ETV Bharat / state

রসদ রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, রিকশা চালাতে চালাতেই কবিতা আওড়ান বিমল মজুমদার

Poems Lifeline for Rickshaw Puller Bimal Majumder: পেশায় রিকশা চালক বিমল মজুমদার ৷ ছোটবেলা থেকে কবিতা তাঁর ভালোবাসা ৷ সেই ভালোবাসা থেকেই রিকশা চালাতে চালাতে কবিতা পাঠ করেন তিনি ৷ যা তাঁর রিকশায় হর্নের কাজ করে পথচলতি মানুষজনকে সতর্ক করতে ৷

ETV BHARAT
ETV BHARAT
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Dec 13, 2023, 10:51 PM IST

Updated : Dec 14, 2023, 5:11 PM IST

রিকশা চালাতে চালাতেই কবিতা আওড়ান বিমল মজুমদার

কলকাতা, 13 ডিসেম্বর: বাইপাস লাগোয়া পঞ্চান্নগ্রাম এলাকার বাসিন্দা বিমল মজুমদার ৷ পেশায় তিনি রিকশা চালক ৷ সওয়ারিদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাজ ৷ কিন্তু, বিমল মজুমদারের রিকশায় কোনও হর্ন নেই ৷ রিকশার সামনে এসে পড়া মানুষজনকে সতর্ক করেন এক অভিনব উপায়ে ৷ কেউ রিকশার সামনে এলে কখনও রবিঠাকুর, আবার কখনও কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পংক্তি আওড়ান তিনি ৷

ষাটোর্ধ্ব বিমল মজুমদারের জীবনে শত ওঠা-পড়া রয়েছে ৷ তা সত্ত্বেও ছোটবেলার ভালোবাসা আবৃত্তিকে ভুলে যাননি তিনি ৷ কোনও জায়গা থেকে অনুষ্ঠানের জন্য ডাক না পেয়ে, রোজকার জীবনে সেই আবৃত্তিকেই কাজে লাগিয়েছেন তিনি ৷

অভাবের সংসারে বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেননি বিমলবাবু ৷ কিন্তু, ছোট বিমলের মধ্যে যে এহেন প্রতিভা লুকিয়ে ছিল সেটা তাঁর বড় বৌদি বুঝেছিলেন ৷ তিনি নিজে গানবাজনা করতেন ৷ তাঁর বাপের বাড়িতে বিমলকে একটি গান গাইতে হবে বলে আবদার জুড়ে বসেন ৷ সেই সময় মাথায় হাত পড়ো ছোট্ট বিমলের ৷ তিনি বৌদিকে কোনও মতে বুঝিয়ে বললেন যে, গানবাজনা তাঁর দ্বারা হবে না ৷ কিন্তু, তাতে তাঁর বৌদি ভোলার নয় ৷ বই হাতে ধরিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'দুই বিঘা জমি' মুখস্থ করতে বলেন ৷

অগত্যা বিমলবাবু কবিতাটি মুখস্থ করেন ৷ নির্দিষ্ট দিনে তিনি মঞ্চে উঠে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন ৷ আটকে যাওয়া বা ভুল ছাড়াই সেদিন আবৃতি করেছিলেন ৷ যেন অনেক দিন ধরে কবিতা পাঠ করছেন তিনি ৷ সেদিন তাঁর কবিতা পাঠ শুনে অনেকই আপ্লুত হন সেখানে উপস্থিত সকলেই ৷ ব্যাস, আর কি ! বড় বৌদির দেখানো সেদিনের পথে আজও হেঁটে চলেছে বিমল মজুমদার ৷ মন খারাপে, একাকিত্বে, অভাবে, সুখে ও দুঃখে, কবিতাই বিমলবাবুর পরম বন্ধু হয়ে গিয়েছে ৷

দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন স্বামী-স্ত্রী দু’জনের সংসার ৷ তাই যেখানেই আবৃত্তি করে কিছু টাকা পাওয়া যেতে পারে শোনেন, সেখানেই চলে যান ৷ তবে কিছুটা ঠাট্টার ছলেই তিনি বলেন, "আসলে আমার চেহারা দেখে, আমাকে আর কেউ আবৃত্তি করতে ডাকে না ৷ তবে, যারা আমার আবৃত্তি একবার শোনেন তারা বারবার ডাকেন ৷" আর এভাবে একদিন রিকশা চালিয়ে জোরে জোরে আবৃত্তি করে পথের লোক সরানোর সময়, তিনি পুরনো কলকাতার গল্প সোসাইটির সদস্য জয়ন্ত সেনের নজরে পড়েন ৷

পুরনো কলকাতার গল্প সোসাইটি থেকে সম্প্রতি তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে ৷ জয়ন্ত সেন জানান, ওনার এলাকাতেই বিমলু মজুমদার থাকেন ৷ কিন্তু, তাঁর চেহারা ছবি অত্যন্ত সাধারণ ৷ খুবই দূর্বল বিমলবাবু ৷ উঁচু রাস্তা দিয়ে সওয়ারি টানতে বেশ বেগ পেতে হয় তাঁকে ৷ তিনি বলেন, "কিছুদিন আগেই আমি একদিন ওনার সাইকেল রিকশায় চেপে বাড়ি আসার সময় দেখি, রাস্তার লোক সরাতে তিনি জোরে জোরে কবিতা আওড়াচ্ছেন ৷ তখন আমাদের সোসাইটির বাকি সদস্যদের ওনার কবিতা সোনাই এবং পুরনো কলকাতার গল্প সোসাইটির পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মানিত করা হয় ৷ পাশাপাশি, সোসাইটির পক্ষ থেকে তাঁকে কিছু আর্থিক সহায়তাও তুলে দেওয়া হয়েছে ৷"

ব্যাংকের উচ্চপদস্থ আধিকারিক সুব্রত ঘোষ ৷ তিনি নিজেও সাহিত্য চর্চা করেন, যিনি বিমল মজুমদারকে নিয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে, একটি ছোট লেখা লিখেছেন ৷ সেটি তিনি ইটিভি ভারতকে শোনালেন ৷ সেই লেখার কিছু অংশ: "রিকশা চালানোর সময় গুনগুন করে গান হয়তো কেউ গাইতে পারেন ৷ কিন্তু, রিকশা চালাতে চালাতে গুনগুন করে আবৃত্তি ! রিকশা চালানোর পাশাপাশি এভাবে কবিতা বলে যেতে দম লাগে ৷ সেই দম উনি পান কী করে ? উত্তর: ভালোবাসা থেকে ৷ মুখে থাকে কবিতা, চোখ থাকে রাস্তায় ৷ মন থাকে সতর্ক ৷ যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে ৷ কীভাবে এতসব মেলান উনি ? উত্তর সেই এক, ভালোবাসা, প্যাশান, নিজের আনন্দ ৷ ...তিনি কি শিখিয়ে দিচ্ছেন আমাদের, যে পুঁথিগত বিদ্যাটাই সব নয় ৷ চাই অন্তরের বোধ, আগ্রহ আর নিষ্ঠা ৷ ...পুঁথিগত বিদ্যার দিক থেকে উনি এগোতে পারেননি ৷ জীবিকার খাতিরে উনি রিকশা চালান ৷ কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল যে ওর মনকে চালায় ৷ আর সেখানেই কি তিনি আমাদের অনেকের থেকে আলাদা, অনেকের থেকে এগিয়ে নন ?"

আরও পড়ুন:

  1. বাম জমানায় বাতিল হাতে টানা রিকশা, 17 বছর পরেও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
  2. করোনায় ধ্বস্ত মালদার গম্ভীরা, বাঁশি ছেড়ে রিকশা টানছেন শিল্পী

রিকশা চালাতে চালাতেই কবিতা আওড়ান বিমল মজুমদার

কলকাতা, 13 ডিসেম্বর: বাইপাস লাগোয়া পঞ্চান্নগ্রাম এলাকার বাসিন্দা বিমল মজুমদার ৷ পেশায় তিনি রিকশা চালক ৷ সওয়ারিদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাজ ৷ কিন্তু, বিমল মজুমদারের রিকশায় কোনও হর্ন নেই ৷ রিকশার সামনে এসে পড়া মানুষজনকে সতর্ক করেন এক অভিনব উপায়ে ৷ কেউ রিকশার সামনে এলে কখনও রবিঠাকুর, আবার কখনও কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পংক্তি আওড়ান তিনি ৷

ষাটোর্ধ্ব বিমল মজুমদারের জীবনে শত ওঠা-পড়া রয়েছে ৷ তা সত্ত্বেও ছোটবেলার ভালোবাসা আবৃত্তিকে ভুলে যাননি তিনি ৷ কোনও জায়গা থেকে অনুষ্ঠানের জন্য ডাক না পেয়ে, রোজকার জীবনে সেই আবৃত্তিকেই কাজে লাগিয়েছেন তিনি ৷

অভাবের সংসারে বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেননি বিমলবাবু ৷ কিন্তু, ছোট বিমলের মধ্যে যে এহেন প্রতিভা লুকিয়ে ছিল সেটা তাঁর বড় বৌদি বুঝেছিলেন ৷ তিনি নিজে গানবাজনা করতেন ৷ তাঁর বাপের বাড়িতে বিমলকে একটি গান গাইতে হবে বলে আবদার জুড়ে বসেন ৷ সেই সময় মাথায় হাত পড়ো ছোট্ট বিমলের ৷ তিনি বৌদিকে কোনও মতে বুঝিয়ে বললেন যে, গানবাজনা তাঁর দ্বারা হবে না ৷ কিন্তু, তাতে তাঁর বৌদি ভোলার নয় ৷ বই হাতে ধরিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'দুই বিঘা জমি' মুখস্থ করতে বলেন ৷

অগত্যা বিমলবাবু কবিতাটি মুখস্থ করেন ৷ নির্দিষ্ট দিনে তিনি মঞ্চে উঠে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন ৷ আটকে যাওয়া বা ভুল ছাড়াই সেদিন আবৃতি করেছিলেন ৷ যেন অনেক দিন ধরে কবিতা পাঠ করছেন তিনি ৷ সেদিন তাঁর কবিতা পাঠ শুনে অনেকই আপ্লুত হন সেখানে উপস্থিত সকলেই ৷ ব্যাস, আর কি ! বড় বৌদির দেখানো সেদিনের পথে আজও হেঁটে চলেছে বিমল মজুমদার ৷ মন খারাপে, একাকিত্বে, অভাবে, সুখে ও দুঃখে, কবিতাই বিমলবাবুর পরম বন্ধু হয়ে গিয়েছে ৷

দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন স্বামী-স্ত্রী দু’জনের সংসার ৷ তাই যেখানেই আবৃত্তি করে কিছু টাকা পাওয়া যেতে পারে শোনেন, সেখানেই চলে যান ৷ তবে কিছুটা ঠাট্টার ছলেই তিনি বলেন, "আসলে আমার চেহারা দেখে, আমাকে আর কেউ আবৃত্তি করতে ডাকে না ৷ তবে, যারা আমার আবৃত্তি একবার শোনেন তারা বারবার ডাকেন ৷" আর এভাবে একদিন রিকশা চালিয়ে জোরে জোরে আবৃত্তি করে পথের লোক সরানোর সময়, তিনি পুরনো কলকাতার গল্প সোসাইটির সদস্য জয়ন্ত সেনের নজরে পড়েন ৷

পুরনো কলকাতার গল্প সোসাইটি থেকে সম্প্রতি তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে ৷ জয়ন্ত সেন জানান, ওনার এলাকাতেই বিমলু মজুমদার থাকেন ৷ কিন্তু, তাঁর চেহারা ছবি অত্যন্ত সাধারণ ৷ খুবই দূর্বল বিমলবাবু ৷ উঁচু রাস্তা দিয়ে সওয়ারি টানতে বেশ বেগ পেতে হয় তাঁকে ৷ তিনি বলেন, "কিছুদিন আগেই আমি একদিন ওনার সাইকেল রিকশায় চেপে বাড়ি আসার সময় দেখি, রাস্তার লোক সরাতে তিনি জোরে জোরে কবিতা আওড়াচ্ছেন ৷ তখন আমাদের সোসাইটির বাকি সদস্যদের ওনার কবিতা সোনাই এবং পুরনো কলকাতার গল্প সোসাইটির পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মানিত করা হয় ৷ পাশাপাশি, সোসাইটির পক্ষ থেকে তাঁকে কিছু আর্থিক সহায়তাও তুলে দেওয়া হয়েছে ৷"

ব্যাংকের উচ্চপদস্থ আধিকারিক সুব্রত ঘোষ ৷ তিনি নিজেও সাহিত্য চর্চা করেন, যিনি বিমল মজুমদারকে নিয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে, একটি ছোট লেখা লিখেছেন ৷ সেটি তিনি ইটিভি ভারতকে শোনালেন ৷ সেই লেখার কিছু অংশ: "রিকশা চালানোর সময় গুনগুন করে গান হয়তো কেউ গাইতে পারেন ৷ কিন্তু, রিকশা চালাতে চালাতে গুনগুন করে আবৃত্তি ! রিকশা চালানোর পাশাপাশি এভাবে কবিতা বলে যেতে দম লাগে ৷ সেই দম উনি পান কী করে ? উত্তর: ভালোবাসা থেকে ৷ মুখে থাকে কবিতা, চোখ থাকে রাস্তায় ৷ মন থাকে সতর্ক ৷ যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে ৷ কীভাবে এতসব মেলান উনি ? উত্তর সেই এক, ভালোবাসা, প্যাশান, নিজের আনন্দ ৷ ...তিনি কি শিখিয়ে দিচ্ছেন আমাদের, যে পুঁথিগত বিদ্যাটাই সব নয় ৷ চাই অন্তরের বোধ, আগ্রহ আর নিষ্ঠা ৷ ...পুঁথিগত বিদ্যার দিক থেকে উনি এগোতে পারেননি ৷ জীবিকার খাতিরে উনি রিকশা চালান ৷ কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল যে ওর মনকে চালায় ৷ আর সেখানেই কি তিনি আমাদের অনেকের থেকে আলাদা, অনেকের থেকে এগিয়ে নন ?"

আরও পড়ুন:

  1. বাম জমানায় বাতিল হাতে টানা রিকশা, 17 বছর পরেও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
  2. করোনায় ধ্বস্ত মালদার গম্ভীরা, বাঁশি ছেড়ে রিকশা টানছেন শিল্পী
Last Updated : Dec 14, 2023, 5:11 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.