গাড়ির পাঁচ নম্বর চাকাটা লাগানোর উদ্যোগ পুনরায় দেখা যাচ্ছে ৷
হ্যাঁ, অর্ধ শতাব্দী পার করে, 52 বছর পর আমাদের রাজ্যে এই উদ্যোগ ৷
ঠিক ধরেছেন ৷ এখানে বিধান পরিষদ গঠনের কথাই বলা হচ্ছে ৷
1969 সালে বিলোপ ৷ 2021-এ পুনরায় প্রবর্তন বা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ৷
পশ্চিমবঙ্গ ও পঞ্জাবে বিধান পরিষদ ছিল ৷ 1969 -এ এই দুই রাজ্যেই আইনসভার সেই কক্ষ বিলুপ্ত হয় ৷ উভয় রাজ্যেই বিধানসভা বিধান পরিষদ বিলোপের ব্যাপারে প্রস্তাব পাশ করে ৷ সেইমতো সংসদে এই ব্যাপারে আইন তৈরি হয় ৷ নাম দেওয়া হয় দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল (অ্যাবোলিশন) অ্যাক্ট, 1969 ৷ তদনুসারে পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদের অবলুপ্তি ঘটে ৷ এখন আবার একই পথ ধরে রাজ্যের আইনসভায় দ্বিতীয় কক্ষটিকে ফেরানোর চেষ্টা ৷
একই পথ মানে, 169 নম্বর ধারায় আশ্রয়গ্রহণ ৷ সংবিধানের ওই ধারায় বলা হয়েছে, প্রথমে বিধানসভায় বিধান পরিষদ লোপ বা গঠন করার ব্যাপারে প্রস্তাব আনতে হবে ৷ বিধানসভার মোট সদস্যসংখ্যার অধিকাংশ ( অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের 148 জন বিধায়ক) এবং যেদিন প্রস্তাবটি বিধানসভায় পাশ করার জন্য আনা হবে, সেদিন সভায় যতজন বিধায়ক হাজির থাকবেন ও ওই প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেবেন, তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ যদি প্রস্তাবটি পাশ করেন, তাহলে প্রস্তাবটিকে পার্লামেন্টে পাঠানো যাবে ৷ অর্থাৎ, 148 জন তৃণমূল বিধায়ক অনুমোদন করলেই বিধান পরিষদ গঠনের বিল পাশ হয়ে যাবে না ৷
এর পর আছে সংসদ পর্ব ৷ সেখানে অবশ্য বিশেষ কোনও প্যাচ পয়জার নেই ৷ সংসদের দুটি কক্ষেই -- লোকসভা ও রাজ্যসভায় প্রস্তাবটি বেশিরভাগ সাংসদের অনুমোদন পেলেই বিধান পরিষদ গঠনের প্রস্তাবে সিলমোহর পড়বে ৷ বাকি রইল কেবল রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর ৷
ব্যাপারটা যতটা সহজ ও মসৃণ বলে আপাতভাবে মনে হচ্ছে, বাস্তবে তা কিন্তু ঘটে না ৷ যদি তা ঘটত, তবে এতদিনে ওড়িশা, রাজস্থান এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য অসমে বিধান পরিষদ গঠন হয়ে যেত ৷ রাজস্থান ও অসমের বিধান পরিষদ গঠনের প্রস্তাব আটকে আছে রাজ্যসভায় ৷ গোটা দেশে এখন পাঁচটা রাজ্যে বিধান পরিষদ আছে ৷ বিহার, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, তেলাঙ্গানা আর উত্তরপ্রদেশে ৷
আর এই বিধান পরিষদ গঠন নিয়ে চরম নাটক দেখেছে তামিলনাড়ু ৷ 1986 সালে এম জি রামচন্দ্রনের জমানায় বিধান পরিষদ অবলুপ্ত হয় ৷ পরে ডিএমকে ক্ষমতায় এসে ফের বিধান পরিষদ গঠনের পক্ষে আইন পাশ করায় ৷ 2010-এ ক্ষমতাসীন হন জয়ললিতা ৷ তাঁর সরকার সে আইন প্রত্যাহারের পথে হাঁটে ৷
অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মন্ত্রিসভায় যতই বিধান পরিষদ গঠনের পক্ষে প্রস্তাব নেওয়া হোক, রাজ্য বিধানসভায় দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার সৌজন্যে সেই প্রস্তাব যতই হইহই করে পাশ হোক, সংসদের বদান্যতায় সেসব হাতে গরম ফল দেবে, তেমন আশা বড়ই কম ৷ আর এসব হতে হতে যদি বর্তমান শাসক শিবির ক্ষমতা হারায়, তবে পুরো ব্যাপারটাই বিশ বাঁও জলে চলে যাবে ৷
অনেকেই ও ব্যাপারে রাজ্যের নাম পরিবর্তন সংক্রান্ত দীর্ঘসূত্রিতার তুলনা টানছেন ৷ সঙ্গত কারণেই টানছেন ৷
26 জুলাই, 2018 ৷ রাজ্য বিধানসভায় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটা প্রস্তাব পাশ হল ৷ বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি, এই তিনটে ভাষাতেই পশ্চিমবঙ্গের বদলে রাজ্যের নাম 'বাংলা' করা হোক ৷
এর আগে এই নিয়ে টালবাহানা কম হয়নি ৷ 2011 -তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর বদলে পশ্চিমবঙ্গ নামকরণের কথা বলেন ৷ কেন্দ্র সে প্রস্তাব নাকচ করে দেয় ৷ পাঁচ বছর, 2016-তে প্রস্তাব দেওয়া হয়, ইংরেজিতে নাম হোক 'বেঙ্গল' ৷ বাংলায় 'বাংলা' আর হিন্দিতে 'বঙ্গাল' ৷ সে প্রস্তাবও কল্কে পায়নি নানা যুক্তিতে ৷ তারপর যায় এই প্রস্তাব ৷ তিনটে ভাষাতেই রাজ্যের নাম হবে 'বাংলা' ৷
আরও পড়ুন, আমি হতবাক, কল্যাণের মন্তব্যের জবাব ধনকড়ের
গত 2019 -এ রাজ্যসভার সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই সুস্পষ্টভাবে লিখিতভাবে জানান, কেন্দ্রীয় সরকার এই নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ৷
অর্থাৎ, যাবতীয় উদ্যোগ আয়োজন জলে গেল ৷ বিধান পরিষদ গঠনের ব্যাপারেও তেমনটা হতে পারে ৷ হতেই পারে ৷ হতে পারে, কারণ সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টাকে মমতা-সরকারের পক্ষে সুবিধাজনক কিন্তু রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতির বিচারে জরুরি একটি বিষয় বলে মনে করবে না ৷
মনে করবে না, তার কারণ --
(1) এ-রাজ্যে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থা বলবৎ আছে ৷ এই ব্যবস্থায় আইন পাসের তাবৎ ক্ষমতা বিধানসভার হাতেই থাকে ৷ সুতরাৎ অর্থ বিল ছাড়া অন্যান্য বিল পাসের ক্ষেত্রে বিধান পরিষদ প্রক্রিয়াটাকে বিলম্বিত করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না ৷ আর অর্থ বিলের ক্ষেত্রে তো বিধান পরিষদের কোনও ক্ষমতাই নেই ৷ সুতরাং, বিধান পরিষদ পুরো ব্যবস্থাটায় নৈবেদ্যর উপর কাঁঠালি কলা মাত্র ৷
(2) নির্বাচনে হেরেছেন এরকম ব্যক্তিকে পেছনের দরজা দিয়ে রাজ্য মন্ত্রিসভায় জায়গা করে দেওয়ার জন্যই বিধান পরিষদ ৷ অতীতে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি আছে ৷ বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন মোরারজি দেশাই আর সিবি গুপ্ত ৷ দুজনকেই যথাক্রমে বোম্বাই আর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল বিধান পরিষদের সদস্য করে নিয়ে ৷
এবারের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য শাসক দলের জনপ্রিয়তম মুখ হওয়া সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হেরেছেন ৷ বিধান পরিষদ থাকলে তাঁকে ফের উপ নির্বাচনে লড়ার দায় নিতে হত না ৷ সহজতর উপায়ে মসৃণতর পদ্ধতিতে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর আসনটি বিধিসম্মতভাবে অধিকার করতে পারতেন ৷ অমিত মিত্রের মতো ব্যক্তিত্বদেরও সহজেই উপনির্বাচনের শঙ্কা-সম্ভাবনা ব্যতিরেকেই মন্ত্রিপরিষদে ঢুকিয়ে নিতে পারতেন ৷ এর আগে রেজিনগর বিধানসভার উপনির্বাচনে রাজ্যের মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরের পর্যুদস্ত হওয়ার স্মৃতি এখনও শাসক শিবিরে দগদগে ৷ এসব বিপদ, প্রতিকূল সম্ভাবনা, অনিশ্চয়তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থাকুক, যাঁরা এটা চান, তাঁরা নিশ্চয়, নিশ্চয়ই বিধান পরিষদ গড়ার সুযোগ করে দিয়ে মমতাকে 'কমফোর্ট জ়োন' তৈরি করে দিতে চাইবেন না ৷
(3) বিধান পরিষদ গঠিত হলে সেটা হবে স্থায়ী কক্ষ ৷ সংবিধানের 171 নম্বর ধারা মোতাবেক রাজ্য বিধান পরিষদের কার্যকাল হল ছ'বছর ৷ সেক্ষেত্রে যদি এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে কী হবে ?
বিধান পরিষদের কার্যকাল ফুরোনোর আগেই রাজ্য বিধানসভার পরবর্তী নির্বাচন হয়ে গেল ৷ সেই নির্বাচনে গেরুয়া শিবির সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল ৷ 2021 -এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হল ৷ অথচ বিধান পরিষদে তৃণমূলের দাপট রয়ে গেল ৷
সেক্ষেত্রে, অবধারিতভাবে রাজনৈতিক সংঘাতের বাতাবরণ গড়ে উঠবে ৷ যে-কোনও জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিলকে কারণে-অকারণে চার মাস পর্যন্ত আটকে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে তৃণমূলীরা ৷ বিজেপি এটা হতে দিতে চাইবে ? বিশেষ করে যখন এখনও পর্যন্ত তারা রাজ্য দখলের মায়া কাজল চোখ থেকে মুছে ফেলতে পারেনি ৷
আরও পড়ুন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিধান পরিষদ ফেরানোর উদ্যোগ মুখ্যমন্ত্রীর
(4) বিধান পরিষদের গঠন কীভাবে হবে ? সেটা একটা খিচুড়ি পদ্ধতি -- সংবিধান বিশেষজ্ঞ এম ভি পাইলির ভাষায়, "A hotch potch for representation."
মোটামুটিভাবে এক তৃতীয়াংশ সদস্য নির্বাচন করবেন পুরসভা, জেলা পরিষদ ও অন্যান্য স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা ৷ এঁদের মধ্যে বিজেপির প্রতিনিধি থাকলেও বেশিরভাগ নির্বাচকই তৃণমূলের হবেন ৷ অর্থাৎ নির্বাচিত এক তৃতীয়াংশ সদস্যের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা বেশি সংখ্যায় থাকবেন ৷
এক তৃতীয়াংশ সদস্য নির্বাচিত করবেন বিধানসভার এমএলএ-রা ৷ এক্ষেত্রেও নির্বাচিত বিধান পরিষদের সদস্যরা ধারে ও ভারে রাজ্য বিজেপির সদস্যদের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে থাকবেন ৷ তৃণমূলীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবেন নিশ্চিতভাবে ৷
বারোভাগের একভাগ সদস্য নির্বাচন করবেন সেইসব স্নাতকরা যারা তিনবছর বা তার আগেই গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন ৷ শিক্ষিত বেকারের একটা বড় অংশ এইসব গ্র্যাজুয়েট ৷ এসএসসি ও টেটে দুর্নীতি, বেকারত্বের ক্রমবৃদ্ধি, কাগজে কলমে পরিসংখ্যানে না হলেও সুবিধাভোগী চাকুরিজীবী না হতে পারার সুযোগ, নানারকম স্থানীয় সামাজিক ইস্যু ইত্যাদি কারণে এঁরা তৃণমূলের প্রতি বিরূপ হতেই পারেন ৷ তা বলে যে তাঁরা বিজেপির প্রতি সহানুভূতিশীল এমনটা অন্তত সদ্য সমাপ্ত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের ফল আপাতদৃষ্টিতে বলছে না ৷ সুতরাং সেই সেক্টরেও বিজেপির জন্য বিশেষ আশাবাদী হওয়ার কারণ নেই ৷
আরও বারো ভাগের একভাগ সদস্য নির্বাচন করবেন রাজ্যের শিক্ষকরা ৷ রাজ্যের শিক্ষকরাও নানা কারণে তৃণমূলের প্রতি প্রসন্ন নন ৷ হয়ত অসন্তুষ্টও ৷ তবে তাঁরা গেরুয়া শিবিরের প্রতি ঝুঁকে আছেন, এমন ইঙ্গিত কোথাও নেই ৷ বরং স্নাতক ভোটারদের মতো শিক্ষক ভোটারদের মধ্যেও বামপন্থার প্রতি আনুগত্য এখনও পাওয়া যাবে ৷ ভালোমাত্রাতেই পাওয়া যাবে ৷ সুতরাং এই সেক্টরেও বিজেপির হাতে থাকছে পেনসিল ৷
রইল বাকি প্রায় ছয়ভাগের একভাগ সদস্য ৷ এঁদের মনোনয়ন করবেন রাজ্যপাল ৷ সেই মনোনয়নের ব্যাপারে যে আদালতের যে কোনও কিছু বলার থাকতে পারে না, সেকথা আদালতি সেই 1953 সালে জানিয়ে দিয়েছে ৷ সুতরাং জগদীপ ধনকড়ের মতো কোনও রাজ্যপাল রাজভবনে থাকলে, এই সেক্টরে অ্যাডভান্টেজ বিজেপির ৷
আরও পড়ুন, ‘বাতিল’ প্রবীণদের সম্মান দিতে বিধান পরিষদ ফেরাতে চান মমতা
তাহলে কী দাঁড়াল ?
পশ্চিমবঙ্গে বিধানপরিষদ গঠিত হলে সেটির মোট সদস্য সংখ্যা হবে 98 জন ৷ তার মধ্যে মেরে কেটে 16 থেকে 17 জন রাজ্যপালের আনুকূল্যে বিজেপি শিবিরের হতে পারেন বা হবেন ৷
বাকি 81 থেকে 82 জনের মধ্যে 50 জনই অবিজেপি হবেনই ৷ তার বেশি হওয়ার সুযোগ-সম্ভাবনা বেশি ৷
এরকম পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের শাসকদল কি এত বড় একটা ঝুঁকি নেবে ?
সুতরাং, বিধান পরিষদ গাড়ির পাঁচ নম্বর চাকা বা অপ্রয়োজনীয় অংশ এবং তাতে খরচ বাড়ে (যা এই অতিমারি পরিস্থিতিতে কাম্য নয়) এরকম সব অকাট্য যুক্তিতে বিধান পরিষদের প্রস্তাব ঠান্ডা ঘরে যাওয়াটা কেবল সময়ের অপেক্ষা ৷
তৃণমূলের অতৃপ্ত আত্মাদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য বিধান পরিষদ হচ্ছে হবে, এই গাজরটা কদিন ঝুলিয়ে রাখা যেতেই পারে ৷ তার বেশি কার্যকারিতা এই প্রস্তাবের নেই, সেকথা বলাই বাহুল্য ৷
লেখক , শিক্ষাবিদ