ETV Bharat / state

রোগীরাই সবচেয়ে বড় শিক্ষক, 'ডক্টরস ডে'-তে আর কী বললেন জুনিয়র ডাক্তাররা?

author img

By

Published : Jul 1, 2019, 3:19 PM IST

Updated : Jul 1, 2019, 3:49 PM IST

তাঁদের অনেকের কাছে, জীবনে নিজেকে একজন ডাক্তার হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টি একটা বিশাল স্বপ্নের মতো । আর, এই স্বপ্নের পথে রোগীরাই তাঁদের কারও কারও কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষক । ডাক্তার হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী এই প্রক্রিয়ায় রয়েছে প্রচুর পরিশ্রম । এই প্রক্রিয়ার শেষ ধাপে তাঁরা যখন ইন্টার্নশিপ করেন জুনিয়র ডাক্তাররা তখন তাঁদের সেভাবে কোনও ছুটি পান না । হস্টেলে থাকা এই জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে তাঁদের পরিজনদের নিয়মিত দেখা হওয়া তো দূরের কথা, সেভাবে ফোনে কথাও বলতে পারেন না অনেকে । এসবের মধ্যেই কীভাবে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন স্বপ্ন পূরণের পথে, শুনে নেওয়া যাক ।

ফাইল ফোটো

কলকাতা, 1 জুলাই : স্বপ্ন তাঁদের সকলেরই রয়েছে । তবে, এখনও তাঁদের অনেকের কাছে, জীবনে নিজেকে একজন ডাক্তার হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টি একটা বিশাল স্বপ্নের মতো । আর, এই স্বপ্নের পথে রোগীরাই তাঁদের কারও কারও কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষক। তেমনই হস্টেল লাইফ, তাঁদের অনেকের কাছে বাড়ি থেকে দূরে অন্য এক বাড়ির মতো ।

ডাক্তার হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী এই প্রক্রিয়ায় রয়েছে প্রচুর পরিশ্রম । এই প্রক্রিয়ার শেষ ধাপে তাঁরা যখন ইন্টার্নশিপ করেন জুনিয়র ডাক্তাররা তখন তাঁদের সেভাবে কোনও ছুটি পান না । হস্টেলে থাকা এই জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে তাঁদের পরিজনদের নিয়মিত দেখা হওয়া তো দূরের কথা, সেভাবে ফোনে কথাও বলতে পারেন না অনেকে। রাতদিন ডিউটি তো থাকেই । তবে, টানা তিন দিনের ডিউটির সময় তাঁদের সেভাবে খাওয়া-দাওয়াও সম্ভব হয় না। এই পরিস্থিতির মধ্যেই বিভিন্ন সময় কোনও রোগীর ক্ষুব্ধ পরিজনদের কাছে তাঁদের অনেকে আক্রান্তও হন । তাঁদের খারাপ লাগে । তবুও তাঁরা ডাক্তার হয়ে ওঠার শেষ ধাপে কঠোর পরিশ্রম থেকে বিচ্যুত হন না।

ভিডিয়োয় দেখুন

যাঁরা ইন্টার্নশিপ করেন এবং যাঁরা হাউস স্টাফ, সাধারণত তাঁদেরকেই জুনিয়র ডাক্তার বলা হয় । সাড়ে পাঁচ বছরের MBBS কোর্সের শেষে এক বছর ইন্টার্নশিপ করতে হয় । এই সময় টেম্পোরারি রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হয় । ইন্টার্নশিপ কমপ্লিট করার পরে ফাইনাল রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হয় । তখন তাঁরা ডাক্তার । যাঁরা ফাইনাল রেজিস্ট্রেশন নম্বর পেয়েছেন, বিভিন্ন হাসপাতালে হাউস স্টাফ হিসেবে তাঁরা যোগদান করতে পারেন । যাঁরা ইন্টার্নশিপ করেন, তাঁরা রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যান । তবে, কোনও রোগীর মৃত্যু হলে ডেথ সার্টিফিকেট ইশু করতে পারেন না তাঁরা । এসবের মধ্যেই কীভাবে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন স্বপ্ন পূরণের পথে, শুনে নেওয়া যাক।

কলকাতা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করছেন অরিজিৎ ঘোষ । বর্ধমান শহর থেকে 40 কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে বাড়ি তাঁর। অরিজিতের কথায়, "ডাক্তার হওয়া একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া । সারা জীবনই কিছু না কিছু বিষয় আমাদের শিখতে হবে । শিখছিও । জুনিয়র ডাক্তার হিসাবে ইন্টার্নশিপে যোগদানের পরে ধীরে ধীরে ওয়ার্ডের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, রোগীদের দেখে শেখা, রোগীরাই আমাদের সব থেকে বড় শিক্ষক । এ সময় পড়াশোনার পাশাপাশি প্র্যাকটিক্যাল হিসেবে ইন্টার্ন হিসেবে ওয়ার্ডে কাজের বিষয়টিও রয়েছে । এই দু'টি বিষয় মিলিয়েই ডাক্তার হয়ে ওঠা । এর জন্য মারাত্মক পরিশ্রম প্রয়োজন ।"

শুধুই কী এখনকার পরিশ্রম? তিনি বলেন, "বর্ধমান থেকে 40 কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম থেকে ডাক্তারি পড়তে কলকাতা মেডিকেল কলেজে এসেছি । ডাক্তারি পড়তে আসার পরিশ্রমটা অন্যরকমের । আমার গ্রামে কোনও ডাক্তার নেই । এখান থেকে পরিশ্রমটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো । মেডিকেল কলেজে পড়ব ।" আগের এবং এখনকার, এই দু'টি পরিশ্রম অন্যরকমের হলেও, এই মুহূর্তে তাঁর ভালো লাগে যে, তিনি ডাক্তার হয়ে উঠছেন । এই জুনিয়র ডাক্তারের কথায়, "নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছি । একটা স্বপ্ন ছিল, ডাক্তার হব । প্রতিষ্ঠিত, দায়িত্ববান একজন নাগরিক হব । এই স্বপ্ন নিয়েই চলা। এই স্বপ্ন নিয়েই জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বসা । তখনকার পড়াশোনা । এখন চলছে MBBS-এর ইন্টার্নশিপ । স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলেছি । আগামী দিনে এভাবেই মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করব।"

ঘুম থেকে ওঠা। তারপর থেকে শুরু করে কোনও কোনও দিন ঠিক থাকে না, কখন আবার ঘুমোতে পারবেন । এমনও পরিস্থিতিতে পড়তে হয় ইন্টার্ন ডাক্তারদের । এই মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করছেন সায়ন্তন মুখুটি । তিনি বলেন, "এখন ডাক্তারি শেখার সময় । ঘুম থেকে ওঠার পরে কখনও মেডিসিন কখনও সার্জারি, কখনও অ্যাড অর্থাৎ অ্যাডমিশন ডে-র দিন পুরো দিনটা, কখনও নাইট ডিউটি। ডিউটি আওয়ার্স বলে জুনিয়র ডাক্তারদের সত্যিই কিছু থাকে না ।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "অ্যাডমিশন ডে-তে রোগীদের ভরতি করানোর পাশাপাশি তাঁদের চিকিৎসা-সহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয় দেখতে হয় আমাদের । আনস্টেবল রোগী হলে স্টেবল করা । এই কাজ ইন্টার্ন, জুনিয়র ডাক্তার, ফার্স্ট ইয়ার PGT, আমরাই করে থাকি । এখানে খাওয়া- দাওয়ার সময় থাকে না । দিনে একটা টাইম 2 টো থেকে 4 টের মধ্যে এক এক জন করে নাকে-মুখে গুঁজে কিছু খাওয়া, তার পরে রোগীদের দেখা । এভাবেই পুরোটা চলে ।"

মেডিসিন বিভাগের অ্যাডমিশন ডে হলে সকাল 9 টা থেকে রাত 9 টা। নাইট ডিউটি হলে রাত 9 টা থেকে সকাল 9 টা । সার্জারি বিভাগে টানা তিন দিন এখানেই থাকতে হয় । প্রতি সপ্তাহে একবার করে এই ডিউটি হয় । সায়ন্তন মুখুটি বলেন, "এর পাশাপাশি রোজই আসতে হয় । রোগীর কোনও পরীক্ষার ক্ষেত্রে কী রিপোর্ট এসেছে, কী ওষুধ দেওয়া হয়েছে, এসব ঠিক করে দেন জুনিয়র ডাক্তাররা । ইমারর্জেন্সি বিভাগে ডিউটি হলে তিনজন ডিউটিতে থাকেন ।" যদিও তিনজনের পক্ষে ইমারজেন্সিতে যত রোগী আসেন, তাঁদের দেখা সেভাবে সম্ভব হয় না । এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে ডাক্তার পেশেন্টের অনুপাত WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) যেমন বলে, তেমনও নয় । এত বেশি সংখ্যক রোগীর অনুপাতে ডাক্তার নেই ।" এর সঙ্গে পরিকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন ।

ইন্টার্নশিপ করছেন সৃজা রায় । তিনি বলেন, "ইন্টার্নশিপে ডিউটি আওয়ার্স যথেষ্ট বেশি । এই ডিউটি আওয়ার্সে হাসপাতালেই সমস্ত সময় থেকে রোগীর চিকিৎসা করি । যেদিন অ্যাডমিশন ডে থাকে, সেদিন 12 ঘণ্টা ডিউটি থাকে । যদিও নির্দিষ্ট সময় মেনে ডিউটির সময় শেষ হয় না । ইমারজেন্সিতে টানা 6 ঘণ্টা ডিউটি থাকে । ইন্টার্নশিপের ডিউটি আমাদের কাজ শেখার সময় । সেই অর্থে ছুটি থাকে না । নাইট ডিউটির পাশাপাশি টানা 36, 48 ঘণ্টার ডিউটিও আছে । নাইট ডিউটির আগের বা পরের দিনও ছুটি থাকে না । কাজের চাপ অনেক বেশি । আমরা শিখছি, কষ্ট তো করতেই হবে । এই জন্য বছরের পর বছর চলছে । আমরাও করছি ।" টানা এমন ডিউটির জন্য চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনও প্রভাব পড়ে না? এই জুনিয়র ডাক্তার বলেন, "স্বাভাবিক কারণেই টানা ডিউটি শেষের দিকে মাথা ততটা কাজ করবে না, যতটা শুরুর দিকে করছিল । কিন্তু এত বড় এক হাসপাতাল, এত বিভাগ, কিন্তু ইন্টার্ন ডাক্তার 250 জন । তাঁদেরকে ভাগাভাগি করে করতে হবে ।"

তিনি বলেন, "অনেকে মনে করেন, একসঙ্গে 36 ঘণ্টা ডিউটি করছেন পরের দুই দিন ছুটি পাবেন বলে । তা কিন্তু নয় । একসঙ্গে 36 ঘণ্টা ডিউটির পরে 6 বা 10 ঘণ্টা ছুটির পরে আবার ডিউটিতে আসতেই হয় । ওয়ার্ডে ডাক্তারদের জন্য অন কল রুম থাকে । সেখানেই বেশিরভাগ সময় টানা ডিউটিতে থেকে যান অনেকে । যাঁদের হস্টেল নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে সেখানে থাকা ছাড়া অন্য আর কোনও উপায় নেই ।" সায়ন্তন মুখুটি বলেন, "টানা ডিউটির সময় ডাক্তারদের জন্য অন কল রুমে এক- দেড়- দুই ঘণ্টার জন্য হয়তো বিশ্রাম নেওয়া যায় । যদি আরও একটু বেশি ডাক্তার থাকত, আরও একটু ভাল পরিকাঠামো হত, তাহলে হয়ত আমরা রোগীকে আরও ভালো পরিষেবা দিতে পারতাম ।" একইসঙ্গে তিনি বলেন, "টানা ডিউটির ক্ষেত্রে রোগীদের চিকিৎসার উপরে হয়তো প্রভাব পড়ে না‌ । তবে, টানা তিন দিন ডিউটিতে যখন শেষের দিকে যায় তখন ব্রেনও কাজ করতে চায় না ।" তবে এমন টানা ডিউটিতে শুধুমাত্র ইন্টার্ন ডাক্তাররা থাকেন না । ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড ইয়ারের PGT এবং তাঁদের স্যারও থাকেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।

এভাবেই কি হওয়া উচিত? সায়ন্তন মুখুটি বলেন, "এমন চলা উচিত নয় । আরও ডাক্তার চাই । রোগীদের চাপ সামলানোর জন্য আরও বেটার রোস্টার, ইমারজেন্সিতে তিন জনের জায়গায় যদি 5-6 জনকে দেওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই পরিষেবা আরও ভালো হত ।" তিনি বলেন, "অর্থোপেডিক বিভাগের টানা তিনদিনের ডিউটিতে প্রথম দিন অ্যাড ডে, পরের দিন পোস্ট অ্যাড ডে, তার পরের দিন অপারেশন হয় । গাইনি বিভাগে তো সব সময় থাকতে হয় । টানা ডিউটির জেরে বিশেষ করে জুনিয়র ডাক্তাররা ড্রেনড আউট হয়ে যান । ইন্টার্নশিপের সময় সাধারণত হস্টেলে শুধুমাত্র ঘুমানোর জন্য যাওয়া হয় । আর, হস্টেলের স্বাভাবিক জীবন ইন্টার্নশিপ শুরু হওয়ার পরে আর থাকে না । সেভাবে পড়ারও সময় থাকে না ।"

এই অবস্থায় পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ কতটা থাকে? অরিজিৎ ঘোষ বলেন, "যখন আমরা তুমুল পড়াশোনা করছি, অর্থাৎ প্রথম সাড়ে চার বছর । তখন আমি যেহেতু হস্টেলে থাকি মাসে একদিন বাড়ি গেলাম বা দুই এক দিন থাকলাম, এমন হত । কিন্তু ইন্টার্নশিপ শুরু হওয়ার পর থেকে সময় নেই । কারণ প্রত্যেক দিন ডিউটি । সকাল-সন্ধ্যা ডিউটি । কীভাবে বাড়ি যাব ? সম্ভব নয় ।" তিনি বলেন, "এইসব ডিউটির মাঝে এমন হয়, সকালে ঘুম থেকে উঠি, ডিউটিতে যাই । ডিউটি থেকে আসার পরে সারাদিনের ক্লান্তিতে রাতে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম । এই ব্যাপারটি প্রত্যেক দিন চলছে । আমি শেষ বাড়ি গেছি 2 মাস আগে।" পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে এই সময় যোগাযোগ অনেকটাই সম্ভব হয় না । এ কথা জানিয়ে সৃজা রায় বলেন, "আমরা শেষ কবে মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি গেছি মনেই পড়ে না । ছুটি তেমন পাওয়া যায় না । ফলে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আমরা সংযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে যাই । বিয়েবাড়ি, অন্নপ্রাশন এসব অনুষ্ঠানে আমরা যেতে পারি না । যেতে হলে খুব কম ক্ষেত্রে অনেক ম্যানেজ করে তার পরে সম্ভব হয় । বাকিদের বোঝাতে পারি না কেন আমরা পারি না । তাঁরা হয়তো মনে করেন, এত কাছের মানুষ হয়েও এল না । কিন্তু এটাই জীবন ।" সায়ন্তন মুখুটি বলেন, "ডিউটি শুরুর করে ফোন সাইলেন্স মোডে করে দিই । ডিউটির মাঝে ফোন এলে সমস্যা হয় । রাতে হয়তো ফোনে পরিবারের সঙ্গে কথা হয় ।" আর ছুটি? তিনি বলেন, "ছুটি ও ভাবে থাকে না । রোজই ডিউটি থাকে । এবং ডিউটি আওয়ার্স বলেও কিছু নেই ।"

এভাবে চলতে চলতে মনের উপর কোনও প্রভাব পড়ে না? অরিজিৎ ঘোষের কথায়, "মনের উপর প্রভাব কিছুটা হলেও পরে । রোজ একই রুটিন চলছে । একইভাবে সকাল থেকে রাত অবধি আমাদের কাজ করে যেতে হচ্ছে । মাঝে মাঝে বাড়িতে ফোন করে ওঠার সময়ও হয়ে ওঠে না ।" বাড়ির সবাই বোঝেন? তিনি বলেন, "বাড়ির সবাই বোঝার চেষ্টা করেন । তাঁরাও জানেন, ডাক্তার হচ্ছি । এই জিনিসগুলি সহ্য করতে হবে ।" আর, জীবনের সঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে? ডাক্তার হয়ে উঠতে উঠতে অনেকেই তো তাঁদের জীবনের সঙ্গীকে খুঁজে নেন । সৃজা রায় বলেন, "আমাদের পুরো সময়টাই কেটে যায় হাসপাতালের ভিতরে । রোগ, রোগী, মৃত্যু । জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলা দেখতে দেখতে ‌। যতদিন আমরা প্রতিষ্ঠিত হই, ততদিনে আমাদের আনন্দ করার বয়স থাকে না । ডাক্তারদের জীবন অনেকটা এরকম, যখন বয়স থাকে, তখন টাকা থাকে না । যখন সময় বা টাকা থাকে, তখন সেই বয়সটা থাকে না ।" সায়ন্তন মুখুটি অবশ্য বলেন, "প্রেম হয়, বিয়ে হয়, একসঙ্গে থাকার ব্যবস্থাও হয় ।"

সরকারি মেডিকেল কলেজে ডাক্তার হয়ে ওঠার জন্য প্রতি সেমিস্টারে সাড়ে চার হাজার টাকার মতো খরচ হয় । যাঁরা হস্টেলে থাকেন, তার জন্য ? মেডিকেল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া নিয়ম অনুযায়ী, হস্টেলের প্রতিটি রুমে তিনজন করে থাকার কথা । অথচ, বহু রুমে রয়েছেন চারজন করে । তাতে অবশ্য তেমন সমস্যা হয় না । এ কথা জানিয়ে অরিজিৎ ঘোষ বলেন, "হস্টেলের জন্য প্রতি মাসে 12 টাকা করে দিতে হয় । তবে আমরা যে খাবার খাই, তা নিজেদের খরচে । কোন বেলায় কোন ধরনের খাবার হবে, তার উপর ভিত্তি করে দাম ঠিক করা হয় ।" এসবের মধ্যেই তাঁদের প্রায় সকলের কাছেই হস্টেল লাইফ মজাদার বিষয় । অরিজিৎ ঘোষের কথায়, "হস্টেল লাইফ সব সময় মজাদার বিষয় । সবাই আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসি । বিভিন্ন রকমের মানসিকতা এবং ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসি । তার পরে হস্টেলে এসে এই সাড়ে পাঁচ বছরে আমরা এক হয়ে যাই । একইভাবে বড় হয়ে উঠি । একইভাবে ডাক্তার হতে শিখি ।" কখনও কোনও বন্ধুর সঙ্গে মনোমালিন্য ? তিনি বলেন, "মনোমালিন্য খুবই কম হয়েছে । হস্টেলে আসার পর থেকে আমরা একটা পরিবারের মতো গড়ে উঠেছি । এটা, জাস্ট লাইক আ হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম ।"

একই সঙ্গে তিনি বলেন, "যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে একসঙ্গে আছি, হস্টেলের সমস্যা হোক । কলেজের সমস্যা হোক, প্রতিটি পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে আমরা একসঙ্গে থেকেছি, লড়ে গেছি । বন্ডিংটা তাই আরও বেড়েছে ।" ইন্টার্নশিপের সময় হস্টেলে সেভাবে সময় কাটাতে পারেন না তাঁরা, যেভাবে প্রথম সাড়ে চার বছর ছাত্র অবস্থায় সময় কাটানো যায় । তবুও এরই মাঝে, ইন্টার্নদের সঙ্গে একই ঘরে যেমন থাকেন বিভিন্ন বর্ষের পড়ুয়ারা অর্থাৎ যাঁরা প্রথম সাড়ে চার বছরের পড়াশোনার মধ্যে রয়েছেন । তেমনই, খেলা বা অন্য কোনও বিনোদনের জন্য স্মার্ট ফোন থাকতেও, প্রচণ্ড পরিশ্রম আর ব্যস্ততার মাঝে সময় পেলে কখনও কমন রুমে টিভিতে কিছুটা সময় হলেও জমিয়ে উপভোগ করেন খেলা । তেমনই, জুনিয়র সিনিয়রদের মধ্যে ধীরে ধীরে পোক্ত হতে থাকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ।

এত কিছুর পরেও যখন বিভিন্ন সময় রোগীর ক্ষুব্ধ পরিজনদের কাছে আক্রান্ত হতে হয় জুনিয়র ডাক্তারদের ? অরিজিৎ ঘোষ বলেন, "ডাক্তারি পড়তে আসার আগে স্বপ্ন থাকে । তার পরে গোটা এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিশ্রম রয়েছে । এর পরেও যখন আমরা হাসপাতালে যায়, রোগীর সংখ্যার তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম থাকে। ডাক্তারদের উপর অমানবিক চাপ থাকে । অমানবিক পরিশ্রম হয় । এর পাশাপাশি হাসপাতালের বেডে সংখ্যাও খুব কম । মেঝেতে রোগীদের ভর্তি করাতে হয় । এই ধরনের পরিস্থিতিতে, যা চিকিৎসা-সরঞ্জাম আছে, সব কিছু দিয়ে সাধ্যমতো সব রকম চিকিৎসার পরেও যখন এই জিনিসগুলি হয় তখন খুব খারাপ লাগে । ডাক্তার হিসাবে নিজেদের খারাপ লাগে । তখন এই সিস্টেমটাকে দায়ি করা ছাড়া আমাদের অন্য আর কোনও উপায় থাকে না‌ ।" সৃজা রায় বলেন, "খারাপটা ওই কারণেই লাগে । প্রফেশনটাকে ভালবেসেই আমরা এসেছি। যখন থেকে এসেছি তখন থেকেই আমরা জানতাম অনেক বেশি খাটতে হবে, অনেক পরিশ্রম করতে হবে। ডাক্তারদের পরিবার, জীবন অনেক ক্ষেত্রেই থাকে না । এগুলো জেনে বুঝেই এসেছি। কিন্তু যাঁদের জন্য এসেছি, তাঁরা যদি আমাদের খারাপ ভাবেন, তখন খারাপ লাগে । সত্যিই খারাপ লাগে ।"

একই সঙ্গে তিনি বলেন, "সবাই খারাপ নন । ওয়ার্ডে প্রচুর রোগী থাকেন যাঁরা আমাদের ভালোবাসেন । কিন্তু সব কিছুতেই কিছু না কিছু খারাপ থাকে । রোগীরা খারাপ হন না । সাধারণত আমরা দেখেছি রোগী বা তাঁর বাড়ির লোকরা যে খুব বেশি ঝামেলা করেন, এরকম হয় না । তাঁদের সঙ্গে অন্য লোকরা আসেন । তাঁরা বেশি ঝামেলা করেন ।" সমাধানের কোনও পথ? এই জুনিয়র ডাক্তার বলেন, "সমাধান বলতে মনে হয়, সবার মধ্যে সচেতনতা দরকার । অন্ততপক্ষে মানুষকে বুঝতে হবে কোনও দিনও কোনও ডাক্তার কাউকে মারতে চান না । আমরা জীবন বাঁচাতে শিখেছি । মারতে শিখিনি । কিছু কিছু ক্ষেত্রে হতে পারে আমরা বাঁচাতে পারলাম না । মানুষের মধ্যে এই অ্যাওয়ারনেসটা তৈরি হলে আমাদেরও ভালো লাগবে । ডাক্তারের প্রতি বিশ্বাস থাকা দরকার । যা কিছু করছেন তিনি রোগীর ভালোর জন্য করছেন । আমার মনে হয় যে, প্রশাসনিক স্তর থেকে এই বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তাহলে ভালো হয় ।" তিনি বলেন, "আমরা অনেক ক্ষেত্রে যেমন, সিনেমায় দেখেছি, ডাক্তাররা খুবই অর্থলোভী । এমনভাবে দেখানো হয় । কেউ কেউ থাকতেই পারেন । সব কিছুতেই কিছু না কিছু খারাপ থাকে । কিন্তু সরকারি হাসপাতালে সামান্য বেতন । তবুও এমন ডাক্তাররাও আছেন যাঁরা বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে থাকলে কোটিপতি হয়ে যেতে পারতেন । শুধু হাসপাতালকে ভালবেসে এখনও এখানে রয়েছেন । তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কষ্টকর হয় যখন এই রকম ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় ।" অরিজিৎ ঘোষ বলেন, "প্রশাসনিক ভাবে পুরো বিষয়টির উপর যদি কঠোর নজরদারি করা হয়, রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, চিকিৎসা-সরঞ্জামের জোগাড় দেওয়া হয় । এমন যদি করা হয়, মেঝেতে রোগী থাকবে না । শুধু বেডেই থাকবে । রোগী এবং ডাক্তারের অনুপাত যদি ঠিক হয় । তা হলে মনে হয় ভবিষ্যতে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে না । নিরাপত্তা বাড়ানো, যাঁরা এই ধরনের কাজ করে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার খুবই দরকার ।"

সম্প্রতি ডাক্তারদের আন্দোলন হয়েছিল । তাঁরা বার বার বলেছেন এই আন্দোলন রোগী বিরোধী নয় । রোগীকে ভালোভাবে চিকিৎসা দিতে চান ডাক্তাররা । এ কথা জানিয়ে সায়ন্তন মুখুটি বলেন, "কিন্তু ওই সব সমস্যার কারণে, আমরাও যতটা চাই ততটা দিতে পারি না । এই সব কিছুর যদি উন্নতি হয়, তাহলে কোনও একদিন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে যাবে ।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "আমার মনে হয় না এটা রোগীর বাড়ির লোকদের সমস্যা । আসলে এটা সিস্টেমের সমস্যা । স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যদি তিনটি স্তম্ভ ডাক্তার, রোগী এবং তার সঙ্গে অথরিটি বা সরকার থাকে । এখানে ডাক্তার এবং রোগী কোনওভাবেই নিজেরা নিজেদের শত্রু নয় । রোগীরা সেরা চিকিৎসা নিতে আসেন মেডিকেল কলেজে । আমরাও চিকিৎসা পরিষেবা দিতে চাই। রোগীরা ভেবে আসেন সব কিছুই ফ্রি । তার পর এখানে দেখেন, সবটা ফ্রি নয় । ইমারজেন্সিতে এত বেশি সংখ্যক রোগীর ভিড়, সেখানে তিনজন ডাক্তার তা সামলান । তিন জনের পক্ষে সামলানো সম্ভব নয় । আমরাও মানুষ । সেখানেই হয়তো একটু প্রবলেম হল ।"

তিনি বলেন, "রোগীর বাড়ির লোকজন বা রোগী দেখেন সামনে ডাক্তার আছেন । নার্স আছেন । কোনও স্বাস্থ্যকর্মী আছেন । রাগটা তাঁদের উপরে গিয়ে পড়ে । কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোনওভাবেই ডাক্তার বনাম রোগী নয় । স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডাক্তার এবং রোগী একই সঙ্গে থাকেন । আসলে কর্তৃপক্ষের সমস্যা । যদি আরও ভালো পরিকাঠামো হত । যদি আরও একটু বেশি ডাক্তারের সংখ্যা হত, তাহলে রোগীরা অনেক ভালো পরিষেবা পেতেন । ডাক্তাররাও অনেক ভালো পরিষেবা দিতে পারতেন ।" রোগী এবং ডাক্তারের মধ্যে আগের মতো সম্পর্ক আর নেই । অবনতি হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে । এই বিষয়ে কী বলবেন ? সৃজা রায় বলেন, "আগে আমরা সবসময় চেষ্টা করতাম । সমস্যা কী হচ্ছে তা জেনে, কীভাবে সমাধান করা যায় । তার জন্য সব রকম চেষ্টা করতাম । এখন আমরা অনেক আইন দেখে কাজ করি । বিশ্বাস অনেক চলে যাচ্ছে ।" আইনের জন্য? তিনি বলেন, "না । আইন থাকা উচিত । আইন মানা না হলে জিনিসটি আরও খারাপ হবে । সাধারণ মানুষের বোঝা উচিত, বিশ্বাস করে ডাক্তারের কাছে এসেছেন রোগী । সব কিছু দেখে রোগীর ভালো বুঝলাম বলেই কোনও ওষুধ দিচ্ছি আমরা । ডাক্তারের উপরে বিশ্বাস থাকতে হবে যে, ডাক্তার যেটা করছেন, ভালর জন্যই করছেন ।"

কলকাতা, 1 জুলাই : স্বপ্ন তাঁদের সকলেরই রয়েছে । তবে, এখনও তাঁদের অনেকের কাছে, জীবনে নিজেকে একজন ডাক্তার হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টি একটা বিশাল স্বপ্নের মতো । আর, এই স্বপ্নের পথে রোগীরাই তাঁদের কারও কারও কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষক। তেমনই হস্টেল লাইফ, তাঁদের অনেকের কাছে বাড়ি থেকে দূরে অন্য এক বাড়ির মতো ।

ডাক্তার হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী এই প্রক্রিয়ায় রয়েছে প্রচুর পরিশ্রম । এই প্রক্রিয়ার শেষ ধাপে তাঁরা যখন ইন্টার্নশিপ করেন জুনিয়র ডাক্তাররা তখন তাঁদের সেভাবে কোনও ছুটি পান না । হস্টেলে থাকা এই জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে তাঁদের পরিজনদের নিয়মিত দেখা হওয়া তো দূরের কথা, সেভাবে ফোনে কথাও বলতে পারেন না অনেকে। রাতদিন ডিউটি তো থাকেই । তবে, টানা তিন দিনের ডিউটির সময় তাঁদের সেভাবে খাওয়া-দাওয়াও সম্ভব হয় না। এই পরিস্থিতির মধ্যেই বিভিন্ন সময় কোনও রোগীর ক্ষুব্ধ পরিজনদের কাছে তাঁদের অনেকে আক্রান্তও হন । তাঁদের খারাপ লাগে । তবুও তাঁরা ডাক্তার হয়ে ওঠার শেষ ধাপে কঠোর পরিশ্রম থেকে বিচ্যুত হন না।

ভিডিয়োয় দেখুন

যাঁরা ইন্টার্নশিপ করেন এবং যাঁরা হাউস স্টাফ, সাধারণত তাঁদেরকেই জুনিয়র ডাক্তার বলা হয় । সাড়ে পাঁচ বছরের MBBS কোর্সের শেষে এক বছর ইন্টার্নশিপ করতে হয় । এই সময় টেম্পোরারি রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হয় । ইন্টার্নশিপ কমপ্লিট করার পরে ফাইনাল রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হয় । তখন তাঁরা ডাক্তার । যাঁরা ফাইনাল রেজিস্ট্রেশন নম্বর পেয়েছেন, বিভিন্ন হাসপাতালে হাউস স্টাফ হিসেবে তাঁরা যোগদান করতে পারেন । যাঁরা ইন্টার্নশিপ করেন, তাঁরা রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যান । তবে, কোনও রোগীর মৃত্যু হলে ডেথ সার্টিফিকেট ইশু করতে পারেন না তাঁরা । এসবের মধ্যেই কীভাবে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন স্বপ্ন পূরণের পথে, শুনে নেওয়া যাক।

কলকাতা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করছেন অরিজিৎ ঘোষ । বর্ধমান শহর থেকে 40 কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে বাড়ি তাঁর। অরিজিতের কথায়, "ডাক্তার হওয়া একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া । সারা জীবনই কিছু না কিছু বিষয় আমাদের শিখতে হবে । শিখছিও । জুনিয়র ডাক্তার হিসাবে ইন্টার্নশিপে যোগদানের পরে ধীরে ধীরে ওয়ার্ডের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, রোগীদের দেখে শেখা, রোগীরাই আমাদের সব থেকে বড় শিক্ষক । এ সময় পড়াশোনার পাশাপাশি প্র্যাকটিক্যাল হিসেবে ইন্টার্ন হিসেবে ওয়ার্ডে কাজের বিষয়টিও রয়েছে । এই দু'টি বিষয় মিলিয়েই ডাক্তার হয়ে ওঠা । এর জন্য মারাত্মক পরিশ্রম প্রয়োজন ।"

শুধুই কী এখনকার পরিশ্রম? তিনি বলেন, "বর্ধমান থেকে 40 কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম থেকে ডাক্তারি পড়তে কলকাতা মেডিকেল কলেজে এসেছি । ডাক্তারি পড়তে আসার পরিশ্রমটা অন্যরকমের । আমার গ্রামে কোনও ডাক্তার নেই । এখান থেকে পরিশ্রমটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো । মেডিকেল কলেজে পড়ব ।" আগের এবং এখনকার, এই দু'টি পরিশ্রম অন্যরকমের হলেও, এই মুহূর্তে তাঁর ভালো লাগে যে, তিনি ডাক্তার হয়ে উঠছেন । এই জুনিয়র ডাক্তারের কথায়, "নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছি । একটা স্বপ্ন ছিল, ডাক্তার হব । প্রতিষ্ঠিত, দায়িত্ববান একজন নাগরিক হব । এই স্বপ্ন নিয়েই চলা। এই স্বপ্ন নিয়েই জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বসা । তখনকার পড়াশোনা । এখন চলছে MBBS-এর ইন্টার্নশিপ । স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলেছি । আগামী দিনে এভাবেই মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করব।"

ঘুম থেকে ওঠা। তারপর থেকে শুরু করে কোনও কোনও দিন ঠিক থাকে না, কখন আবার ঘুমোতে পারবেন । এমনও পরিস্থিতিতে পড়তে হয় ইন্টার্ন ডাক্তারদের । এই মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করছেন সায়ন্তন মুখুটি । তিনি বলেন, "এখন ডাক্তারি শেখার সময় । ঘুম থেকে ওঠার পরে কখনও মেডিসিন কখনও সার্জারি, কখনও অ্যাড অর্থাৎ অ্যাডমিশন ডে-র দিন পুরো দিনটা, কখনও নাইট ডিউটি। ডিউটি আওয়ার্স বলে জুনিয়র ডাক্তারদের সত্যিই কিছু থাকে না ।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "অ্যাডমিশন ডে-তে রোগীদের ভরতি করানোর পাশাপাশি তাঁদের চিকিৎসা-সহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয় দেখতে হয় আমাদের । আনস্টেবল রোগী হলে স্টেবল করা । এই কাজ ইন্টার্ন, জুনিয়র ডাক্তার, ফার্স্ট ইয়ার PGT, আমরাই করে থাকি । এখানে খাওয়া- দাওয়ার সময় থাকে না । দিনে একটা টাইম 2 টো থেকে 4 টের মধ্যে এক এক জন করে নাকে-মুখে গুঁজে কিছু খাওয়া, তার পরে রোগীদের দেখা । এভাবেই পুরোটা চলে ।"

মেডিসিন বিভাগের অ্যাডমিশন ডে হলে সকাল 9 টা থেকে রাত 9 টা। নাইট ডিউটি হলে রাত 9 টা থেকে সকাল 9 টা । সার্জারি বিভাগে টানা তিন দিন এখানেই থাকতে হয় । প্রতি সপ্তাহে একবার করে এই ডিউটি হয় । সায়ন্তন মুখুটি বলেন, "এর পাশাপাশি রোজই আসতে হয় । রোগীর কোনও পরীক্ষার ক্ষেত্রে কী রিপোর্ট এসেছে, কী ওষুধ দেওয়া হয়েছে, এসব ঠিক করে দেন জুনিয়র ডাক্তাররা । ইমারর্জেন্সি বিভাগে ডিউটি হলে তিনজন ডিউটিতে থাকেন ।" যদিও তিনজনের পক্ষে ইমারজেন্সিতে যত রোগী আসেন, তাঁদের দেখা সেভাবে সম্ভব হয় না । এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে ডাক্তার পেশেন্টের অনুপাত WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) যেমন বলে, তেমনও নয় । এত বেশি সংখ্যক রোগীর অনুপাতে ডাক্তার নেই ।" এর সঙ্গে পরিকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন ।

ইন্টার্নশিপ করছেন সৃজা রায় । তিনি বলেন, "ইন্টার্নশিপে ডিউটি আওয়ার্স যথেষ্ট বেশি । এই ডিউটি আওয়ার্সে হাসপাতালেই সমস্ত সময় থেকে রোগীর চিকিৎসা করি । যেদিন অ্যাডমিশন ডে থাকে, সেদিন 12 ঘণ্টা ডিউটি থাকে । যদিও নির্দিষ্ট সময় মেনে ডিউটির সময় শেষ হয় না । ইমারজেন্সিতে টানা 6 ঘণ্টা ডিউটি থাকে । ইন্টার্নশিপের ডিউটি আমাদের কাজ শেখার সময় । সেই অর্থে ছুটি থাকে না । নাইট ডিউটির পাশাপাশি টানা 36, 48 ঘণ্টার ডিউটিও আছে । নাইট ডিউটির আগের বা পরের দিনও ছুটি থাকে না । কাজের চাপ অনেক বেশি । আমরা শিখছি, কষ্ট তো করতেই হবে । এই জন্য বছরের পর বছর চলছে । আমরাও করছি ।" টানা এমন ডিউটির জন্য চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনও প্রভাব পড়ে না? এই জুনিয়র ডাক্তার বলেন, "স্বাভাবিক কারণেই টানা ডিউটি শেষের দিকে মাথা ততটা কাজ করবে না, যতটা শুরুর দিকে করছিল । কিন্তু এত বড় এক হাসপাতাল, এত বিভাগ, কিন্তু ইন্টার্ন ডাক্তার 250 জন । তাঁদেরকে ভাগাভাগি করে করতে হবে ।"

তিনি বলেন, "অনেকে মনে করেন, একসঙ্গে 36 ঘণ্টা ডিউটি করছেন পরের দুই দিন ছুটি পাবেন বলে । তা কিন্তু নয় । একসঙ্গে 36 ঘণ্টা ডিউটির পরে 6 বা 10 ঘণ্টা ছুটির পরে আবার ডিউটিতে আসতেই হয় । ওয়ার্ডে ডাক্তারদের জন্য অন কল রুম থাকে । সেখানেই বেশিরভাগ সময় টানা ডিউটিতে থেকে যান অনেকে । যাঁদের হস্টেল নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে সেখানে থাকা ছাড়া অন্য আর কোনও উপায় নেই ।" সায়ন্তন মুখুটি বলেন, "টানা ডিউটির সময় ডাক্তারদের জন্য অন কল রুমে এক- দেড়- দুই ঘণ্টার জন্য হয়তো বিশ্রাম নেওয়া যায় । যদি আরও একটু বেশি ডাক্তার থাকত, আরও একটু ভাল পরিকাঠামো হত, তাহলে হয়ত আমরা রোগীকে আরও ভালো পরিষেবা দিতে পারতাম ।" একইসঙ্গে তিনি বলেন, "টানা ডিউটির ক্ষেত্রে রোগীদের চিকিৎসার উপরে হয়তো প্রভাব পড়ে না‌ । তবে, টানা তিন দিন ডিউটিতে যখন শেষের দিকে যায় তখন ব্রেনও কাজ করতে চায় না ।" তবে এমন টানা ডিউটিতে শুধুমাত্র ইন্টার্ন ডাক্তাররা থাকেন না । ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড ইয়ারের PGT এবং তাঁদের স্যারও থাকেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।

এভাবেই কি হওয়া উচিত? সায়ন্তন মুখুটি বলেন, "এমন চলা উচিত নয় । আরও ডাক্তার চাই । রোগীদের চাপ সামলানোর জন্য আরও বেটার রোস্টার, ইমারজেন্সিতে তিন জনের জায়গায় যদি 5-6 জনকে দেওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই পরিষেবা আরও ভালো হত ।" তিনি বলেন, "অর্থোপেডিক বিভাগের টানা তিনদিনের ডিউটিতে প্রথম দিন অ্যাড ডে, পরের দিন পোস্ট অ্যাড ডে, তার পরের দিন অপারেশন হয় । গাইনি বিভাগে তো সব সময় থাকতে হয় । টানা ডিউটির জেরে বিশেষ করে জুনিয়র ডাক্তাররা ড্রেনড আউট হয়ে যান । ইন্টার্নশিপের সময় সাধারণত হস্টেলে শুধুমাত্র ঘুমানোর জন্য যাওয়া হয় । আর, হস্টেলের স্বাভাবিক জীবন ইন্টার্নশিপ শুরু হওয়ার পরে আর থাকে না । সেভাবে পড়ারও সময় থাকে না ।"

এই অবস্থায় পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ কতটা থাকে? অরিজিৎ ঘোষ বলেন, "যখন আমরা তুমুল পড়াশোনা করছি, অর্থাৎ প্রথম সাড়ে চার বছর । তখন আমি যেহেতু হস্টেলে থাকি মাসে একদিন বাড়ি গেলাম বা দুই এক দিন থাকলাম, এমন হত । কিন্তু ইন্টার্নশিপ শুরু হওয়ার পর থেকে সময় নেই । কারণ প্রত্যেক দিন ডিউটি । সকাল-সন্ধ্যা ডিউটি । কীভাবে বাড়ি যাব ? সম্ভব নয় ।" তিনি বলেন, "এইসব ডিউটির মাঝে এমন হয়, সকালে ঘুম থেকে উঠি, ডিউটিতে যাই । ডিউটি থেকে আসার পরে সারাদিনের ক্লান্তিতে রাতে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম । এই ব্যাপারটি প্রত্যেক দিন চলছে । আমি শেষ বাড়ি গেছি 2 মাস আগে।" পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে এই সময় যোগাযোগ অনেকটাই সম্ভব হয় না । এ কথা জানিয়ে সৃজা রায় বলেন, "আমরা শেষ কবে মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি গেছি মনেই পড়ে না । ছুটি তেমন পাওয়া যায় না । ফলে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আমরা সংযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে যাই । বিয়েবাড়ি, অন্নপ্রাশন এসব অনুষ্ঠানে আমরা যেতে পারি না । যেতে হলে খুব কম ক্ষেত্রে অনেক ম্যানেজ করে তার পরে সম্ভব হয় । বাকিদের বোঝাতে পারি না কেন আমরা পারি না । তাঁরা হয়তো মনে করেন, এত কাছের মানুষ হয়েও এল না । কিন্তু এটাই জীবন ।" সায়ন্তন মুখুটি বলেন, "ডিউটি শুরুর করে ফোন সাইলেন্স মোডে করে দিই । ডিউটির মাঝে ফোন এলে সমস্যা হয় । রাতে হয়তো ফোনে পরিবারের সঙ্গে কথা হয় ।" আর ছুটি? তিনি বলেন, "ছুটি ও ভাবে থাকে না । রোজই ডিউটি থাকে । এবং ডিউটি আওয়ার্স বলেও কিছু নেই ।"

এভাবে চলতে চলতে মনের উপর কোনও প্রভাব পড়ে না? অরিজিৎ ঘোষের কথায়, "মনের উপর প্রভাব কিছুটা হলেও পরে । রোজ একই রুটিন চলছে । একইভাবে সকাল থেকে রাত অবধি আমাদের কাজ করে যেতে হচ্ছে । মাঝে মাঝে বাড়িতে ফোন করে ওঠার সময়ও হয়ে ওঠে না ।" বাড়ির সবাই বোঝেন? তিনি বলেন, "বাড়ির সবাই বোঝার চেষ্টা করেন । তাঁরাও জানেন, ডাক্তার হচ্ছি । এই জিনিসগুলি সহ্য করতে হবে ।" আর, জীবনের সঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে? ডাক্তার হয়ে উঠতে উঠতে অনেকেই তো তাঁদের জীবনের সঙ্গীকে খুঁজে নেন । সৃজা রায় বলেন, "আমাদের পুরো সময়টাই কেটে যায় হাসপাতালের ভিতরে । রোগ, রোগী, মৃত্যু । জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলা দেখতে দেখতে ‌। যতদিন আমরা প্রতিষ্ঠিত হই, ততদিনে আমাদের আনন্দ করার বয়স থাকে না । ডাক্তারদের জীবন অনেকটা এরকম, যখন বয়স থাকে, তখন টাকা থাকে না । যখন সময় বা টাকা থাকে, তখন সেই বয়সটা থাকে না ।" সায়ন্তন মুখুটি অবশ্য বলেন, "প্রেম হয়, বিয়ে হয়, একসঙ্গে থাকার ব্যবস্থাও হয় ।"

সরকারি মেডিকেল কলেজে ডাক্তার হয়ে ওঠার জন্য প্রতি সেমিস্টারে সাড়ে চার হাজার টাকার মতো খরচ হয় । যাঁরা হস্টেলে থাকেন, তার জন্য ? মেডিকেল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া নিয়ম অনুযায়ী, হস্টেলের প্রতিটি রুমে তিনজন করে থাকার কথা । অথচ, বহু রুমে রয়েছেন চারজন করে । তাতে অবশ্য তেমন সমস্যা হয় না । এ কথা জানিয়ে অরিজিৎ ঘোষ বলেন, "হস্টেলের জন্য প্রতি মাসে 12 টাকা করে দিতে হয় । তবে আমরা যে খাবার খাই, তা নিজেদের খরচে । কোন বেলায় কোন ধরনের খাবার হবে, তার উপর ভিত্তি করে দাম ঠিক করা হয় ।" এসবের মধ্যেই তাঁদের প্রায় সকলের কাছেই হস্টেল লাইফ মজাদার বিষয় । অরিজিৎ ঘোষের কথায়, "হস্টেল লাইফ সব সময় মজাদার বিষয় । সবাই আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসি । বিভিন্ন রকমের মানসিকতা এবং ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসি । তার পরে হস্টেলে এসে এই সাড়ে পাঁচ বছরে আমরা এক হয়ে যাই । একইভাবে বড় হয়ে উঠি । একইভাবে ডাক্তার হতে শিখি ।" কখনও কোনও বন্ধুর সঙ্গে মনোমালিন্য ? তিনি বলেন, "মনোমালিন্য খুবই কম হয়েছে । হস্টেলে আসার পর থেকে আমরা একটা পরিবারের মতো গড়ে উঠেছি । এটা, জাস্ট লাইক আ হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম ।"

একই সঙ্গে তিনি বলেন, "যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে একসঙ্গে আছি, হস্টেলের সমস্যা হোক । কলেজের সমস্যা হোক, প্রতিটি পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে আমরা একসঙ্গে থেকেছি, লড়ে গেছি । বন্ডিংটা তাই আরও বেড়েছে ।" ইন্টার্নশিপের সময় হস্টেলে সেভাবে সময় কাটাতে পারেন না তাঁরা, যেভাবে প্রথম সাড়ে চার বছর ছাত্র অবস্থায় সময় কাটানো যায় । তবুও এরই মাঝে, ইন্টার্নদের সঙ্গে একই ঘরে যেমন থাকেন বিভিন্ন বর্ষের পড়ুয়ারা অর্থাৎ যাঁরা প্রথম সাড়ে চার বছরের পড়াশোনার মধ্যে রয়েছেন । তেমনই, খেলা বা অন্য কোনও বিনোদনের জন্য স্মার্ট ফোন থাকতেও, প্রচণ্ড পরিশ্রম আর ব্যস্ততার মাঝে সময় পেলে কখনও কমন রুমে টিভিতে কিছুটা সময় হলেও জমিয়ে উপভোগ করেন খেলা । তেমনই, জুনিয়র সিনিয়রদের মধ্যে ধীরে ধীরে পোক্ত হতে থাকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ।

এত কিছুর পরেও যখন বিভিন্ন সময় রোগীর ক্ষুব্ধ পরিজনদের কাছে আক্রান্ত হতে হয় জুনিয়র ডাক্তারদের ? অরিজিৎ ঘোষ বলেন, "ডাক্তারি পড়তে আসার আগে স্বপ্ন থাকে । তার পরে গোটা এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিশ্রম রয়েছে । এর পরেও যখন আমরা হাসপাতালে যায়, রোগীর সংখ্যার তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম থাকে। ডাক্তারদের উপর অমানবিক চাপ থাকে । অমানবিক পরিশ্রম হয় । এর পাশাপাশি হাসপাতালের বেডে সংখ্যাও খুব কম । মেঝেতে রোগীদের ভর্তি করাতে হয় । এই ধরনের পরিস্থিতিতে, যা চিকিৎসা-সরঞ্জাম আছে, সব কিছু দিয়ে সাধ্যমতো সব রকম চিকিৎসার পরেও যখন এই জিনিসগুলি হয় তখন খুব খারাপ লাগে । ডাক্তার হিসাবে নিজেদের খারাপ লাগে । তখন এই সিস্টেমটাকে দায়ি করা ছাড়া আমাদের অন্য আর কোনও উপায় থাকে না‌ ।" সৃজা রায় বলেন, "খারাপটা ওই কারণেই লাগে । প্রফেশনটাকে ভালবেসেই আমরা এসেছি। যখন থেকে এসেছি তখন থেকেই আমরা জানতাম অনেক বেশি খাটতে হবে, অনেক পরিশ্রম করতে হবে। ডাক্তারদের পরিবার, জীবন অনেক ক্ষেত্রেই থাকে না । এগুলো জেনে বুঝেই এসেছি। কিন্তু যাঁদের জন্য এসেছি, তাঁরা যদি আমাদের খারাপ ভাবেন, তখন খারাপ লাগে । সত্যিই খারাপ লাগে ।"

একই সঙ্গে তিনি বলেন, "সবাই খারাপ নন । ওয়ার্ডে প্রচুর রোগী থাকেন যাঁরা আমাদের ভালোবাসেন । কিন্তু সব কিছুতেই কিছু না কিছু খারাপ থাকে । রোগীরা খারাপ হন না । সাধারণত আমরা দেখেছি রোগী বা তাঁর বাড়ির লোকরা যে খুব বেশি ঝামেলা করেন, এরকম হয় না । তাঁদের সঙ্গে অন্য লোকরা আসেন । তাঁরা বেশি ঝামেলা করেন ।" সমাধানের কোনও পথ? এই জুনিয়র ডাক্তার বলেন, "সমাধান বলতে মনে হয়, সবার মধ্যে সচেতনতা দরকার । অন্ততপক্ষে মানুষকে বুঝতে হবে কোনও দিনও কোনও ডাক্তার কাউকে মারতে চান না । আমরা জীবন বাঁচাতে শিখেছি । মারতে শিখিনি । কিছু কিছু ক্ষেত্রে হতে পারে আমরা বাঁচাতে পারলাম না । মানুষের মধ্যে এই অ্যাওয়ারনেসটা তৈরি হলে আমাদেরও ভালো লাগবে । ডাক্তারের প্রতি বিশ্বাস থাকা দরকার । যা কিছু করছেন তিনি রোগীর ভালোর জন্য করছেন । আমার মনে হয় যে, প্রশাসনিক স্তর থেকে এই বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তাহলে ভালো হয় ।" তিনি বলেন, "আমরা অনেক ক্ষেত্রে যেমন, সিনেমায় দেখেছি, ডাক্তাররা খুবই অর্থলোভী । এমনভাবে দেখানো হয় । কেউ কেউ থাকতেই পারেন । সব কিছুতেই কিছু না কিছু খারাপ থাকে । কিন্তু সরকারি হাসপাতালে সামান্য বেতন । তবুও এমন ডাক্তাররাও আছেন যাঁরা বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে থাকলে কোটিপতি হয়ে যেতে পারতেন । শুধু হাসপাতালকে ভালবেসে এখনও এখানে রয়েছেন । তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কষ্টকর হয় যখন এই রকম ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় ।" অরিজিৎ ঘোষ বলেন, "প্রশাসনিক ভাবে পুরো বিষয়টির উপর যদি কঠোর নজরদারি করা হয়, রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, চিকিৎসা-সরঞ্জামের জোগাড় দেওয়া হয় । এমন যদি করা হয়, মেঝেতে রোগী থাকবে না । শুধু বেডেই থাকবে । রোগী এবং ডাক্তারের অনুপাত যদি ঠিক হয় । তা হলে মনে হয় ভবিষ্যতে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে না । নিরাপত্তা বাড়ানো, যাঁরা এই ধরনের কাজ করে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার খুবই দরকার ।"

সম্প্রতি ডাক্তারদের আন্দোলন হয়েছিল । তাঁরা বার বার বলেছেন এই আন্দোলন রোগী বিরোধী নয় । রোগীকে ভালোভাবে চিকিৎসা দিতে চান ডাক্তাররা । এ কথা জানিয়ে সায়ন্তন মুখুটি বলেন, "কিন্তু ওই সব সমস্যার কারণে, আমরাও যতটা চাই ততটা দিতে পারি না । এই সব কিছুর যদি উন্নতি হয়, তাহলে কোনও একদিন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে যাবে ।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "আমার মনে হয় না এটা রোগীর বাড়ির লোকদের সমস্যা । আসলে এটা সিস্টেমের সমস্যা । স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যদি তিনটি স্তম্ভ ডাক্তার, রোগী এবং তার সঙ্গে অথরিটি বা সরকার থাকে । এখানে ডাক্তার এবং রোগী কোনওভাবেই নিজেরা নিজেদের শত্রু নয় । রোগীরা সেরা চিকিৎসা নিতে আসেন মেডিকেল কলেজে । আমরাও চিকিৎসা পরিষেবা দিতে চাই। রোগীরা ভেবে আসেন সব কিছুই ফ্রি । তার পর এখানে দেখেন, সবটা ফ্রি নয় । ইমারজেন্সিতে এত বেশি সংখ্যক রোগীর ভিড়, সেখানে তিনজন ডাক্তার তা সামলান । তিন জনের পক্ষে সামলানো সম্ভব নয় । আমরাও মানুষ । সেখানেই হয়তো একটু প্রবলেম হল ।"

তিনি বলেন, "রোগীর বাড়ির লোকজন বা রোগী দেখেন সামনে ডাক্তার আছেন । নার্স আছেন । কোনও স্বাস্থ্যকর্মী আছেন । রাগটা তাঁদের উপরে গিয়ে পড়ে । কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোনওভাবেই ডাক্তার বনাম রোগী নয় । স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডাক্তার এবং রোগী একই সঙ্গে থাকেন । আসলে কর্তৃপক্ষের সমস্যা । যদি আরও ভালো পরিকাঠামো হত । যদি আরও একটু বেশি ডাক্তারের সংখ্যা হত, তাহলে রোগীরা অনেক ভালো পরিষেবা পেতেন । ডাক্তাররাও অনেক ভালো পরিষেবা দিতে পারতেন ।" রোগী এবং ডাক্তারের মধ্যে আগের মতো সম্পর্ক আর নেই । অবনতি হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে । এই বিষয়ে কী বলবেন ? সৃজা রায় বলেন, "আগে আমরা সবসময় চেষ্টা করতাম । সমস্যা কী হচ্ছে তা জেনে, কীভাবে সমাধান করা যায় । তার জন্য সব রকম চেষ্টা করতাম । এখন আমরা অনেক আইন দেখে কাজ করি । বিশ্বাস অনেক চলে যাচ্ছে ।" আইনের জন্য? তিনি বলেন, "না । আইন থাকা উচিত । আইন মানা না হলে জিনিসটি আরও খারাপ হবে । সাধারণ মানুষের বোঝা উচিত, বিশ্বাস করে ডাক্তারের কাছে এসেছেন রোগী । সব কিছু দেখে রোগীর ভালো বুঝলাম বলেই কোনও ওষুধ দিচ্ছি আমরা । ডাক্তারের উপরে বিশ্বাস থাকতে হবে যে, ডাক্তার যেটা করছেন, ভালর জন্যই করছেন ।"

Last Updated : Jul 1, 2019, 3:49 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.