কলকাতা, 11 ডিসেম্বর: “তুমি গোয়েন্দাগিরি করছো, মানুষের মনের অন্ধকার দিক নিয়ে কারবার...৷” সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা গল্পে বিখ্যাত সিধু জ্যাঠা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর ফেলু মিত্তিরের প্রশংসায় এই কথাগুলো বলেছিলেন । অপরাধের বিচার বিশ্লেষণ মানেই মানুষের অন্ধকার প্রবৃত্তির উন্মোচন এবং ব্যবস্থা গ্রহণ গোয়েন্দাদের কাজ । বর্তমান সময়ে অপরাধ দমনের জন্য পুলিশ রয়েছে । রয়েছে তাদের গোয়েন্দা বিভাগ । তবুও আম জনতার কাছে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর বা গোয়েন্দা কথার আমোঘ টান রয়েছে । তাই তো শার্লক হোমস, আগাথা ক্রিস্টি, প্রদোষচন্দ্র মিত্র, ব্যোমকেশ বকসি, কিরীটিরা গল্পের চরিত্র হয়েও আজও একই রকম সমান জনপ্রিয় । কিন্তু এই চরিত্রগুলো কি শুধুই গল্পের চরিত্র নাকি তার বাস্তব ভিত্তি আছে ?থাকলেও তারা কী ভাবে কাজ করেন ? পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ থাকলেও প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের প্রয়োজন কী ? এমনই অনেক প্রশ্ন নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরকে । মধ্য কলকাতায় ডিটেকটিভ এজেন্সিতে তাঁর দেখা মিলল । নাম অভিরূপ মিত্র ।
নিজেকে গোয়েন্দা এবং গ্রাফোলজিস্ট বা হস্তলিপিবিদ হিসেবে পরিচয় দেন । গোয়েন্দাগিরির সঙ্গে হাতের লেখার যোগাযোগ রয়েছে বলে মনে করেন । কারণ হাতের লেখায় অপরাধীর মানসিক স্থিতির ইঙ্গিত মেলে । যার মাধ্যমে অপরাধীকে চিহ্নিত করা সহজ হয় । অপরাধীকে শনাক্ত করতে আঙুলের ছাপের ভূমিকা এখন প্রমাণিত । উইলিয়াম জেমস হার্সেল, 1880 সালে ইংল্যান্ডের নেচার পত্রিকায় একটি চিঠি লিখেছিলেন । সেখানে মানুষের হাতের আঙুলের ছাপ দেখে অপরাধী ধরা যে সম্ভব, তা এই চিঠিতে প্রকাশ করেন তিনি । পরবর্তী সময়ে তা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে ।
অভিরূপ মিত্র বলছেন, হাতের লেখা বা গ্রাফোলজির মাধ্যমে অপরাধী চিহ্নিত করার বিষয়টি ভারতে না স্বীকৃতি পেলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বীকৃতি পেয়েছে । তার মাধ্যমে অপরাধী ধরা হয় । এই দেশেও পুলিশ বকলমে গ্রাফোলজির মাধ্যমে অপরাধীকে চিহ্নিত করে । তবে এই পদ্ধতিটি যেহেতু আইনসিদ্ধ নয় এ দেশে, তাই তাতে সরকারি সিলমোহর পড়ে না ।
অভিরূপের কথায়, “একজন মানুষ আত্মহত্যা করার মনস্থ করেছেন ৷ সেইসময় তাঁর সুইসাইড নোটে হাতের লেখা আর তাঁকে গান পয়েন্টে রেখে লেখানো লেখা এক হয় না । তাঁর দু'রকম মানসিক স্থিতি দুটো লেখায় ধরা পড়বেই । তাই দিয়েই শনাক্ত করা সম্ভব । এটা বুঝতে পুলিশ আমাদের বকলমে কোনও কোনও সময়ে সাহায্য নেয় বই কী ৷”
গ্রাফোলজির সঙ্গে অপরাধ তত্ত্বের সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করছেন অভিরূপ । কিন্তু এর সঙ্গে গোয়েন্দাগিরি কীভাবে সম্পৃক্ত । অভিরূপ মিত্র বলছেন, গোয়েন্দা গল্প পড়ার নেশাই তাঁকে গোয়েন্দা হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেছিল । পেশাগত ভাবে গোয়েন্দা হয়ে ওঠার পরে অভিরূপ মিত্র বুঝতে পারেন অপরাধ দু'রকমের । একটি কগনিজেবল । আরেকটি নন-কগনিজেবল ।
অভিরূপ বলেন, “ইন্ডিয়ান পিনাল কোড অনুসারে অপরাধের মাত্রা নির্ণয় হয় । যেমন বিয়ের আগে পাত্র পাত্রীর তত্ত্ব তলাশ করা হয় । অনেকেই করেন । এর মধ্যে কোনও অপরাধ নেই । ব্যাংক একটা লোন দিয়েছে । লোন ডিফল্ট হয়েছে । ঋণগ্রহীতার কোন কোন সম্পত্তি রয়েছে তা ব্যাংক জানতে চায় । এটা ক্রাইম বা অপরাধ নয় । ব্যাংক লোকটাকে গ্রেফতার করাতে পারবে না । সে কোনও ফ্রড বা জালিয়াতি করেনি । কিন্তু তাঁর কী কী সম্পত্তি রয়েছে তা ব্যাংক জানতে চায় । আমরা সেই তথ্য সন্ধান করে দিই । আবার কোনও কোম্পানি কোনও একটি ছেলে বা মেয়েকে নিয়োগ করবে । তাঁর অতীত রেকর্ড পেশাদারি জীবনে কী রয়েছে, তা জানার জন্য আমাদের ডাক পড়ে । এগুলো কিন্তু অপরাধ নয় । শুধুই তথ্য তলাশ । তবে কিছু অপরাধ নির্ণয়েরও ডাক পড়ে আমাদের । যেমন জাল দ্রব্য জাল বই ধরা । সেগুলোর জন্য ডাক পড়ে আমাদের । সেই খোঁজখবর বের করে আমাদের যে কোম্পানি বা ব্যক্তি নিয়োগ করেছিল তার হাতে তুলে দিই । এরপর পুলিশ হানা দিয়ে উদ্ধার করে । গ্রেফতার করে । আমাদের কাছে যাঁরা আসেন, তাঁরা নন-কগনিজেবল অফেন্স সমাধান করতেই আসেন ৷”
একইসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “শার্লস হোমস কিন্তু ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাতেন না । তিনি নিজেই ছিলেন ডিটেকটিভ । আজ আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশে লাইসেন্সড ডিটেকটিভ এজেন্সি রয়েছে । আমাদের দেশে তা নেই । স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক লাইসেন্সড সিকিউরিটি এজেন্সি করার অনুমতি দিয়েছে । কিন্তু ডিটেকটিভ এজেন্সিকে দেয়নি । এই নিয়ে চিঠি চাপাটি চলছে । হয়তো হবে ভবিষ্যতে । পুলিশ তাই আমাদের কাছ থেকে সরকারিভাবে সাহায্য নিতে পারে না । আমাদের বন্দুক রাখার অনুমতি নেই । প্রখর রুদ্রের ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ব্যাপারটা আমাদের নয় ।”
কলকাতায় এখন গোটা কুড়ি গোয়েন্দা রয়েছেন । তাঁরা মক্কেলের ইচ্ছে অনুসারে গোয়েন্দাগিরি করেন । তবে কোনও গোয়েন্দাই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কোনও কেস হাতে তুলে নেন না । তাই অতি সম্প্রতি কলকাতা শহরে হওয়া পাঁচটি রহস্য মৃত্যুর ব্যাপারে মন অনুসন্ধিৎসু হলেও অভিরূপ মিত্ররা গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রেখেই চুপ করে থাকেন ।
অভিরূপের কথায়, “আমরা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কোনও কেস নিতে পারি না । সে ক্ষেত্রে কেসের খরচ কে দেবে । কে আমাদের মক্কেল হবে । এটা তো আমাদের পেশা । শখের গোয়েন্দাগিরি তো নয় । আমরা কী ঘরের টাকা খরচ করে সেই তদন্তটা করব ! তা তো নয় । আমাদের ভূমিকাটা উকিল বা ডাক্তারের মতো ৷”
তাই গোয়েন্দা চরিত্র গল্পের পাতায় যত বেশি ডাকাবুকো, বাস্তবের মাটিতে অনেক বেশি নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকা নরমসরম । তাই গোলকধাম রহস্য, ছিন্নমস্তার অভিশাপ, দুর্গ রহস্য, চিড়িয়াখানা গল্পে ফেলুদা-ব্যোমকেশকে যতই যুক্তির জাল বিছিয়ে তদন্তের সমাধান করতে দেখে আমি-আপনি রোমাঞ্চিত হই, বাস্তবে নামলে তাঁরাও হয়তো এমন নরম সরম নিয়মের জালে বাঁধা চরিত্র হিসেবে প্রতিভাত হতেন ।
আরও পড়ুন: