কলকাতা, 3 অগাস্ট : দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোরোনা মোকাবিলায় শুরু হয়েছে প্লাজ়মা থেরাপি ৷ কতটা কার্যকর হচ্ছে এই পদ্ধতি, তা জানতে নজর রাখা হচ্ছে রোগীদের শারীরিক গতিবিধির উপর ৷ কলকাতাতেও শুরু হয়েছে প্লাজ়মা থেরাপি ৷ কোন কোন রোগীর শরীরে প্লাজ়মা থেরাপি কাজ করছে তা দেখা হচ্ছে ৷ কলকাতায় মে থেকে শুরু হয় প্লাজ়মা থেরাপির ট্রায়াল ৷ সম্প্রতি এই ট্রায়ালের অন্তর্বর্তী রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে ৷ তাতে বলা হয়েছে, কোনও কোরোনা রোগীকে সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে প্লাজ়মা থেরাপির প্রয়োগ আশাপ্রদ ৷ কয়েকজন কোরোনা রোগীর শরীরে খুব ভালোভাবে কাজ করছে এই বিশেষ পদ্ধতি ৷
কোরোনা রোগীদের উপর এই প্লাজ়মা থেরাপির ট্রায়াল চলছে কলকাতার ইনফেকশাস ডিজ়িজ়েস অ্যান্ড বেলেঘাটা জেনারেল (ID&BG) হাসপাতালে । আর এই ট্রায়ালের জন্য প্লাজ়মা সংগ্রহ করা হচ্ছে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে চলছে এই ট্রায়াল । তবে দেশের অন্যান্য জায়গায় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (ICMR)-এর প্লাজ়মা থেরাপির ট্রায়ালের থেকে কিছুটা আলাদা কলকাতার ট্রায়াল ব্যবস্থা । ICMR-এর ট্রায়ালে মাইল্ড ARDS (অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিজ়িজ় সিনড্রোম)-এর কোরোনা রোগীদের উপর প্লাজ়মা থেরাপির প্রয়োগ করা হচ্ছে । তবে কলকাতায় যে ট্রায়াল চলছে তাতে মাইল্ড ARDS এবং মডারেট ARDS কোরোনা রোগীদের উপর প্লাজ়মা থেরাপির প্রয়োগ করা হচ্ছে । কলকাতার এই ট্রায়ালে রোগীর ন্যূনতম বয়স হতে হচ্ছে 18 বছর ।
কোরোনা রোগীদের উপর প্লাজ়মা থেরাপির র্যান্ডামাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল করা হচ্ছে কলকাতায় । অর্থাৎ একই ধরনের রোগীদের বেছে নিয়ে তাঁদের মধ্যে একটি দলের উপর প্লাজ়মা থেরাপির প্রয়োগ করা হচ্ছে । অন্য দলটির উপর প্লাজ়মা থেরাপির প্রয়োগ না করে দেখা হচ্ছে । এই ট্রায়ালে যে সব বিষয় দেখা হচ্ছে সেগুলির মধ্যে রয়েছে, প্লাজ়মা দিয়ে কোনও লাভ হচ্ছে কি না, রক্তের কোন গ্রুপের ক্ষেত্রে লাভ হচ্ছে ৷ পাশাপাশি কারও ক্ষেত্রে প্লাজ়মা কাজ না করলে তা কেন কাজ করল না তাও দেখা হচ্ছে । ইমিউনোলজিক্যালি কোনও সমস্যার কারণে প্লাজ়মা থেরাপি ব্যাহত হচ্ছে কি না তাও দেখা হচ্ছে ।
কলকাতায় কোরোনা রোগীদের উপর প্লাজ়মা থেরাপির এই ট্রায়ালের জন্য আর্থিক সহায়তা করছে কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (CSIR)। ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনেরাল অফ ইন্ডিয়া (DCGI)-র অনুমোদন নিয়ে চলছে এই ট্রায়াল। সম্প্রতি প্লাজ়মা থেরাপির এই ট্রায়ালের অন্তর্বর্তী রিপোর্ট CSIR, DCGI এবং স্বাস্থ্য দপ্তরে পেশ করা হয়েছে । প্লাজ়মা থেরাপির ট্রায়ালের অন্তর্বর্তী এই রিপোর্টের বিষয়ে ID&BG হাসপাতালের কোর COVID-19 টিমের একজন সদস্য তথা এই ট্রায়ালের ক্লিনিক্যাল পর্যবেক্ষক, চিকিৎসক যোগীরাজ রায়ের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "এই ট্রায়ালের মাঝপথে আমরা এখন আছি । এই অবস্থায় ট্রায়ালে বিষয়ে বলা যায় না ।" তবে, এই ট্রায়ালে সকলের লাভ হচ্ছে না ৷ কিছু শতাংশের ক্ষেত্রে লাভ হচ্ছে । কিছু শতাংশের ক্ষেত্রে কোনও লাভই হচ্ছে না । এ কথা জানিয়ে ইনফেকশাস ডিজ়িজ়েস স্পেশালিস্ট এই চিকিৎসক বলেন, "কোন মানুষের ক্ষেত্রে প্লাজ়মা কাজ করবে, কোন মানুষের ক্ষেত্রে কাজ করবে না, এটা আমরা এই ট্রায়াল থেকে খুঁজছি । এটা একটা কঠিন ট্রায়াল ।"
