নিউজ কো-অর্ডিনেটর দীপঙ্কর দার (দীপঙ্কর বসু) হোয়াটস অ্যাপটা এক লহমায় যেন সব কিছু স্থবির করে দিল । মুহূর্তে যেন বেশ কয়েক বছরের পুরনো একটা স্মৃতি উষ্কে দিল ।
সে দিন আনন্দবাজার ডিজিটালে একটি খবর নিয়ে সব সহকর্মীরা আনন্দিত । খুব ভাল রেসপন্স পাঠকের । আর সেই খবরটা পড়ে খুব রেগে গিয়েছিলেন আমার সম্পাদক ।
ভিন রাজ্যের খবর । সাধারণ খবর । একটা বাচ্চা মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছে তার বাবা । আকছার এমন খবর কাগজ-পোর্টাল খুললে পাওয়া যায় । কোথায় ভুল কেউ বুঝে উঠতে পারেননি সে দিন ।
আসলে, গোটা খবরে মেয়েটার মায়ের কোনও কথা ছিল না ।
সে দিন মেয়েটার মায়ের বয়ানে পুরো খবরটা পাল্টে গিয়েছিল ।
যেটা আর পাঁচ জনের নজর খুব সহজেই এড়িয়ে গিয়েছিল । নজর এড়ায়নি সেই মানুষটার । হ্যাঁ, এটাই অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় । অতি সাধারণ খবরকে অসাধারণ করার ক্ষমতা ছিল যে তাঁর । ভাল লেখা হলে টেবিল চাপড়ে, হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানানোর হৃদয় তাঁর মতো সত্যিই খুব কম মানুষের মধ্যে আছে ।
বাংলা সাংবাদিকতার জগতে একটা নাম চিরতরে খোদাই হয়ে গেল । কথা না বলার দেশে চলে গেলেন অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় । সকলের প্রিয় অঞ্জন দা । করোনার সঙ্গে লড়াই করলেন প্রায় 32 দিন ধরে । মাঝে কিছুটা ভাল হয়েছিলেন । বাড়ি ফিরেছিলেন । কিন্তু, মাত্র তিন দিন । আবার জ্বর । আবার হাসপাতালে । ক্রমেই অবস্থার অবনতি । প্রথমে ভেন্টিলেশন । আরও অবনতি । তার পর একমো সাপোর্ট । ততক্ষণ ফুসফুসে সংক্রমণ মারাত্মক আকার নিয়েছে । প্রতি নিয়ত অবস্থার অবনতি ।
অবশেষে সব লড়াইয়ের সমাপ্তি । রবিবার রাত 9.25 মিনিটে প্রয়াত হলেন অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় । বয়স হয়েছিল 56 বছর । ফেসবুক-সহ সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক প্রকাশ করেছেন অগুণিত প্রিয় জন । শোক জানিয়েছে কলকাতা প্রেস ক্লাব । অঞ্জন দার এক জন গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে শোক জানিয়েছেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন । শোক প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর । মুখ্যমন্ত্রী তাঁর শোক বার্তায় প্রয়াত সাংবাদিকের পরিবার-বন্ধু-আত্মীয়দের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন । মা, স্ত্রী অদিতি, মেয়ে তিতলি এবং বড় ভাই তথা রাজ্যের মুখ্য সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ।
বর্ধমানের ছেলে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্কুল জীবন কেটেছে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে । তার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর । উভয় পরীক্ষাতেই প্রথম বিভাগে প্রথম । বাংলা ভাষাটা অবলিলায় বলতে পারতেন । লিখতেন সিংহের ক্ষিপ্রতায় । সাংবাদিকতার হাতে খড়ি আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে । কলকাতার পাশাপাশি কাজ করেছেন দিল্লি, পটনা, ত্রিপুরাতেও । আনন্দবাজার থেকে যোগ দিয়েছিলেন ইটিভি বাংলায় । 2000 সালে তার পরিকল্পনায় একের পর এক হিট শো ইটিভি উপহার দিয়েছিল বাংলার মানুষকে । 'কলকাতা কলকাতা'- র মতো মেগা হিট শো শুরু হয়েছিল তাঁর পরিকল্পনাতেই । যে তিন জন সাংবাদিককে সামনে রেখে সে দিন ইটিভি বাংলা পথ চলা শুরু করেছিল, তার মধ্যে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অন্যতম । ইটিভি বাংলার নিউজ বিভাগের দায়িত্ব ছাড়ার পর পর্যায় ক্রমে আকাশ বাংলা, 24 ঘণ্টা, আনন্দবাজার ডিজিটাল, টিভি নাইন হয়ে ফের যোগ দিয়েছিলেন 24 ঘণ্টায় । একাধিক সংস্থায় একাধিক উচ্চ পদের দায়িত্ব সামলেছেন । দেশের নানা প্রান্তের পাশাপাশি বাংলাদেশ, পাকিস্তান থেকে শুরু করে একাধিক দেশে সফর করেছেন । মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো খবর করেছেন ।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি সঞ্চালনা । সব কিছুতেই একটা অভিনবত্ব আনা ছিল তাঁর নেশা । অনুষ্ঠান সঞ্চালনা একজন সাংবাদিকের কাজ, বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি । বিধানসভা ভোটের প্রাক্ মুহূর্তে 24 ঘণ্টায় ফিরে গিয়ে একাধিক জেলা সফর করেছেন । করোনা- লকডাউন উপেক্ষা করতে নিত্য দিন বাড়ি থেকে বের হয়েছেন । অফিস করেছেন ।
প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও কোনও ফোন বা হোয়াটস অ্যাপ করলেই তার উত্তর দিয়েছেন ।
এপ্রিল মাসের 8-9 তারিখ । বিশেষ একটি দরকারে কথা হচ্ছিল । কথার ফাঁকে জানালেন ভ্যাকসিন নেওয়া হয়নি । কাজের চাপে । খবরের চাপে । ঠিক ছিল 11 এপ্রিলের পর একদিন নেবেন । কিন্তু, তখনই শরীরটা খারাপ হতে শুরু করেছিল । জ্বর বাড়তে থাকল । তত দিনে কোভিড পজিটিভ । 14 এপ্রিল বাইপাসের ধারে এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেন । হাসপাতাল থেকেও হোয়াটস অ্যাপে কথা হয়েছে । একটু ভাল হয়ে বাড়িও ফিরেছিলেন ।
কিন্তু, না ...
ফের জ্বর এল । আবার ভর্তি হলেন । শুরু হল আর একবার লড়াই । 33 বছর যে মানুষটা একের পর এক শৃঙ্গ জয় করেছিলেন, এবার তিনি ব্যর্থ হলেন । আর ভ্যাকসিন নেওয়া হল না । রোহিত বসু, অভীক দত্ত, সঞ্জয় সিংহ আর এবার অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় । করোনা একে একে কেড়ে নিচ্ছে বাংলা সংবাদ জগতের উজ্জ্বল মেধা গুলোকে ।
আর বোধ হয় কেউ নবীন সাংবাদিকদের ইন্টারভিউতে জিজ্ঞাসা করবেন না, তুমি মাধ্যমিকে কত পেয়েছিলে...
এই মানুষটা বিশ্বাস করতেন, মাধ্যমিকই বুঝিয়ে দেয় ছাত্রটা আসলে কেমন...