কলকাতা, 6 জানুয়ারি: শেখ শাহজাহান ! মুঘল সম্রাটের নামে নাম উত্তর 24 পরগনার সন্দেশখালির এই তৃণমূল নেতার ৷ তাঁর সম্পত্তির বহর অনেকটা নামের সঙ্গে সাজুয্য রেখেই বেড়েছে ৷ ঘোষিত ও অঘোষিত মিলিয়ে তিনি প্রায় কয়েক কোটি টাকার মালিক বলে জানা গিয়েছে ৷
গত বছর জুন-জুলাইয়ে হয়ে যাওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় তাঁর হলফনামা থেকে অন্তত 8-9 কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব পাওয়া যাচ্ছে ৷ এছাড়াও 17টি গাড়িও রয়েছে তাঁর ৷ কিন্তু এলাকার মানুষ বলছেন, ভোটের সময় হলফনামায় দেওয়া সম্পত্তির হিসাব তো হিমশৈলের চূড়া ৷ আসলে সন্দেশখালির সরবেড়িয়া ও আশপাশের এলাকায় নামে-বেনামে তাঁর যা সম্পত্তি, তার পরিমাণ এর থেকে কয়েকগুন বেশি ৷ কেউ কেউ তো বলছেন খুঁজলে এর থেকে অনেক বেশি সম্পত্তি মিললেও মিলতে পারে ৷ তবে মুখ খুলতে চাইছেন না কেউই ৷
2023 সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে উত্তর 24 পরগনা জেলা পরিষদের একটি আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন শেখ শাহজাহান ৷ ভোটে জিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ হন বছর পঁয়তাল্লিশের এই তৃণমূল নেতা । ভোটের সময় রাজ্য নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তাঁর হলফনামায় সম্পত্তির খতিয়ান তুলে ধরেছিলেন ৷ সেই হলফনামা অনুযায়ী, শেখ শাহজাহানের ব্যাংকে টাকা ছিল 1 কোটি 92 লক্ষ 12 হাজার টাকা । তাঁর হাতে নগদ হিসাবে ছিল 2 লক্ষ টাকা । তাঁর কাছে 2 কোটি 39 লক্ষ টাকার গয়না ছিল । স্থাবর সম্পত্তি বলতে দেখানো 43 বিঘা জমিকে । যার বাজারদর দেখানো হয়েছিল 4 কোটি টাকা ।
এই হলফনামাতেই তিনি জানান, তাঁর কাছে রয়েছে 17টি গাড়ি । নির্বাচনী হলফনামায় ব্যবসাকে তাঁর পেশা হিসেবে দেখিয়েছিলেন তিনি । ব্যবসা থেকে তাঁর বাৎসরিক আয় দেখানো হয় 19 লক্ষ 83 হাজার 832 টাকা । 2023 সালের জুন মাসের 14 তারিখ জমা দেওয়া এই হলফনামায় দেখা যাচ্ছে, সরবেড়িয়ায় তাঁর পাকা বাড়ি রয়েছে । যার তৎকালীন বাজারমূল্য ছিল 1 কোটি 50 লক্ষ টাকা ।
উত্তর 24 পরগনার জেলার রাজনীতির ওয়াকিবহাল মহল বলছে, বাম আমলে সিপিএমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল শাহজাহানের ৷ 2011 সালের পর থেকে তিনি তৃণমূলের ছাতার তলায় চলে আসেন ৷ শুরুর দিকে মুকুল রায় ৷ পরে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন ৷ সম্ভবত সেই কারণেই রেশন দুর্নীতিতে জড়িয়েছে তাঁর নাম ৷ এই দুর্নীতির তদন্তে তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়েই শুক্রবার সকালে সন্দেশখালির সরবেড়িয়ায় আক্রান্ত হন ইডির আধিকারিক ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা ৷
আর তারপর থেকেই ক্রমাগত আলোচনা চলছে এই তৃণমূল নেতাকে নিয়ে ৷ স্থানীয় মানুষ এই নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ ৷ কিন্তু তাঁদের একাংশের দাবি, এই মুহূর্তে সরবেড়িয়ার আকুঞ্জবেড়িয়া এলাকার পরপর পাঁচটি বাড়ি রয়েছে শাহজাহান ও তাঁর আত্মীয়দের । তিনটি বাড়ি তাঁর ভাইয়ের । একটি বাড়িতে থাকেন তাঁর মা । আর শাহজাহানের বাড়ির হলুদ রং । এছাড়া সরবেড়িয়ার রাজবাড়ি এলাকায় 100 বিঘা জমির উপর শেখ শাহজাহানের বাগানবাড়ি রয়েছে । সেখানেও একটি সাজানো গোছানো একটি বাড়ি রয়েছে । যেখানে তিনি মাঝেমধ্যেই আসতেন সময় কাটাতে । সেই বাগানবাড়ি লাগোয়া কয়েক একর জমিতে তিনি সবজিও ফলাতেন । এই বাগানবাড়ির জমি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে । অভিযোগ, সেখানে কয়েকজন আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ করে গায়ের জোরে তিনি সেই জমি দখল করেছিলেন ।
এছাড়া সন্দেশখালিতে তাঁর নামে রয়েছে একটি বাজার । 2011 সালে সরবেড়িয়ায় তৈরি হয়েছিল শেখ শাহজাহান মার্কেট । এরপরে বিদ্যাধরীর পাড়ে পিন মার্কেট ও হ্যাচারি তৈরি করেছেন তিনি । স্থানীয়দের অনেকের অভিযোগ, নদীর চর দখল করে এই বাজার তৈরি করেছেন তিনি ও বাজারের বাইরে জ্বলজ্বল করে তাঁর নাম । পিন মার্কেট ও হ্যাচারিতে চলে চিংড়ি মাছের চারা বিকিকিনির কাজ । আর এটি রয়েছে তাঁর মেয়ে শেখ সাবিনার নামে । তাঁর নামেই 2022 সালের 10 জানুয়ারি এই মার্কেটের উদ্বোধন করা হয় । এখানেই শেষ নয়, শেখ শাহজাহানের নামে দু’টি ইটভাটা । তাঁর ভাইয়ের নামে পেট্রল পাম্পও রয়েছে বলে খবর স্থানীয় সূত্রে ।
অন্যদিকে তদন্তকারীরা তাঁর একাধিক বেনামী সম্পত্তি ও হোটেলের খোঁজ পেয়েছেন বলে জানা গিয়েছে । তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, ধামাখালি বাসস্ট্যান্ডে একটি বিলাসবহুল হোটেল নাকি রয়েছে তাঁর । এছাড়া শপিং কমপ্লেক্স, মার্কেট তো রয়েছেই । তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, এই ধরনের একাধিক হোটেল রয়েছে তাঁর নামে । আর সবটাই শাহজাহানের সাম্রাজ্যেরই অংশ বলেই মনে করছেন তাঁরা ।
স্থানীয়দের মতে, শাহজাহানের সম্পত্তির বহরের কোনও শেষ নেই । খুঁজলে হয়তো আরও অনেক কিছু বেরবে ! এসব নিয়ে কারোরই মুখ খোলার সাহস নেই ।
আরও পড়ুন: