কলকাতা, 4 নভেম্বর: ইংরাজিতে একটি কথা আছে- নো বডি রিমামেবার্স দ্য সেকেন্ড ৷ মানে দ্বিতীয়কে কেউ মনে রাখে না ৷ কিন্তু ঘটনা হল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও কেউ মনে রাখতে চায় না ৷ তাঁদের দুঃখ, কষ্ট নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই ৷ তাঁদের থাকা না-থাকা কারও কাছে প্রাধান্য পায় না ৷ অথচ খোদ অর্জুনকেও বৃহন্নলার ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল ৷ বিরাট রাজার মৎস্য রাজ্যে এক বছরের জন্য অজ্ঞাতবাসে থাকতে হয়েছিল পঞ্চপাণ্ডবকে। অজ্ঞাতবাসে বৃহন্নলার ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন অর্জুন। ওই অবস্থায় রাজকন্যা উত্তরাকে নাচ-গান শিখিয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়, উর্বশীর অভিশাপে অর্জুনকে এক বছরের জন্য বৃহন্নলা রূপে থাকতে হয়েছিল। তবে ছদ্মবেশই হোক বা অভিশাপ তার মেয়াদ ছিল মাত্র এক বছর। এবার এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের যন্ত্রণা নিয়ে তৈরি হল 'অর্ধনারীশ্বর' নামে একটি তথ্যচিত্র ৷
বাস্তবটা খানিক আলাদা ৷ আমাদের সমাজে এমন বহু বৃহন্নলা আছেন, যাঁদের সারাজীবন কেটে যায় লড়াই করতে করতে। আইন তাঁদের স্বীকৃতি দিলেও সমাজে এখনও তাঁরা অপাংক্তেয়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা আইনি স্বীকৃতি পেলেও সামাজিক স্বীকৃতি পাননি। তাই আইন পথ বাতলে দিলেও সেই পথ এখনও বন্ধুর। প্রতি পদে লড়াই। এমনই এক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রূপান্তরকামী তথা সমাজকর্মী শ্রীগৌরী সবন্তের জীবনী নিয়ে তৈরি হয়েছে হিন্দি ছবি 'তালি'। ইতিমধ্যেই ছবিটি সারা দেশে চর্চিত এবং প্রসংশিত হয়েছে। এবার সেই একই উদ্যোগ নেওয়া হল বাংলাতেও ৷ তৈরি হল এক বিশেষ তথ্যচিত্র 'অর্ধনারীশ্বর' ৷
এই তথ্যচিত্রে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জীবন-সংগ্রামের কথা তুলে ধরা হয়েছে ৷ এখানে থাকছে বাংলার একাংশ রূপান্তরকামীদের কথা ৷ পাশাপাশি উঠে আসবে তাঁদের আয়োজনে হওয়া দুর্গাপুজোর কথাও। এই তথ্যচিত্র পরিচালনা করেছেন মুন সাহা ও অতনু রায়। প্রায় 50 মিনিটের এই তথ্যচিত্রের মূল উপপাদ্য হল, পুজোর ভাবনা ও সৃজনশীলতার সন্ধান ৷ এই পুজোর আয়োজন করা ঠিক কতটা কঠিন, সেকথাও তুলে ধরা হয়েছে ৷ এছাড়াও সমাজের এই বিশেষ অংশের মানুষকে প্রতিদিন কী কী সহ্য করতে হয় তাও থাকছে ৷ সদ্য শেষ হয়েছে শুটিং।
মুন সাহা জানান, "বহু বছর ধরে আমি এই কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করছি ৷ খুব কাছ থেকে আমি এঁদের প্রতিদিনের লড়াইটা দেখেছি। সুস্মিতা সেনের 'তালি' ছবি মুক্তির আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল এমন একটা কাজ করার ৷ আমি এঁদের জীবন থেকে শুরু করে উৎসব এবং লড়াই চিত্রনাট্য আকারে লিপিবদ্ধ করেছি। তার মধ্যে অবশ্যই থাকছে দুর্গাপুজো। তবে একটা তালি বা একটা অর্ধনারীশ্বর তথ্যচিত্র সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারবে না। এরকম অসংখ্য তালির আওয়াজের প্রয়োজন।" এই বছর 'অর্ধনারীশ্বর দুর্গাপুজো'র ষষ্ঠ বছর। তবে এই পুজোর সূচনাটা খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না।'
আরও পড়ুন: নির্দিষ্ট কোটায় সংরক্ষণের সুবিধা পেতে পারে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, সুপ্রিম কোর্টে জানাল কেন্দ্র
অর্ধনারীশ্বর দুর্গাপুজো কোন ধরনের পুজো তা নিয়ে একাধিক তীর্যক মন্তব্য শুনতে হয়েছিল বলে জানালেন উদ্যোক্তা ও মেম্বার অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড-এর প্রাক্তন সদস্য রঞ্জিতা সিনহা। তিনি বলেন, "আলাদা করে এই পুজোর প্রয়োজন ছিল না। তবে অন্যান্য দুর্গা মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে গেলে বারবার কটাক্ষ ও বৈষম্যের শিকার হতে হয় এইসব মানুষদের। তাই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মত অর্ধেক পুরুষ ও অর্ধেক নারী রূপে মা দুর্গার পুজো করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আজ থেকে 6 বছর আগে প্রথম এই পুজোটা করার সময় আমাদের একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রথমে এই পুজোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। পুলিশের তরফেও সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছিল। বাকি পুজোগুলি সরকারি অনুদান পেলেও আমরা আজও তা পায়নি। সমাজ আমাদের পাশে থাকেনি বলে প্যান্ডেল তৈরি করা থেকে শুরু করে মূর্তি তৈরি সবেতেই আমাদের প্রতি ইঞ্চি জমির জন্য লড়াই করতে হয়েছে।" তিনি আরও বলেন, "আমাদের লড়াই চলবে। জানি পথ খুব একটা সুগম হবে না। তবে এই তথ্যচিত্রতে ধরা থাকবে আমাদের লড়াই। সমাজের আর পাঁচটা মানুষের মতো সাধারণ জীবনযাপন করার অসাধারণ গল্প।"
কথিত আছে, অযোধ্যা ছেড়ে বনবাসের পথে গিয়েছিলেন রামচন্দ্র। সঙ্গী হয়েছিলেন স্ত্রী সীতা এবং ভাই লক্ষণ। অযোধ্যাবাসী তাঁদের বিদায় জানাতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। আবেগতাড়িত হয়েছিলেন খোদ মর্যাদা পুরুষোত্তম। অবশেষে মন শক্ত করে আদেশ দিলেন সমস্ত নর এবং নারীকে ফিরে যেতে। আদেশ পালন করলেন ওঁরা। বনবাস কাটিয়ে 14 বছর পর রামচন্দ্র ফেরেন অযোধ্যায়।
ফিরতি পথে অবাক হয়ে দেখলেন কিছু মানুষ নদীর কাছে দাঁড়িয়ে। তাঁদের দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলেন। প্রত্যুত্তরে অপেক্ষারত সেই মানুষগুলো বলে উঠেলন, ভগবান রাম নর এবং নারীকে ফিরে যেতে বলেছিলেন। তাই তাঁরা ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু অর্ধনারীশ্বরদের জন্য কোনও কথা বলেননি ভগবান। তাঁদের ফিরে যাওয়া হয়নি ৷ এখন নাকি সেই রাম নেই ৷ তাই সেই অযোধ্যাও নেই ৷ তবে আছেন অর্ধনারীশ্বররা ৷ আছে তাঁদের অন্তহীন অপেক্ষাও ৷ চাহিদা একটাই, মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার ৷ প্রশ্নটা সহজ নয় বলে উত্তরও জানা নেই কারও !
আরও পড়ুন : মা অর্ধনারীশ্বর, পৌরহিত্যে রূপান্তরকামী! তিলোত্তমার বুকে এক অন্যরকম দুর্গাবন্দনা