কলকাতা, 13 ডিসেম্বর: বাইপাস লাগোয়া পঞ্চান্নগ্রাম এলাকার বাসিন্দা বিমল মজুমদার ৷ পেশায় তিনি রিকশা চালক ৷ সওয়ারিদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাজ ৷ কিন্তু, বিমল মজুমদারের রিকশায় কোনও হর্ন নেই ৷ রিকশার সামনে এসে পড়া মানুষজনকে সতর্ক করেন এক অভিনব উপায়ে ৷ কেউ রিকশার সামনে এলে কখনও রবিঠাকুর, আবার কখনও কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পংক্তি আওড়ান তিনি ৷
ষাটোর্ধ্ব বিমল মজুমদারের জীবনে শত ওঠা-পড়া রয়েছে ৷ তা সত্ত্বেও ছোটবেলার ভালোবাসা আবৃত্তিকে ভুলে যাননি তিনি ৷ কোনও জায়গা থেকে অনুষ্ঠানের জন্য ডাক না পেয়ে, রোজকার জীবনে সেই আবৃত্তিকেই কাজে লাগিয়েছেন তিনি ৷
অভাবের সংসারে বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেননি বিমলবাবু ৷ কিন্তু, ছোট বিমলের মধ্যে যে এহেন প্রতিভা লুকিয়ে ছিল সেটা তাঁর বড় বৌদি বুঝেছিলেন ৷ তিনি নিজে গানবাজনা করতেন ৷ তাঁর বাপের বাড়িতে বিমলকে একটি গান গাইতে হবে বলে আবদার জুড়ে বসেন ৷ সেই সময় মাথায় হাত পড়ো ছোট্ট বিমলের ৷ তিনি বৌদিকে কোনও মতে বুঝিয়ে বললেন যে, গানবাজনা তাঁর দ্বারা হবে না ৷ কিন্তু, তাতে তাঁর বৌদি ভোলার নয় ৷ বই হাতে ধরিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'দুই বিঘা জমি' মুখস্থ করতে বলেন ৷
অগত্যা বিমলবাবু কবিতাটি মুখস্থ করেন ৷ নির্দিষ্ট দিনে তিনি মঞ্চে উঠে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন ৷ আটকে যাওয়া বা ভুল ছাড়াই সেদিন আবৃতি করেছিলেন ৷ যেন অনেক দিন ধরে কবিতা পাঠ করছেন তিনি ৷ সেদিন তাঁর কবিতা পাঠ শুনে অনেকই আপ্লুত হন সেখানে উপস্থিত সকলেই ৷ ব্যাস, আর কি ! বড় বৌদির দেখানো সেদিনের পথে আজও হেঁটে চলেছে বিমল মজুমদার ৷ মন খারাপে, একাকিত্বে, অভাবে, সুখে ও দুঃখে, কবিতাই বিমলবাবুর পরম বন্ধু হয়ে গিয়েছে ৷
দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন স্বামী-স্ত্রী দু’জনের সংসার ৷ তাই যেখানেই আবৃত্তি করে কিছু টাকা পাওয়া যেতে পারে শোনেন, সেখানেই চলে যান ৷ তবে কিছুটা ঠাট্টার ছলেই তিনি বলেন, "আসলে আমার চেহারা দেখে, আমাকে আর কেউ আবৃত্তি করতে ডাকে না ৷ তবে, যারা আমার আবৃত্তি একবার শোনেন তারা বারবার ডাকেন ৷" আর এভাবে একদিন রিকশা চালিয়ে জোরে জোরে আবৃত্তি করে পথের লোক সরানোর সময়, তিনি পুরনো কলকাতার গল্প সোসাইটির সদস্য জয়ন্ত সেনের নজরে পড়েন ৷
পুরনো কলকাতার গল্প সোসাইটি থেকে সম্প্রতি তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে ৷ জয়ন্ত সেন জানান, ওনার এলাকাতেই বিমলু মজুমদার থাকেন ৷ কিন্তু, তাঁর চেহারা ছবি অত্যন্ত সাধারণ ৷ খুবই দূর্বল বিমলবাবু ৷ উঁচু রাস্তা দিয়ে সওয়ারি টানতে বেশ বেগ পেতে হয় তাঁকে ৷ তিনি বলেন, "কিছুদিন আগেই আমি একদিন ওনার সাইকেল রিকশায় চেপে বাড়ি আসার সময় দেখি, রাস্তার লোক সরাতে তিনি জোরে জোরে কবিতা আওড়াচ্ছেন ৷ তখন আমাদের সোসাইটির বাকি সদস্যদের ওনার কবিতা সোনাই এবং পুরনো কলকাতার গল্প সোসাইটির পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মানিত করা হয় ৷ পাশাপাশি, সোসাইটির পক্ষ থেকে তাঁকে কিছু আর্থিক সহায়তাও তুলে দেওয়া হয়েছে ৷"
ব্যাংকের উচ্চপদস্থ আধিকারিক সুব্রত ঘোষ ৷ তিনি নিজেও সাহিত্য চর্চা করেন, যিনি বিমল মজুমদারকে নিয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে, একটি ছোট লেখা লিখেছেন ৷ সেটি তিনি ইটিভি ভারতকে শোনালেন ৷ সেই লেখার কিছু অংশ: "রিকশা চালানোর সময় গুনগুন করে গান হয়তো কেউ গাইতে পারেন ৷ কিন্তু, রিকশা চালাতে চালাতে গুনগুন করে আবৃত্তি ! রিকশা চালানোর পাশাপাশি এভাবে কবিতা বলে যেতে দম লাগে ৷ সেই দম উনি পান কী করে ? উত্তর: ভালোবাসা থেকে ৷ মুখে থাকে কবিতা, চোখ থাকে রাস্তায় ৷ মন থাকে সতর্ক ৷ যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে ৷ কীভাবে এতসব মেলান উনি ? উত্তর সেই এক, ভালোবাসা, প্যাশান, নিজের আনন্দ ৷ ...তিনি কি শিখিয়ে দিচ্ছেন আমাদের, যে পুঁথিগত বিদ্যাটাই সব নয় ৷ চাই অন্তরের বোধ, আগ্রহ আর নিষ্ঠা ৷ ...পুঁথিগত বিদ্যার দিক থেকে উনি এগোতে পারেননি ৷ জীবিকার খাতিরে উনি রিকশা চালান ৷ কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল যে ওর মনকে চালায় ৷ আর সেখানেই কি তিনি আমাদের অনেকের থেকে আলাদা, অনেকের থেকে এগিয়ে নন ?"
আরও পড়ুন: