কলকাতা, 19 সেপ্টেম্বর : শিক্ষামন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন, শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য থাকবে না । সেই কথা রাখেননি তিনি । বেতন ক্রম বৃদ্ধির পর বেতন বৈষম্য কমার পরিবর্তে বেড়ে গেছে । এই অভিযোগে আবার পথে নামার হুমকি দিল প্রাইমারি শিক্ষকদের সংগঠন উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (UUPTWA)। গতকাল কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা । তাঁদের দাবি, বর্ধিত বেতনক্রমে মাল্টিপ্লিকেশন ফ্যাক্টর দিতে হবে । নাহলে সকল প্রাথমিক শিক্ষকই বঞ্চনার শিকার হবেন ।
এর আগে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে একাধিকবার পথে নেমেছে উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন । মিছিল,আন্দোলন ও সবশেষে অনশনের পরে তাঁদের দাবি কিছুটা হলেও পূরণ হয় । 26 জুলাই সরকারি নির্দেশিকার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করে রাজ্য সরকার । তবে আপাতদৃষ্টিতে বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে মনে হলেও, আসলে এই নির্দেশিকায় একাধিক অসঙ্গতি রয়েছে বলে দাবি সংগঠনের । প্রধান দাবি, পে কমিশন উপযুক্ত মাল্টিপ্লিকেশন ফ্যাক্টর অনুসারে দেওয়া হয় । পূর্ববর্তী বেতন কাঠামো কম মনে করে পূর্ববর্তী বেতনের সঙ্গে একটি সমানুপাতিক মাল্টিপ্লিকেশন ফ্যাক্টর গুণ করে নতুন বেতন নির্ধারণ করে । তাঁদের বেতনক্রম বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এই সমানুপাতিক গুনিতক অনুসারে বেতন কাঠামো দেওয়া হোক ।
উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদিকা পৃথা বিশ্বাস প্রথমেই তাঁদের নায্য বেতনের দাবিতে আন্দোলন এবং অনশনের কথা তুলে ধরেন ৷ পরে তাঁদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির কথাও বলেন । তিনি বলেন, "যতবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে ততবার অন্যান্য রাজ্যগুলির প্রাথমিক শিক্ষকরা যে সর্বভারতীয় বেতন কাঠামো পেয়ে থাকেন সেই বেতন কাঠামোর কথা আমরা তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি । তিনি বুঝেছেন, সহমত হয়েছেন । পরে তিনি বলেছিলেন, এটা তো বুঝতে পারছেন রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয় । ফলে, অতটা আমরা পারব না । গত 24 জুনের জলকামানের আন্দোলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য থাকবে না । শিক্ষামন্ত্রী কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে একথা বলেছিলেন যে, মাদ্রাসা শিক্ষকদের সঙ্গে বেতন বৈষম্য রাখবেন না । তখনই প্রশ্নটা উঠে, 10 বছর আগের আমার থেকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের বেতন ক্রমটা 10 বছর বাদে যদি আমাকে দেওয়া হয় বেতন বৈষম্যটা মেটে না যদি না আমাকে কোনও মাল্টিপ্লাইয়িং ফ্যাক্টর দেওয়া হয় ।"
বেতনক্রম বৃদ্ধির পরও বেতন বৈষম্য নিয়ে পৃথা বিশ্বাস বলেন, "অনশনের সময় আমরা যে সরকারি নির্দেশিকা পেলাম সেটাতে কিন্তু একটা কথা খুব স্পষ্ট ৷ প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে আমাদের বেতন বৃদ্ধিটা শুধুমাত্র গ্রেড-পের ক্ষেত্রে হয়নি । হয়েছে আমাদের পে-ব্যান্ডের, পে-স্কেলের । PB-2 থেকে PB-3 খুব স্পষ্টভাবে লেখা আছে । এতদিন পর্যন্ত আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় অ-প্রশিক্ষিত শিক্ষকরাও, এমন কী এইট পাস টিচাররাও শুধুমাত্র গ্রেড-পের ফারাক ছাড়া একই পে-ব্যান্ড উপভোগ করেছেন । এই প্রথমবার দেখলাম, প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে একটা পে-ব্যান্ড বাড়ানো হলেও অ-প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের PB-2-তেই রেখে দেওয়া হল । তাহলে সরকার নিজের কথা ভায়োলেট করছে । আমার আজ প্রায় 14 বছর চাকরি হয়ে গেছে ৷ আমি PB-2-তে যে পে-ব্যান্ডে ছিলাম, অলরেডি PB-3-র একটা স্কেলে পৌঁছে গেছি । তিনি আমাকে সেই জায়গায় রেখে শুধুমাত্র হাজার টাকা গ্রেড-পে বৃদ্ধি করছেন । কোনও কোনও শিক্ষকের ক্ষেত্রে এই সুবিধাটা মাত্র 300 টাকা । শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন যে, বৈষম্য রাখবেন না । উলটে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিলেন ৷"
26 জুলাই বেতন ক্রম বৃদ্ধির সরকারি নির্দেশিকা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠেছিল প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে ৷ তার উত্তর কিছুটা মেলে যখন স্কুল শিক্ষাদপ্তর জেলা পরিদর্শকদের কাছ থেকে আসা প্রশ্নের ক্ল্যারিফিকেশন দেয় । কিন্তু সেই প্রশ্ন এবং তার উত্তরগুলির পরতে পরতে অসঙ্গতি রয়েছে বলে দাবি প্রাথমিক শিক্ষকদের । এতে সিনিয়রিটি সুযোগ-সুবিধা নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন তাঁরা । তাঁদের দাবি নিয়ে পৃথা বিশ্বাস বলেন, "আমাকে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী সরকার যে বেতন ক্রমে ফিট করবার কথা ভাবছে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সমানুপাতিক হারে মাল্টিপ্লিকেশন ফ্যাক্টর দিতে হবে । এই জায়গায় 1994 সালের এক পে-প্রোটেকশনের কথা বলা হচ্ছে । মানে হচ্ছে, কোনও জায়গায় যদি এইরকম হয় যে, সিনিয়র টিচারদের সঙ্গে জুনিয়র টিচারদের এক বেতন ক্রম হয়ে যাচ্ছে বা সিনিয়র টিচারদের বেতন জুনিয়রদের থেকে কম হলে তখন একমাত্র তাঁরা পে-প্রোটেকশন পাবেন । কেন? যেখানে 1994-এর পর 2009 ROPA অনুযায়ী টিচারদের জন্য যা যা বলা হয়েছে সেই কথাটাকে ভায়োলেট করা হবে কেন? ROPA অনুযায়ী আমরা সর্বোচ্চ সাতটা ইনক্রিমেন্ট কেন পাব না? আর যদি সাতটা ইনক্রিমেন্ট না পাই তাহলে আমাদের সিনিয়রদের সিনিয়রিটি রাখবার জন্য কেন তাদের মাল্টিপ্লিকেশন ফ্যাক্টর দেওয়া হবে না? মোদ্দা কথা, আমাদের সিনিয়রদের সিনিয়রিটি মেনটেন করে পে ফিক্সেশন দিতে হবে । সেই ফিক্সেশনে ওই হাজার টাকা গ্রেড-পে যাতে কোনও কোনও সিনিয়রদের মাত্র 300 টাকা গ্রেড-পে বাড়বে, আলটিমেটলি গ্রসে 720 টাকা বাড়বে, এটাতে বঞ্চনা মেটে না । বরং বঞ্চনা আরও বাড়ে । সেই জায়গাটাকে ঠিক করতে হবে । হয় কোনও মাল্টিপ্লিকেশন ফ্যাক্টর যাতে করে আমরা সত্যি সত্যি PB-3-তে ফিট করি, এটা হতে পারে । PB-2 থেকে PB-3-তে নিয়ে যাওয়া মানে এই নয় যে,আমার এগজ়িস্টিং স্যালারিতে গ্রেড-পে বাড়িয়ে দেওয়া । আমাকে মাল্টিপ্লিকেশন দিয়ে আমার পে-ব্যান্ডটাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে । তার সঙ্গে গ্রেড-পে দিয়ে সেই জায়গাতে আমাকে ফিক্স করতে হবে । একথাটা ROPA-তেই আছে । আর এর এফেক্ট সামনে যে পে কমিশনে যদি 2016 থেকে লাঘু করা হয় আমাদেরও এই পে-স্কেল 2016 থেকেই লাঘু করতে হবে । আর তা না হলে প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের জন্য সরকারকে প্রস্তুত থাকতে হবে ।"
আপাতত উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা নিজেদের দাবির স্বপক্ষে তথ্য-প্রমাণ জমা করছেন । যা তাঁরা বিকাশ ভবনে দেবেন । কিন্তু বিকাশ ভবন থেকে তাঁদের কোনও সদুত্তর না দেওয়া হলে আবার পথে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন । পৃথা বলেন, "আমরা আন্দোলনে যাব । অস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের জন্মই আন্দোলনের রাস্তায় । আমাদের বঞ্চনা করা হবে, সিনিয়র টিচারদের বঞ্চনা করা হবে সেটা মুখ বুজে মেনে নেব না । আমরা যদি আমাদের সামাজিক সম্মান রক্ষা করার জন্য 15 দিন না খেয়ে থাকতে পারি, তাহলে আরও অনেক কিছুই করতে পারি । কিন্তু তার আগে আমরা যা তথ্য সংগ্রহ করেছি সেই তথ্যগুলি আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে আরও একবার জমা দিতে চাই । সরকার দ্বিচারিতা করেছে । সেই দ্বিচারিতার জবাব দেওয়ার জন্য আমরা কাগজে-কলমে তৈরি । আর কাগজে-কলমের জবাবে যদি আমরা সন্তুষ্ট না হই আমাদের আন্দোলন আবার রাস্তায় নামবে । তখন কিন্তু আর সরকারের কথা বিবেচনা করা হবে না । আমাদের ন্যায্য বেতন ক্রম যেটা পে-ব্যান্ড -4, সেই জায়গাতেই নিজেদের দাবিটাকে ধরে রাখব । আমরা সরকারকে সময় দেব । শুধু বঞ্চনাটা মাঝেমধ্যে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য হয়তো আমাদের রাস্তায় থাকতে হবে ।"
শুধু আন্দোলন নয়, প্রয়োজনে আইনের পথে হাঁটার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাঁরা ।