কলকাতা , 27 জুন : কেউ খোঁজ রাখেনি । চাহিদা ফুরোলে ইতিহাসকে কেই বা মনে রাখতে চায় । ভারত থেকে প্রকাশিত একমাত্র চিনা সংবাদপত্র “সেও পও"-র ক্ষেত্রে কথাটা বোধ হয় রূঢ় বাস্তব । কলকাতায় বসবাসকারী চিনা বংশোদ্ভূতদের জন্য এই সংবাদপত্র চালু করা হয়েছিল । কিন্তু এই চিনা বংশোদ্ভূতরা আর সেভাবে চিনা ভাষা শেখেন না । জেনারেশন ওয়াই এখন ইংরেজিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য । সঙ্গে হিন্দি আর কাজ চালানোর বাংলা । ভাষার কদর কমার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে । একটু একটু করে কমে গেছে দেশের একমাত্র চিনা ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের চাহিদা । যে শ'দুয়েক কাগজ ছাপা হত , লকডাউনে তাও বন্ধ ।
1962-র যুদ্ধ দেখেনি “সেও পও"। 1969 সালের 10 মার্চ কলকাতার মাটিতে জন্ম হয়েছিল “দি ওভারসিজ় চাইনিজ় কমার্স অফ ইন্ডিয়া" বা “সেও পও"-এর । তখন ট্যাংরা এলাকায় চামড়ার রমরমা কারবার । সে কারবার চিনাদের । 1778 সালে চিনের নাগরিক ওয়াং চাউ আসেন কলকাতায় । তিনি ছিলেন কলকাতায় আসা প্রথম চাইনিজ় । মূলত চিনের হাক্কা প্রদেশের বাসিন্দা ছিলেন তিনি । ট্যাংরা এলাকায় ঘাঁটি গাড়েন । পরে আরও কয়েকটি চিনা পরিবার আসে । তাঁরা চামড়ার ব্যবসা শুরু করেন । সে কারবার বংশপরম্পরায় চলতে থাকে । একটা সময় কলকাতার বাবুরা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সরকারি দপ্তর থেকে ফেরার সময় চৌরঙ্গি থেকে কিনে আনতেন জুতো । সে জুতো তৈরি করত চিনেরা । আজও ওই চত্বরে রয়ে গেছে কয়েকটি চিনা বংশোদ্ভূতদের জুতোর দোকান । একটা সময় এই দোকানগুলি ছিল কলকাতার বাবু কালচারের অন্যতম অঙ্গ ।
এখন দেশের একমাত্র চায়না টাউনে যে রেস্তরাঁগুলি রয়েছে , তার মধ্যে অন্যতম হট ওক ভিলেজ রেস্তরাঁ । চায়না টাউনের অন্যতম প্রাচীন রেস্তরাঁও বটে । তার বর্তমান মালকিন জেসিকা লি-র ঠাকুরদা লি ইউন চিন চামড়া শিল্পে বিপ্লব এনেছিলেন । কলকাতায় বসবাসকারী চিনা বংশোদ্ভূতদের নেতা হয়ে উঠেছিলেন । তাঁর বাড়ির কাছেই ছয় নম্বর ট্যাংরা রোডে গড়ে তোলেন চাইনিজ় ট্যানারি ওনার অ্যাসোসিয়েশন । 1969 সালের 10 মার্চ লি ইউন চিনের হাত ধরে দিনের আলো দেখে “সেও পও"। যা প্রকাশিত হয় মান্দারিন ভাষায় । এই ভাষা কলকাতায় বসবাসকারী চিনা বংশোদ্ভূতদের কথ্য ভাষা হাক্কার লিখিত রূপ । প্রথমে সেই সংবাজপত্রে শুধুই ব্যবসা সংক্রান্ত খবর থাকত । হাতে লিখেই প্রকাশিত হত খবর । 1988 সাল পর্যন্ত এইভাবেই চলে । কিন্তু মাঝখানের সময়টায় বদলে যায় এই সংবাদপত্রের বিষয় । চিন, তাইওয়ান , হংকংয়ের রাজনৈতিক খবর ঠাঁই পেতে শুরু করে এই সংবাদপত্রে । সঙ্গে স্থানীয় চিনা বংশদ্ভূতদের জন্ম-মৃত্যু কিংবা বিয়েও ঠাঁই পায় “সেও পও"-এ । ধীরে তা হয়ে ওঠে ভারতে বসবাসকারী চিনা বংশোদ্ভূতদের গর্ব ।
1988 সালে ট্যাংরা এলাকার এক ব্যবসায়ী চিনের তাইওয়ান প্রদেশ থেকে একটি চিনা ভাষার DTP মেশিন কিনে আনেন । সেটি উপহার হিসেবে দেন "সেও পও"-কে । হাতে লেখা সংবাদপত্র উন্নীত হয় ছাপার অক্ষরে । পরে এই সংবাদপত্রের চতুর্থ সম্পাদক হন কে টি ছ্যাং । তাঁর সহকারী হেলেন ইয়ং । ছ্যাং একজন প্রাক্তন ট্যানারি কর্মী । প্রসঙ্গত , নব্বইয়ের দশকে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ট্যাংরা এলাকায় বন্ধ হয়ে যায় সব ট্যানারি । কলকাতার চিনা বংশোদ্ভূতরা মনে করেন , সেটাই তাঁদের জন্য দুর্ভাগ্যের সূচনা । ছ্যাং দায়িত্ব নেওয়ার পর চার পাতার ট্যাবলয়েড খবরের কাগজের খবরে আসে বৈচিত্র্য । মূলত চিন , তাইওয়ান , ম্যাকাও , হংকংয়ের খবর ঠাঁই পেতে শুরু করে এই সংবাদপত্রে । কারণ আজও চিনা বংশোদ্ভূতদের বয়স্করা সেদেশের খুঁটিনাটি খবর পেতে ভীষণভাবে আগ্রহী । আর সেটাই ওই সংবাদপত্রের জিওন কাঠি ।
ভারত-চিন যুদ্ধের আবহে সেই সংবাদপত্রের অফিস অর্থাৎ ছয় নম্বর ট্যাংরা রোডে গিয়ে দেখা গেল , সেটি একেবারে তালাবদ্ধ । ঘরের চারপাশে জমেছে ধুলো । এদিক-ওদিক পড়ে রয়েছে খালি দেশি মদের বোতল । অর্থাৎ অফিস দীর্ঘদিন খোলা হয়নি । লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ । অভিযোগ, এখন এখানে চলে অসামাজিক কাজকর্ম । দেশের একমাত্র চিনা সংবাদপত্রের সম্পাদক ছ্যাং এখন অসুস্থ । তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি । সেক্ষেত্রে চাইনিজ় ইয়ুথ ক্লাবের সম্পাদক খই কুইয়ের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানালেন , এই মুহূর্তে ছ্যাংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব নয় । তিনি অসুস্থ । অন্যদিকে তাঁর সহকারী হেলেনর সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে দেন তিনি । বলেন , “ কারও সঙ্গেই কথা বলা সম্ভব নয় ।" চায়না টাউনের অলিতে-গলিতে ঘুরে সেও পও-এর বিষয়ে কথা বলতে চাইলে প্রত্যেকেই মুখের উপর দরজা বন্ধ করেছেন । কিন্ত কেন ?
ভারতের রেজিস্ট্রার অফ নিউজ় পেপারের ওয়েবসাইটে সহজেই দেখা যায় যে কোনও রেজিস্ট্রেশন পাওয়া সংবাদপত্রের খতিয়ান । সেখানে “দি ওভারসিজ় চাইনিজ় কমার্স অফ ইন্ডিয়া " বা “সেও পও"-এর কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি । অর্থাৎ ভারত সরকারের স্বীকৃত নয় এই সংবাদপত্র । সেটাই কি কারণ ? ক্যামেরার সামনে কথা বলতে অনিচ্ছুক এক যুবক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে শোনালেন অন্য এক অধ্যায় । বললেন , “1962-র যুদ্ধ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে ভারতে বসবাসকারী চিনা বংশোদ্ভূতদের । সেই সময় তাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল অন্য একটি সংবাদপত্র । তার নাম ছিল “দা চায়না রিভিউ " । তখনও কলকাতায় বসবাসকারী চিনা বংশোদ্ভূতরা এই দেশের নাগরিকত্ব পায়নি । “দা চায়না রিভিউ" তখন নয়নের মণি । চিন যুদ্ধের পরেই 1963 সালে সেই পত্রিকার অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয় । আমরা এখনও বিশ্বাস করি তখন আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল । বছরের-পর-বছর বংশানুক্রমে ভারতে থাকার পরেও আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সেই প্রশ্নের জেরেই বন্ধ করে দেওয়া হয় সেই সংবাদপত্র । সেও পওয়ের সঙ্গে যাতে তেমন কিছু না হয় সেই কারণেই কেউ কথা বলছেন না । "
কলকাতার চিনা নাগরিকদের একটা বড় অংশ থাকেন টেরিটি বাজার এলাকায় । সেখানেও ক্যামেরার সামনে কথা বলতে নারাজ অনেকেই । তার মাঝে আইয়ুব লি বলছিলেন , “ দেখুন এখন অনেকেই চিনা ভাষা পড়তে পারে না । পরের প্রজন্মের সকলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেছে । আমরা তাই ইংরেজি নিউজ় পেপার পড়ি । তবে ওভারসিজ় আমাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল । বয়স্করা ওই পেপার পড়েন । লকডাউনের জন্য তাও বন্ধ হয়ে গেছে । লকডাউন শেষ হলে নিশ্চয়ই তা খোলা হবে । " মাইকেল নামে এক জুতোর দোকানদার বলছিলেন , “ আমরা ইংরেজি কাগজেই অভ্যস্ত । লকডাউনের জন্য "সেও পও" বন্ধ রয়েছে । "