেকে জোটেনি খাবার । জুটবে কিনা সেটাও জানেন না । তিনি বলছেন, "গঙ্গা বাড়ি কেড়ে নিয়েছে। এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা, কোথায় থাকব ? BDO-র কাছে আমার আবেদন, আমাদের একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দেন তিনি । আমার তিনটে বাচ্চা আছে । এখন অন্তঃসত্ত্বা আমি । ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের নীচে এতজন থাকা যাচ্ছে না । ঝড়-বৃষ্টিতে সেই প্লাস্টিকের ত্রিপল ধরে বসে থাকা যায় না । আমার স্বামী শ্রমিকের কাজ করে । লকডাউন থেকে বসে রয়েছে । বাড়িতে টাকা পয়সা নেই । গতকাল ঘর তলিয়ে যাওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও সাহায্য পাইনি । ত্রিপলটা কোথায় টাঙাব, তার জায়গা পাচ্ছি না । গতকাল একজনের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি । কিন্তু অন্যরা তো সবসময় আমাদের থাকতে দেবে না ! সকাল থেকে খাবার জোটেনি । শুনেছি, আজ রান্না হবে না । বাচ্চা নিয়ে কী করব, জানি না।"

গতকাল তীব্র গঙ্গা ভাঙনের সাক্ষী থেকেছে কালিয়াচক তিন নম্বর ব্লকের বীরনগর 1 গ্রাম পঞ্চায়েতের চিনাবাজার সংলগ্ন বালুগ্রাম । কয়েক ঘণ্টার ভাঙনে নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে শতাধিক বাড়ি । গতকাল রাতেই ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গত মানুষদের জন্য কিছু ত্রাণ এলাকায় পাঠানো হয়েছে । শুকনো খাবারের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে ত্রিপলও । কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করছে এলাকার মানুষজন । এই মুহূর্তে তাঁরা ত্রাণ নয়, দাবি করছে পুনর্বাসনের । কারণ, দুর্গতদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের । শ্রমিক কিংবা প্রান্তিক কৃষক । তাদের পক্ষে জমি কিনে ঘর বাঁধা সম্ভব নয় । ফলে যতদিন না সরকারিভাবে তাঁদের ঘর বাঁধার জন্য জায়গা দেওয়া হবে, ততদিন তাদের অস্থায়ী আস্তানাই ভরসা । আজও গঙ্গার জলে পাক ধরে রয়েছে । তবে কিনারা থেকে কিছুটা দূরে সেই পাক দেখা যাচ্ছে । কখন পাক নদীর তীরে এসে লাগবে, সেই আশঙ্কাই এখন তাড়া করে বেড়াচ্ছে এলাকাবাসীকে । তাই আজও অনেকে নিজেদের পাকা দালান ভাঙছে । এর মধ্যে অনেক বাড়ির কিছুটা অংশ গতকালই নদীতে ধসে পড়েছে । যদিও আজ দুপুর পর্যন্ত প্রশাসনের কাউকে এলাকায় দেখা যায়নি । দেখা যায়নি ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের কাউকেও । এখনও সেখানে শুরু হয়নি পাড় বাঁচানোর কাজ ।

আজ সকাল থেকেই গঙ্গাপাড়ে ভিড় জমিয়েছিল এলাকার মানুষজন । সবার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ । গতকালের স্মৃতি ভুলতে যে অনেক সময় লাগবে, তা স্পষ্ট । তেমনই একজন কিরণ মণ্ডল বলেন, "গতকাল আমার বাড়ি নদীতে তলিয়ে গিয়েছে। সেই সময় বাড়িতে দুই ছেলে আর আমি ছিলাম । ছেলেরা শ্রমিক । এখনও পর্যন্ত কোনও ত্রাণ পাইনি । কেউ আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি । বাড়িতে একটা ছেঁড়া ত্রিপল ছিল । সেটা নিয়েই কোনওমতে থাকছি । তবে গতকাল রাতে স্কুলে শুকনো কিছু খাবার দিয়েছিল । সেটা খেয়েছি । বাড়ি হারিয়ে আমরা কোথায় যাব, জানি না । আমরা চাই, সরকার যেন আমাদের মতো গরিব মানুষকে একটা বাড়ি বানিয়ে দেয় । কারণ, জায়গা কিনে বাড়ি তৈরির ক্ষমতা আমাদের নেই ।"