চিকিৎসক যোগীরাজ রায় বলেন, "আমরা যদি অনুমান করতে পারি কার ক্ষেত্রে প্লাজ়মা ভালো কাজ করবে তা হলে খুব ভালোভাবে কাজ হতে পারে । অনেক বড় পরিসরে এই ট্রায়াল হচ্ছে । এর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় জড়িত রয়েছে ।" তিনি বলেন, "প্লাজ়মা থেরাপিতে কারা সাড়া দেবেন, কারা সাড়া দেবেন না, এই ট্রায়ালে আমরা এমন মানুষের খোঁজ করছি । এর ফলে, যদি দেখা যায় আমাদের কাছে 500 প্লাজ়মা রয়েছে তা হলে ঠিক গ্রুপকে দেওয়া যাবে ।" তিনি বলেন, "প্লাজ়মা দিলে লাভ হচ্ছে কি না সবাই এটা দেখছেন । কাকে প্লাজ়মা দেওয়া হলে লাভ হবে, কাকে দিলে হবে না, আমরা সেটা খোঁজার চেষ্টা করছি ।" এই ট্রায়ালের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর তথা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিকেল বায়োলজি (IICB)-র ট্রানসলেশনাল রিসার্চ ইউনিট অফ এক্সেলেন্স-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "এই ট্রায়ালের অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে । এখনও পর্যন্ত এই ট্রায়ালের ছবি যতটা স্পষ্ট হয়েছে, তার রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে । এটা প্রমিসিং ।" তিনি বলেন, "প্লাজ়মা দিলে কাজ করে কি না, শুধুমাত্র এটা দেখা নয়, আমরা প্রথম থেকেই ধরে রেখেছি, সকলের ক্ষেত্রে প্লাজ়মা দিলে কাজ করবে না । এই স্টাডির লক্ষ্য এবং প্রাথমিক ফলাফলও তাই ।"
IICB-র এই অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বলেন, "প্লাজ়মার সাড়া কতটা পাওয়া যাবে তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে কি না । এই ট্রায়ালে এটা দেখার চেষ্টা করব । তবে, এই ধরনের তথ্য পাওয়ার সময় এখনও হয়নি । এর জন্য আরও রোগীর উপর প্রয়োগ করতে হবে । হেটরোজেনিটি অর্থাৎ রোগীর বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখতে হবে । দশটি ক্ষেত্রে ট্রান্সফিউশন হয়েছে । এই সংখ্যার উপর এটা আসবে না ।" এই ট্রায়ালের বিষয়ে তিনি বলেন, "যেটা মনে হচ্ছে, প্লাজ়মা থেরাপি যদি করা হয় তা হলে বেশ কিছু রোগী খুব ভালোভাবে রিঅ্যাক্ট করে । চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য এটা আশাপ্রদ বিষয় ।" জানা গেছে, এত দিনের মধ্যে ট্রায়াল শেষ করা সম্ভব হবে, সেটা প্রথমে মনে করা হয়েছিল । তবে, শুরুর দিকে প্লাজ়মা সংগ্রহের জন্য ডোনারদের মোটিভেট করতে হয়েছে । আগের তুলনায় ডোনাররা এখন একটু মোটিভেট হয়েছেন । তবে এখনও যে খুব বেশি ডোনার পাওয়া যাচ্ছে, তা নয় । দীপ্যমানবাবু বলেন, "সব ধরনের গ্রুপের প্লাজ়মা থাকবে, তা হলে এক এক করে রোগীকে তা দেওয়া যাবে, এই পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি । তবে আশা করা হচ্ছে মাস দু'য়েকের মধ্যে শেষ করা যাবে এই ট্রায়াল ।"
এই ট্রায়ালের জন্য প্রতিটি গ্রুপের প্লাজ়মা প্রয়োজন । কারণ কোনও রোগীর ক্ষেত্রে রক্তের যে গ্রুপ, সেই গ্রুপের প্লাজ়মা তাঁকে দিতে হবে । কলকাতায় এই প্লাজ়মা থেরাপির ট্রায়াল শুরু করার আগে প্লাজ়মা সংগ্রহের জন্য ডোনারদের বোঝানো হয়েছে, যাতে তাঁরা প্লাজ়মা দান করতে এগিয়ে আসেন । কোনও কোরোনা রোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার 28 দিন পর তিনি প্লাজ়মা দান করতে পারবেন । যাঁরা সুস্থ হয়ে গেছেন এবং তার পর 28 দিন পেরিয়ে গেছে, এখনও পর্যন্ত এমন প্রায় 200 জনকে প্লাজ়মা দান করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে । তাঁদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত 21 জন প্লাজ়মা দান করেছেন । অনেকে যেমন প্লাজ়মা দান করার জন্য আসতে পারেননি তেমনই বিভিন্ন কারণে অনেকে আবার প্লাজ়মা দান করতে রাজি হননি । ওই সব কারণের মধ্যে ফের কোরোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও রয়েছে । এদিকে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ যাতে প্লাজ়মা দান করতে এগিয়ে আসে তার জন্য প্রচার চালানো হচ্ছে । এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে আশার কথা শুনিয়েছেন IICB-র এক গবেষক সন্দীপ পাল। তিনি বলেন, "শুরুর দিকে সমস্যা হচ্ছিল । তবে এখন অনেক মানুষকে বোঝানো সম্ভব হচ্ছে । সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক, পুলিশকর্মীরাও প্লাজ়মা দান করছেন ।" তিনি জানিয়েছেন, যিনি প্লাজ়মা দান করবেন প্রথমে তাঁর স্ক্রিনিং করা হয় । স্ক্রিনিংয়ে প্লাজ়মা দানের জন্য বিবেচিত হলে তা সংগ্রহ করা হয় । প্লাজ়মা দান করার জন্য অহেতুক ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই ।