কলকাতা, 5 জুন : পারিবারিক জুটমিলের বড় ব্যবসা । একটা সময় তিনিই দেখতেন ব্যারাকপুরের গৌরীশংকর জুটমিল । এখন সে সব অতীত । এখন তিনি পরিবেশ রক্ষায় এক যোদ্ধা । অস্ত্র বলতে একটা ছোট্ট লাঠি । সেটা নিয়েই খুঁজে বেড়ান প্লাস্টিক । 68 বছরের " যুবক " -এর স্বপ্ন, একদিন প্লাস্টিক মুক্ত হবে পৃথিবী । তাঁকে দেখে সচেতন হবেন বহু মানুষ । যত্রতত্র মানুষের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক কুড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন কলকাতার " প্লাস্টিকম্যান " । কলকাতার মেয়রের পর অনেকেই এখন তাঁকে এই নামেই ডাকে । মুচকি হেসে নিজেই জানালেন সে কথা ।
নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় । বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে গৌরীশংকর জুটমিল চলছে রমরমিয়ে । সেখানে বড় কর্তার ভূমিকায় তারাচাঁদ জৈন । কিন্তু দশকের মাঝামাঝি সময়ই ছন্দপতন । চোখের বিরল রোগ মায়াস্থেনিয়া গ্রেভিসে আক্রান্ত হন তিনি । চিকিৎসকরা বলে দেন জুটমিলের কাজ করা যাবে না । কিন্তু গৌরীশংকর জুটমিল তখন তাঁর হৃদয়ে । রোজ সকালে কলকাতার সাদার্ন অ্যাভিনিউ থেকে বিটি রোড ধরে ছুটে যায় তাঁর গাড়ি । নিয়মের অন্যথা হলে দিনটাই যেন মাটি হয়ে যায় । সেই অভ্যেস ছাড়বেন কী করে? কিন্তু এদিকে চিকিৎসক দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন চোখ বাঁচাতে হলে ছাড়তে হবে কাজ । পরামর্শ দেন, থাকতে হবে সবুজের সান্নিধ্যে । কাজ করতে হলে বাগান করা যেতে পারে । সময়ও কাটবে, সবুজের সান্নিধ্যেও থাকা যাবে । কথাটা মনে ধরে তাঁর । জুটমিলের বাগানটা তাঁকে টানত বরাবরই । মনে হত পরিচর্যা পেলে এই বাগান চোখ জুড়িয়ে দিতে পারে । বাগানের মাঝের বটগাছটা তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল । প্রথমদিন নিরীক্ষণ করেন বাগান । খেয়াল করলেন প্রিয় বটগাছটার গোড়ায় প্লাস্টিকের স্তূপ । পরদিনই হাতে তুললেন লাঠি । খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করলেন সেই প্লাস্টিকের স্তূপ । পুরো বাগানে অভিযান চালিয়ে বের হল প্রায় 500 কেজি প্লাস্টিক । বাগানে এত প্লাস্টিক থাকলে গাছ জল পাবে কী করে !
এরপর থেকেই রোজ সকালে রবীন্দ্র সরোবরের লায়ন্স ক্লাবের সাফারি পার্কে মর্নিং ওয়াক শুরু করলেন তারাচাঁদ । ইতিউতি তাকিয়ে দেখলেন পড়ে রয়েছে প্রচুর প্লাস্টিক । সরোবরের বিখ্যাত বটগাছটার গোড়াতেও জমে রয়েছে প্লাস্টিকের স্তূপ । পরের দিনই লেগে পড়লেন । সেই শুরু । তারপর কেটে গেছে 20 টা বছর । আজও সেই একই কাজ করে চলেন তারাচাঁদ । সাত সকালে একটা স্টিলের বিশেষ ধরনের দণ্ড হাতে বেরিয়ে পড়েন প্লাস্টিক খুঁজতে । পার্কে বেড়াতে আসা কিশোর-কিশোরী যুবক-যুবতিদের ফেলে যাওয়া চিপসের প্যাকেট থেকে শুরু করে বিড়ির প্যাকেট খুঁজে খুঁজে বের করেন । সেগুলি নির্দিষ্ট পাত্রে ফেলেন । বেলা বাড়লে সরোবরে আসা ছেলেছোকরার দলকে বোঝান কেন বর্জন করতে হবে প্লাস্টিক । তাতে গালমন্দও জোটে । কেউ কেউ আবার বলে, " ওই আসছে বুড়ো ভাম । এক্ষুনি প্লাস্টিক নিয়ে জ্ঞান দেবে । চল এখান থেকে কেটে পড়ি । " এই 20 বছরের মাঝে আবার কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট সরোবরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে হাত দেয় । নীল সাদা রং, বাঁধানো রাস্তা, সুন্দর বসার জায়গা, রেলিঙে সেজে উঠতে শুরু করে রবীন্দ্র সরোবর । তখনই তাঁর প্রথম কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনে যাওয়া । তিনি কর্পোরেশনের কাছে আবেদন করেন, রবীন্দ্র সরোবরকে ঘোষণা করতে হবে প্লাস্টিক মুক্ত এলাকা হিসেবে । রীতিমতো নাছোড়বান্দা হয়ে তৎকালীন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন তারাচাঁদ । মেয়র প্রথমে খুব একটা পাত্তা দেননি । পরে বুঝতে পারেন মানুষটা লড়ছেন প্রকৃতির জন্য, পরিবেশের জন্য । প্লাস্টিক মুক্ত রবীন্দ্র সরোবর সৌন্দর্যায়নের একটা বড় অঙ্গ । এরপরই রবীন্দ্র সরোবরকে প্লাস্টিক মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয় । শোভন তারাচাঁদকে ডাকতে শুরু করেন, " প্লাস্টিকম্যান অফ কলকাতা " নামে । সরোবরের সিকিউরিটির সঙ্গে যুক্ত লোকজনকে নির্দেশ দেওয়া হয় কোনওভাবেই কেউ যেন প্লাস্টিক নিয়ে সরোবর চত্বরে ঢুকতে না পারে ।
তারাচাঁদ বলেন, " পার্কের গেটের বাইরে বোর্ড লাগানো আছে । কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের আদেশনামায় বলা আছে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ । কিন্তু কে শোনে কার কথা । সিকিউরিটির লোকজনকে রীতিমতো হুমকি দিয়ে প্লাস্টিক নিয়ে সরোবরে ঢুকে যায় লোকজন । প্রতিদিন নোংরা করে পার্ক । অথচ গোটা পৃথিবীর এই মুহূর্তে শত্রু এই প্লাস্টিক । সেটা বন্ধ করতে না পারলে পৃথিবী রসাতলে চলে যাবে । কিন্তু কেউ তা বুঝতে পারছে না । তবুও আমার কাজ আমি করে যাব । স্বপ্ন দেখি একদিন প্লাস্টিক মুক্ত হবে পৃথিবী । আমি যে কাজ করছি দু'চারজন দেখেও যদি প্লাস্টিক বিরোধী অভিযানে শামিল হয় সেটাই আমার পাওনা । "
কথা বলতে বলতে ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন কলকাতার প্লাস্টিকম্যান । কারণ তাঁকে যেতে হবে লেক গার্ডেন্সে । সেখানে একটি দোকানে দিতে হবে কাপড়ের ব্যাগ । প্লাস্টিক মুক্ত শহর গড়তে দোকানে দোকানে কাপড়ের ব্যাগও বিলিয়ে বেড়ান যে তিনি !