আরেক দুর্গত সনকা রবিদাস বলেন, "আমি দাই মা । গতকাল এক প্রসূতিকে নিয়ে হাসপাতাল গিয়েছিলাম । সেই সময় গঙ্গার ভাঙনে বাড়ি তলিয়ে যায় । আমি সেকথা জানতাম না । গ্রামে ফিরে দেখি, আমার বাড়ি নেই । গ্রামের ছেলেরাই বাড়ির জিনিসপত্র খানিকটা বাঁচিয়েছে । এখন একটা বাগানে রয়েছি । আমার স্বামী বিড়ি বাঁধে । গতকাল সেও ঘরে ছিল না । আমাদের কিছুই নেই । কয়েকদিন আগে যখন চিনাবাজারে ভাঙন শুরু হয়, তখন আমরা নিজেরাই ঘর ভাঙতে শুরু করেছিলাম । সেই সময় প্রশাসন থেকে আমাদের কিছু ত্রাণ দিয়েছিল । সেগুলিও গতকাল নদীতে তলিয়ে গিয়েছে । তবে গতকাল স্কুলে খানিকটা চিঁড়ে দিয়েছিল । সেটা খেয়েই রয়েছি । আমরা ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, তারা যেন নদীর পাড় ঠিকমতো বেঁধে দেয় ।"

গঙ্গার গ্রাসে ভিটে মাটি, পেটে নেই খাবার, পুনর্বাসনের আশায় কালিয়াচকের মানুষ

বালুগ্রামের সাহিদুর রহমান বলেন, "গতকাল থেকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে । কেউ কোথাও থাকতে পারছে না । প্রায় সবাই বৃষ্টিতে ভিজছে । সারারাত বৃষ্টিতে ভিজেছি । চারিদিকে কান্নার আওয়াজ । গতকাল নদী ঘর গিলে নিয়েছে। এখন কোথায় থাকব ? কে আমাদের আশ্রয় দেবে ? কেউ খাবার পর্যন্ত দিচ্ছে না । গতকাল থেকে না খেয়ে আছি । আমরা চাষি মানুষ । খেটে খাই । প্রশাসনের কাছে আমাদের আর্জি, আমাদের খাবার আর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক । লকডাউনে কিছু করতে পারছি না । আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই ।"

মহরা বেওয়া বলেন, "ভাঙনে বাড়ি আর নেই। বাড়িতে আটটা বড় ঘর, একটা ছোট ঘর ছিল । সব এখন গঙ্গায় । স্বামী বছর ছয়েক আগে মারা গিয়েছে । চার ছেলে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাত । এখন ওরা কী করবে বুঝতে পারছি না । এক মেয়ের বিয়ে দেওয়া এখনও বাকি । সব হারিয়ে কী করব জানি না । কোথাও আশ্রয় নেই, কিছুই নেই । এখন বাগানে ত্রিপল টাঙিয়ে থাকছি । কিন্তু সেটা ক'দিন । একটা ত্রিপল ছাড়া এখনও সরকারি কোনও সাহায্য পাইনি ।"

গৃহহীন আবদুল করিম বলেন, "প্রশাসন বলছে, নদীর ধারে যাদের পুরো বাড়ি গঙ্গায় তলিয়ে যায়নি, তাঁদের সরকারি জমির পাট্টা দেওয়া হবে না । কিন্তু গতকাল অনেক বাড়ির একাংশ নদীতে তলিয়ে গিয়েছে । অনেকের বাড়ি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে । তাঁরা বাড়ি ভেঙে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে । কারণ সেই বাড়িতে বসবাস করা কিছুতেই সম্ভব নয় । এবার চার দফার গঙ্গা ভাঙনে প্রায় 300 বাড়ি নদীতে পড়ে গিয়েছে । অন্তত 500 বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত । তার মধ্যে মাত্র 71 জনের নাম পাট্টার তালিকায় রয়েছে । আমি চাই, নদীর জন্য যাদের গৃহহীন হতে হয়েছে, তাদের সবাইকে পাট্টা দেওয়া হোক।"

নদীতে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে আজ নিজের বাড়ি ভেঙে সরানোর কাজ করছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য হারুন আল রশিদও । তিনি বলেন, "আমি মুন্নাটোলা সংসদের সদস্য । আমার সংসদ এলাকার চিনাবাজার ও বালুগ্রামে এবার গঙ্গা ভাঙন হয়েছে । এই মরশুমে চারবার ভাঙন হল এখানে । গতকালের ভাঙনে শতাধিক বাড়ি তলিয়ে গিয়েছে । মোট তলিয়ে গিয়েছে প্রায় 250 বাড়ি । আমি গৃহহীনদের তালিকা প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছি । তার মধ্যে গতকাল আমার বুথের 32 জনকে পাট্টা দেওয়া হয়েছে । দুর্গারামটোলা বুথের 32 জনও পাট্টা পেয়েছে । গঙ্গা আমার বাড়িকেও বিপন্ন করেছে । তাই ঘর সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করেছি । 2016 সালে এই এলাকার সরকারপাড়ায় প্রথম গঙ্গা ভাঙন দেখা দেয় । চার বছর পর এবার ফের গঙ্গা এখানে তাণ্ডব চালাল ।"

পঞ্চায়েত সদস্য আরও বলেন, "আমি ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে পূনর্বাসনের জমি দেওয়ার জন্য BDO-কে জানিয়েছি । তিনি জানিয়েছেন, যাদের বাড়ি ইতিমধ্যে নদীতে তলিয়ে গিয়েছে, আগে তাদের পাট্টা দেওয়া হবে । পরে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে সেই সাহায্য করা হবে । তিনি ইতিমধ্যে আমার সংসদের জন্য 176টি ডিজ়াস্টার কিট পাঠিয়েছেন । সেসব বিলি করে দেওয়া হয়েছে ।"

আজ কালিয়াচক তিন নম্বরের BDO গৌতম দত্তের দেখা পাওয়া যায়নি । তিনি জানিয়েছেন, "ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের নামের একটি তালিকা জমা পড়েছে । গতকাল আমরা কিছু দুর্গতকে সরকারি জমির পাট্টা দিয়েছি । তবে এই মুহূর্তে আর কোনও জমির খোঁজ মিলছে না । জমি দেখা হচ্ছে । নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যেককেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে ।"

মালদা, 22 সেপ্টেম্বর : গতকাল সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি । বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কোথায় যাবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না সাবেনুর বিবি । নদীতে যখন বাড়ি তলিয়ে যায়, তখন খানকতক জিনিস ঘর থেকে বের করতে পেরেছিলেন । কোলে বাচ্চা নিয়ে সেসব নদী থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরাতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায় । এদিকে নিজে অন্তঃসত্ত্বা । বেশি কাজকর্ম করতে পারছেন না । তবু ভবিষ্যৎ ভাবনায় তাঁকে কাজ করে যেতে হয়েছিল । রাতটা একজনের বারান্দায় কোনওরকমে কাটিয়েছেন । আজ সকাল থেকে শুরু হয়েছে অস্থায়ী আস্তানার খোঁজ । শেষ পর্যন্ত নদী থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক আমবাগানে একটা ত্রিপল টাঙিয়ে ফের চলে এসেছেন নদীর ধারে । বাড়িটা কোথায় ছিল, সেটাই ঠাহর করার চেষ্টা করছেন তিনি । সকাল থেকে জোটেনি খাবার । জুটবে কিনা সেটাও জানেন না । তিনি বলছেন, "গঙ্গা বাড়ি কেড়ে নিয়েছে। এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা, কোথায় থাকব ? BDO-র কাছে আমার আবেদন, আমাদের একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দেন তিনি । আমার তিনটে বাচ্চা আছে । এখন অন্তঃসত্ত্বা আমি । ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের নীচে এতজন থাকা যাচ্ছে না । ঝড়-বৃষ্টিতে সেই প্লাস্টিকের ত্রিপল ধরে বসে থাকা যায় না । আমার স্বামী শ্রমিকের কাজ করে । লকডাউন থেকে বসে রয়েছে । বাড়িতে টাকা পয়সা নেই । গতকাল ঘর তলিয়ে যাওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও সাহায্য পাইনি । ত্রিপলটা কোথায় টাঙাব, তার জায়গা পাচ্ছি না । গতকাল একজনের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি । কিন্তু অন্যরা তো সবসময় আমাদের থাকতে দেবে না ! সকাল থেকে খাবার জোটেনি । শুনেছি, আজ রান্না হবে না । বাচ্চা নিয়ে কী করব, জানি না।"

