কলকাতা, 20 অক্টোবর: কল্লোলিনী তিলোত্তমার পরতে পরতে ইতিহাস ৷ কেউ কেউ বলেন, সেই ইতিহাসের সূত্রপাত নাকি কালীতীর্থ কালীঘাট থেকে ! ঐতিহাসিকদের একাংশের দাবি, এই কলকাতার ইতিহাস এবং নামকরণের সঙ্গে কালীঘাটের এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে ৷ বলা বাহুল্য, হিন্দুদের তীর্থক্ষেত্রগুলির কালীঘাট মন্দির (Kalighat Temple) অন্যতম ৷ কথিত আছে, সতীর ডানপায়ের আঙুল পড়েছিল এই পীঠে ! দক্ষিণেশ্বর থেকে বহুলা (বর্তমানে বেহালা) অবধি ধনুকাকার স্থানই কালীক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত ৷ এই ত্রিকোণাকৃতি স্থানের তিনকোণে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর বিরাজমান ৷ এবং এই ত্রিকোণের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং দেবী কালী ৷
গুপ্ত রাজারা কালীঘাটকে পুণ্যস্থান হিসাবে বিবেচনা করতেন ৷ তাঁদের বংশের মুদ্রাও পাওয়া গিয়েছে এই কালীঘাটে ৷ কিন্তু তা বলে এটা প্রমাণিত হয় না যে গুপ্তযুগে কালীঘাট কোনও জনপদ ছিল ৷ তাছাড়া, দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বল্লাল সেনের রাজত্বকালে বহু সাধারণ মানুষ কালীক্ষেত্রে গঙ্গাস্নানে আসতেন ৷ পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দিল্লির পাঠান রাজত্বের সময় কালীঘাটের কাছে মানুষজনের বসবাসের ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ তৎকালীন সময়ে ভৈরবী, কাপালিকরা নরবলি দিয়ে দেবীর পুজো করতেন ! তবে চৈতন্য ভাগবত কিংবা চরিতামৃতে কলকাতার উত্তরে পানিহাটি এবং কালীঘাটের দক্ষিণে কয়েকটি গ্রামের কথা উল্লেখ থাকলেও কালীঘাটের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না ৷ কিন্তু, মুঘল শাসনকালে 'আইন-ই-আকবরি' গ্রন্থে সাতগাঁর 'কালীকোটা' নামক স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায় ৷ তাই ঐতিহাসিক যুক্তিতে আবুল ফজল যে কালীঘাটকে উল্লেখ করেছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না ৷
আবার ইউরোপীয়দের কথায়, ফজলের 'কালীকোটা' শব্দে 'ঈ' কার লোপ পেয়ে কালক্রমে তা 'কালকোটা' ও পরবর্তীকালে 'কালকট্টা' হয়েছে ৷ এরপরই দেশীয় ব্যবসায়ীগণ 'কালীকোটা' শব্দটিকে 'কলিকাতা' করেছেন বলে মত একাংশের ৷ উল্লেখ্য, 1786 সালে মিসেস কিণ্ডারলির লেখা চিঠিতে কালীঘাটের তদানীন্তন অবস্থার কথা জানা যায় ৷ এমনকী, ইংরেজ কুঠীর অধ্যক্ষ হলওয়েল সাহেব 1752 সালের এক রিপোর্টে লেখেন, "চৌরঙ্গী রোড দিয়ে দক্ষিণাভিমুখে গমন করিলে কালীঘাট যাওয়া যায় ৷"
আরও পড়ুন: 108টি নরমুণ্ড উৎসর্গ করা হয় দেবীকে, কালীপুজোর রাতে জেগে ওঠে দক্ষিণ বিষ্ণুপুর শ্মশান
এখন প্রশ্ন হল, তা হলে কালীঘাটের কালীমূর্তির প্রতিষ্ঠাতা কে ? বলা বাহুল্য, এই নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে ৷ নানা গল্পও রয়েছে ৷ কেউ কেউ মনে করেন, কালীঘাটের কাছেই এক ব্রাহ্মণ তপস্যা করেছিলেন এবং তপস্যা চলাকালীন কালীকুণ্ডের জলে এক আলোকজ্যোতি দেখতে পান তিনি ৷ তখনই ওই ব্রাহ্মণ সতীর দেহাংশ উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করেন ৷ ইতিহাসবিদদের মতে, সস্ত্রীক জিয়া গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বংশের কূলদেবী মা দক্ষিণকালীর তপস্যায় কালীঘাটে আসেন ৷ সেই সময় তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতীদেবী দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে কালীকুণ্ডের জলে সতীর অংশের সন্ধান পান এবং আত্মারাম ব্রহ্মচারী সেই অংশ স্নানপূর্ণিমার দিন প্রতিষ্ঠা করেন ৷ জিয়া পরবর্তীকালে আত্মারামের থেকেই দীক্ষা নেন এবং তাঁর পুত্র লক্ষ্মীকান্তকে কালীঘাটে রেখে তিনি সন্ন্যাসগ্রহণ করেন ৷ আবার অনেকের মতে, বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পরিবারের সদস্য সন্তোষ রায়চৌধুরী ভাগীরথী নদী দিয়ে নৌকায় যেতে যেতে শঙ্খের শব্দ শুনতে পান এবং সেই অরণ্যে প্রবেশ করে দেবীর দর্শন লাভ করেন ৷ সেই থেকেই জনসাধারণের মধ্যে কালীঘাটের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে ৷
কথিত আছে, ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে যশোরের রাজা বসন্ত রায় দেবীর মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন ৷ তার আগে এই কালীমূর্তি পর্ণ কুটীরে ছিল ৷ আবার প্রচলিত ইতিহাস বলছে, সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের তরফে কালীঘাটের জঙ্গল পরিষ্কার করা হয় ৷ সেখানেই মন্দির নির্মাণ করা হয় এবং দেবীর সেবার জন্য 194 একর জমি দান করেন তাঁরা ৷ চণ্ডীবরকে কালীর সেবার জন্য নিয়োগ করা হয় এবং কালীর বর্তমান সেবায়েত হালদারগণ এই চণ্ডীবরেরই উত্তরসূরী ৷
আরও ঐতিহাসিক নির্দশন থেকে জানা যায়, কেশবরাম রায়চৌধুরী কালীর সেবার জন্য ইমারত নির্মাণ করেন ৷ তিনিই মনোহর ঘোষালকে সেবার জন্য নিযুক্ত করেন ৷ বর্তমানে হালদারগণ মনোহরের দৌহিত্র বংশ হিসাবে পরিচিত ৷ পরবর্তীকালে কেশবের চতুর্থ পুত্র সন্তোষ রায়চৌধুরী ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাজীবলোচন রায়চৌধুরী 1809 সালে কালীঘাটের বর্তমান মন্দির নির্মাণ করেন ৷ 1802 সালের ঐতিহাসিক নিদর্শনে দেখা যায় সন্তোষ রায়চৌধুরী কালীর সেবয়েত গোকুলচন্দ্র হালদার এবং তাঁদের বংশের অনেককেই বিস্তর জমি দান করেছিলেন ৷ মন্দিরের চারদিকে 55।4।0 বিঘা জমি কালীর দেবত্র সম্পত্তি হিসাবেই পরিচিত ৷ পঞ্চান্ন গ্রামের খাসপুর পরগণার অন্তর্গত 6 সংখ্যক গ্রান্ড ডিভিশনের ই.এফ.এম.পি.কিউ সাবডিভিশনে এই জমির উল্লেখ আছে ৷ মন্দিরের পূর্ব দিকে রয়েছে 10 কাঠা আয়তনে রয়েছে কালীকুণ্ড ৷ এই কুণ্ডের দক্ষিণ ও পূর্বদিকে হালদারদের ইমারত দেখা যায় ৷ দেবীর জন্য খিদিরপুরের দেওয়ান গোকুলচন্দ্র ঘোষাল চারটি রুপোর হাত নির্মাণ করে দেন ৷ পরবর্তীকালে কলকাতার বাবু কালীচরণ মল্লিক চারটি সোনার হাত প্রদান করেন ৷ চার হাতের কঙ্কন দেন কালীমোহনের পিতামহ রামজয় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাথার মুকুটটি বেলেঘাটার ব্যবসায়ী রামনারায়ণ সরকার প্রদান করেন ৷
কালীঘাটের পশ্চিম দিকে শ্যামরাই মন্দির ৷ অতীতে এই শ্যামরাই কালীর মন্দিরেই থাকতেন ৷ 1723 সালে মুর্শিদাবাদের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি শ্যামের জন্য ছোট ঘর তৈরি করে দেন এবং পরবর্তীকালে 1843 সালে বাওয়ালির জমিদার উদয়নারায়ণ মণ্ডল শ্যামের বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেন ৷ পঞ্জাবের ব্যবসায়ী তারা সিংহ 1858 সালে নকুলেশ্বরের মন্দির নির্মাণ করে দেন।
(তথ্য সহায়তা: শুভদীপ রায়চৌধুরী, আঞ্চলিক গবেষক তথা সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশের ৩৬তম বংশধর)