কলকাতা, 12 নভেম্বর : পশ্চিমবঙ্গের পরিবহন মন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শুভেন্দু অধিকারীর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিকল্পনা কী? তিনি যদি শেষ পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে অন্য কোনও রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন, তাহলে আর কে কে যাবেন তাঁর সঙ্গে? এই প্রশ্নগুলোই আজকাল ঘোরাফেরা করছে রাজনৈতিক মহলে । গত কয়েক দিন ধরে চলা ঘটনাবলী থেকে রাজনৈতিক মহলের এই ধারণা হয়েছে শুভেন্দুর তৃণমূলের সঙ্গত্যাগ এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা । প্রথমে গত মঙ্গলবার নন্দীগ্রামের সভায় তাঁর বিস্ফোরক ভাষণ এবং একবারের জন্যও দলনেত্রী, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নাম না নেওয়া । ‘‘ভারতমাতা জিন্দাবাদ’’ শোনা যায় তাঁর মুখে । তারপর বুধবারে নবান্নে মন্ত্রিসভার বৈঠকে গরহাজির থাকলেন শুভেন্দু সহ চার মন্ত্রী ৷
অন্য তিনজন গরহাজির মন্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, (যিনি শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত) গৌতম দেব ও রবীন্দ্রনাথ ঘোষ । কোরোনা-আক্রান্ত হওয়ার কারণে আসতে পারেননি গৌতম দেব । এবং রবীন্দ্রনাথ ঘোষও জানান যে শারীরিক অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি তিনি । কিন্তু এই অনুপস্থিতির কারণ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন শুভেন্দু ৷ রাজীব বন্দ্যোপাধ্য়ায় ETV ভারতকে বলেন, "আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ থাকার জন্য বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারিনি । আর তাছাড়া এ বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না ।" তাই শুভেন্দু-রাজীবের গরহাজিরা নিয়ে তীব্রতর হচ্ছে রাজনৈতিক জল্পনা । শুভেন্দুর এবং রাজীবের অনুপস্থিতি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বও । রাজ্য বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক, তাপস রায়ের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি ETV ভারতকে জানান যে, ব্যাপারটা যেহেতু খুবই স্পর্শকাতর তাই এই ব্যাপারে যা বলার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ই বলবেন | এই ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী এবং তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও ।
এর মধ্যে শুভেন্দুকে নিয়ে জল্পনা আরও বেড়ে যায় BJP নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়র একটি মন্তব্যে । তিনি বলেন, "তৃণমূলের অনেক শীর্ষ নেতাই BJP-তে যোগ দিতে চান, কিন্তু সন্ত্রাসের রাজত্বের জন্য পারেননি ৷ কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, আমরা তা নিয়ে আলোচনা করব ৷’’ এদিকে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের পালটা প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্বও | ইতিমধ্যেই শুভেন্দুঘনিষ্ঠ বেশ কিছু জেলাস্তরের তৃণমূল নেতার নিরাপত্তারক্ষী প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে । তবে শুভেন্দুকে নিয়ে এই টানাপড়েন নিয়ে তৃণমূলকে রীতিমতো টার্গেট করে মাঠে নেমেছেন বাম এবং কংগ্রেস । তাদের কথায় দল ভাঙানোর খেলাতেই শেষ হয়ে গেল শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস । কড়া ভাষায় শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি ।
দল ভাঙানোর প্রক্রিয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে বলে মন্তব্য করেন অধীর চৌধুরি | তিনি বলেন, "ক্ষমতার দম্ভে বিরোধী দল থেকে বিধায়কদের নিয়ে নিচ্ছিল তৃণমূল কংগ্রেস । এবার তাদেরই ঘর ভাঙার পালা । কংগ্রেস দলটির অস্তিত্ব থাকবে, তৃণমূল কংগ্রেস একদিন ইতিহাসে পরিণত হবে| যেভাবে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী এবং বিধায়করা BJP-তে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলে যোগদান করছে তা দেখে মনে হচ্ছে আগামী দিনে তৃণমূল বলে কোনও দল এরাজ্যে থাকবে না । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লোকের ঘর ভাঙছিলেন এতদিন । এবার তাঁর ঘর ভাঙার পালা । আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের সব কটি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী খুঁজে পাবে না তৃণমূল কংগ্রেস । নতুন বছরের গোড়াতেই শাসক দলের বহু মন্ত্রী এবং বিধায়ক দল ছাড়বেন ৷’’
রাজ্য সরকারের ক্যাবিনেট বৈঠকে উল্লেখযোগ্যভাবে শাসকদলের বিধায়ক মন্ত্রীদের-অনুপস্থিতির বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন রাজ্য বিধানসভায় বাম পরিষদীয় দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী । তিনি জানান, "এটাই সত্যি । একসময় বিরোধীদলের বিধায়কদের ভাঙাচ্ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । তৃণমূল কংগ্রেসের নীতি আদর্শের বালাই নেই । সুবিধা বুঝে কেটে পড়ছে দলের মন্ত্রী বিধায়করা । মুখ্যমন্ত্রীর সাধের কাননে সব ফুল শুকিয়ে গিয়েছে । তৃণমূলটা খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে ৷’’ বিধানসভা নির্বাচনে বাম কংগ্রেসের জোট আশানুরূপ ফল করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি ।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমলকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘‘গণতন্ত্রের বিচিত্র বৈশিষ্ট্য এমন দল ভাঙানো জনপ্রতিনিধিরা এভাবে দলবদল করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দলটি সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে । বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয় সংশ্লিষ্ট দলগুলির । কী কারণে দল ছাড়ছেন শাসকদলের বিধায়ক মন্ত্রীরা তা স্পষ্ট নয় । পশ্চিমবঙ্গে এমন সংস্কৃতি অতীতে ছিল না । দলের প্রতি গোঁসা করে রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিয়েছেন অনেকেই । কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে শাসকদলের বহু বিধায়ক এবং মন্ত্রী দলবদল করছেন | জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন তাঁরা ।’’