গতকাল তীব্র গঙ্গা ভাঙনের সাক্ষী থেকেছে কালিয়াচক তিন নম্বর ব্লকের বীরনগর 1 গ্রাম পঞ্চায়েতের চিনাবাজার সংলগ্ন বালুগ্রাম । কয়েক ঘণ্টার ভাঙনে নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে শতাধিক বাড়ি । গতকাল রাতেই ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গত মানুষদের জন্য কিছু ত্রাণ এলাকায় পাঠানো হয়েছে । শুকনো খাবারের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে ত্রিপলও । কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করছে এলাকার মানুষজন । এই মুহূর্তে তাঁরা ত্রাণ নয়, দাবি করছে পুনর্বাসনের । কারণ, দুর্গতদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের । শ্রমিক কিংবা প্রান্তিক কৃষক । তাদের পক্ষে জমি কিনে ঘর বাঁধা সম্ভব নয় । ফলে যতদিন না সরকারিভাবে তাঁদের ঘর বাঁধার জন্য জায়গা দেওয়া হবে, ততদিন তাদের অস্থায়ী আস্তানাই ভরসা । আজও গঙ্গার জলে পাক ধরে রয়েছে । তবে কিনারা থেকে কিছুটা দূরে সেই পাক দেখা যাচ্ছে । কখন পাক নদীর তীরে এসে লাগবে, সেই আশঙ্কাই এখন তাড়া করে বেড়াচ্ছে এলাকাবাসীকে । তাই আজও অনেকে নিজেদের পাকা দালান ভাঙছে । এর মধ্যে অনেক বাড়ির কিছুটা অংশ গতকালই নদীতে ধসে পড়েছে । যদিও আজ দুপুর পর্যন্ত প্রশাসনের কাউকে এলাকায় দেখা যায়নি । দেখা যায়নি ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের কাউকেও । এখনও সেখানে শুরু হয়নি পাড় বাঁচানোর কাজ ।

আজ সকাল থেকেই গঙ্গাপাড়ে ভিড় জমিয়েছিল এলাকার মানুষজন । সবার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ । গতকালের স্মৃতি ভুলতে যে অনেক সময় লাগবে, তা স্পষ্ট । তেমনই একজন কিরণ মণ্ডল বলেন, "গতকাল আমার বাড়ি নদীতে তলিয়ে গিয়েছে। সেই সময় বাড়িতে দুই ছেলে আর আমি ছিলাম । ছেলেরা শ্রমিক । এখনও পর্যন্ত কোনও ত্রাণ পাইনি । কেউ আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি । বাড়িতে একটা ছেঁড়া ত্রিপল ছিল । সেটা নিয়েই কোনওমতে থাকছি । তবে গতকাল রাতে স্কুলে শুকনো কিছু খাবার দিয়েছিল । সেটা খেয়েছি । বাড়ি হারিয়ে আমরা কোথায় যাব, জানি না । আমরা চাই, সরকার যেন আমাদের মতো গরিব মানুষকে একটা বাড়ি বানিয়ে দেয় । কারণ, জায়গা কিনে বাড়ি তৈরির ক্ষমতা আমাদের নেই ।"

আরেক দুর্গত সনকা রবিদাস বলেন, "আমি দাই মা । গতকাল এক প্রসূতিকে নিয়ে হাসপাতাল গিয়েছিলাম । সেই সময় গঙ্গার ভাঙনে বাড়ি তলিয়ে যায় । আমি সেকথা জানতাম না । গ্রামে ফিরে দেখি, আমার বাড়ি নেই । গ্রামের ছেলেরাই বাড়ির জিনিসপত্র খানিকটা বাঁচিয়েছে । এখন একটা বাগানে রয়েছি । আমার স্বামী বিড়ি বাঁধে । গতকাল সেও ঘরে ছিল না । আমাদের কিছুই নেই । কয়েকদিন আগে যখন চিনাবাজারে ভাঙন শুরু হয়, তখন আমরা নিজেরাই ঘর ভাঙতে শুরু করেছিলাম । সেই সময় প্রশাসন থেকে আমাদের কিছু ত্রাণ দিয়েছিল । সেগুলিও গতকাল নদীতে তলিয়ে গিয়েছে । তবে গতকাল স্কুলে খানিকটা চিঁড়ে দিয়েছিল । সেটা খেয়েই রয়েছি । আমরা ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, তারা যেন নদীর পাড় ঠিকমতো বেঁধে দেয় ।"

গঙ্গার গ্রাসে ভিটে মাটি, পেটে নেই খাবার, পুনর্বাসনের আশায় কালিয়াচকের মানুষ

বালুগ্রামের সাহিদুর রহমান বলেন, "গতকাল থেকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে । কেউ কোথাও থাকতে পারছে না । প্রায় সবাই বৃষ্টিতে ভিজছে । সারারাত বৃষ্টিতে ভিজেছি । চারিদিকে কান্নার আওয়াজ । গতকাল নদী ঘর গিলে নিয়েছে। এখন কোথায় থাকব ? কে আমাদের আশ্রয় দেবে ? কেউ খাবার পর্যন্ত দিচ্ছে না । গতকাল থেকে না খেয়ে আছি । আমরা চাষি মানুষ । খেটে খাই । প্রশাসনের কাছে আমাদের আর্জি, আমাদের খাবার আর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক । লকডাউনে কিছু করতে পারছি না । আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই ।"

মহরা বেওয়া বলেন, "ভাঙনে বাড়ি আর নেই। বাড়িতে আটটা বড় ঘর, একটা ছোট ঘর ছিল । সব এখন গঙ্গায় । স্বামী বছর ছয়েক আগে মারা গিয়েছে । চার ছেলে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাত । এখন ওরা কী করবে বুঝতে পারছি না । এক মেয়ের বিয়ে দেওয়া এখনও বাকি । সব হারিয়ে কী করব জানি না । কোথাও আশ্রয় নেই, কিছুই নেই । এখন বাগানে ত্রিপল টাঙিয়ে থাকছি । কিন্তু সেটা ক'দিন । একটা ত্রিপল ছাড়া এখনও সরকারি কোনও সাহায্য পাইনি ।"

গৃহহীন আবদুল করিম বলেন, "প্রশাসন বলছে, নদীর ধারে যাদের পুরো বাড়ি গঙ্গায় তলিয়ে যায়নি, তাঁদের সরকারি জমির পাট্টা দেওয়া হবে না । কিন্তু গতকাল অনেক বাড়ির একাংশ নদীতে তলিয়ে গিয়েছে । অনেকের বাড়ি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে । তাঁরা বাড়ি ভেঙে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে । কারণ সেই বাড়িতে বসবাস করা কিছুতেই সম্ভব নয় । এবার চার দফার গঙ্গা ভাঙনে প্রায় 300 বাড়ি নদীতে পড়ে গিয়েছে । অন্তত 500 বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত । তার মধ্যে মাত্র 71 জনের নাম পাট্টার তালিকায় রয়েছে । আমি চাই, নদীর জন্য যাদের গৃহহীন হতে হয়েছে, তাদের সবাইকে পাট্টা দেওয়া হোক।"

নদীতে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে আজ নিজের বাড়ি ভেঙে সরানোর কাজ করছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য হারুন আল রশিদও । তিনি বলেন, "আমি মুন্নাটোলা সংসদের সদস্য । আমার সংসদ এলাকার চিনাবাজার ও বালুগ্রামে এবার গঙ্গা ভাঙন হয়েছে । এই মরশুমে চারবার ভাঙন হল এখানে । গতকালের ভাঙনে শতাধিক বাড়ি তলিয়ে গিয়েছে । মোট তলিয়ে গিয়েছে প্রায় 250 বাড়ি । আমি গৃহহীনদের তালিকা প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছি । তার মধ্যে গতকাল আমার বুথের 32 জনকে পাট্টা দেওয়া হয়েছে । দুর্গারামটোলা বুথের 32 জনও পাট্টা পেয়েছে । গঙ্গা আমার বাড়িকেও বিপন্ন করেছে । তাই ঘর সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করেছি । 2016 সালে এই এলাকার সরকারপাড়ায় প্রথম গঙ্গা ভাঙন দেখা দেয় । চার বছর পর এবার ফের গঙ্গা এখানে তাণ্ডব চালাল ।"

পঞ্চায়েত সদস্য আরও বলেন, "আমি ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে পূনর্বাসনের জমি দেওয়ার জন্য BDO-কে জানিয়েছি । তিনি জানিয়েছেন, যাদের বাড়ি ইতিমধ্যে নদীতে তলিয়ে গিয়েছে, আগে তাদের পাট্টা দেওয়া হবে । পরে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে সেই সাহায্য করা হবে । তিনি ইতিমধ্যে আমার সংসদের জন্য 176টি ডিজ়াস্টার কিট পাঠিয়েছেন । সেসব বিলি করে দেওয়া হয়েছে ।"

আজ কালিয়াচক তিন নম্বরের BDO গৌতম দত্তের দেখা পাওয়া যায়নি । তিনি জানিয়েছেন, "ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের নামের একটি তালিকা জমা পড়েছে । গতকাল আমরা কিছু দুর্গতকে সরকারি জমির পাট্টা দিয়েছি । তবে এই মুহূর্তে আর কোনও জমির খোঁজ মিলছে না । জমি দেখা হচ্ছে । নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যেককেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে ।"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.