কলকাতা, 1 জুন : রাজ্য থেকে নারদ মামলা ভিন রাজ্যে সরানোর জন্য দিনভর একের পর এক যুক্তি সাজালেন সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা ৷ তবে আজও কোনও সমাধান বেরল না ৷ আগামীকাল অর্থাৎ বুধবার নারদ মামলার পরবর্তী শুনানি হবে কলকাতা হাইকোর্টে ৷ আজ ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সহ পাঁচ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলার শুনানি হয় ৷
আজ শুনানির শুরুতেই সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা বলেন, "কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত করছে ৷ কিন্তু নারদ মামলা নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে । সিবিআই শুধু মাত্র চার অভিযুক্তের জামিন খারিজের আবেদন করেনি । আমরা চাই গ্রেফতারের পর এখানে যা ঘটেছে সমস্তকেই কলুষিত, বিকৃত বলে ঘোষণা করুক কলকাতা হাইকোর্ট । এবং তা করতে গিয়ে যদি চার অভিযুক্তের জামিন খারিজ হয়ে যায় তাহলে সেটা করুক আদালত ।"
সলিসিটর জেনারেল আরও বলেন, "গ্রেফতারের পরে যা হয়েছে তা দেশ তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসে কখনও হয়েছে কি না সন্দেহ আছে । ক্যাবিনেটের সদস্যরা গিয়ে ধর্না দিচ্ছেন, বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, এর থেকে লজ্জার আর কিছু হয় না । পরিকল্পিত এবং সংগঠিতভাবে লোক নিয়ে এসে সিবিআই অফিস ঘেরাও করা হয়েছিল পাথর ছোড়া হয়েছিল । মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা ধর্নায় বসেছিলেন ৷"
তখন বিচারপতি সৌমেন সেন সলিসিটর জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, "চার্জশিট কি আপনারা অনলাইনে জমা করেছিলেন নাকি সিবিআই আধিকারিকরা আদালতে গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন?" সলিসিটর জেনারেল জানান, অনলাইনেই চার্জশিট জমা করা হয়েছিল । তখন আর এক বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বলেন, "ঠিক কোন সময়ে চার অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ৷ সাধারণ মানুষ কখন থেকে সিবিআই দফতরের সামনে ঘেরাও করতে শুরু করে, এই তথ্যগুলো আদালতকে দিতে হবে ৷ কারণ এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ।"
এরপর সলিসিটর জেনারেল বলেন, ‘‘সেদিন যা করা হয়েছিল তাতে গোটা ঘটনায় বিচার ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল ৷ যে মন্ত্রীরা সেদিন ঘেরাও করেছিলেন তাঁরা শুধু সাধারণ মানুষ নন, সাংবিধানিক পদের অধিকারীও । এ রাজ্যে যখনই উঁচু পদে থাকা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তখনই এই ধরনের পরিকল্পিত বিক্ষোভ এবং হামলার ঘটনা ঘটে । মদন মিত্রকে গ্রেফতারের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল ৷’’
তখন বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে চান, সেই সময় কি অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনের আবেদন করেছিলেন এবং করে থাকলে সে আবেদনটি মঞ্জুর হয়েছিল? এর উত্তরে সলিসিটর জেনারেল বলেন, ‘‘রাজীব কুমারের বাড়িতে যখন সিবিআই গিয়েছিল তখন তাঁদের হেনস্থা হতে হয়েছিল । হুমকি দেওয়া হয়েছিল ৷ পরে ধর্না দেওয়া দেওয়া হয়েছিল ৷ সিজিও কমপ্লেক্সের বাইরেও দীর্ঘদিন ঘেরাও কর্মসূচি চলেছিল ।"
বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বলেন , ‘‘এই ঘেরাও বা ধর্নার সঙ্গে যদি অভিযুক্তদের প্রত্যক্ষ যোগ বা মদতের প্রমাণ না থাকে তাহলে এদের জামিন কেন বাতিল করা হবে ?’’বেঞ্চের আর এক বিচারপতি সৌমেন সেন সলিসিটর জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আগে যে ধর্না বা ঘেরাও এর কথা বলছেন সেই সময় যদি বিচার ব্যবস্থা প্রভাবিত না হয়ে থাকে তাহলে সেই উদাহরণ এখন কীভাবে যুক্তিসঙ্গত?’’এর প্রত্যুত্তরে সলিসিটর জেনারেল বলেন, ‘‘বিভিন্ন সময় কেন্দ্রের এবং রাজ্যের মন্ত্রীরা গ্রেফতার হয়েছেন ৷ রাজনৈতিক চক্রান্তের অভিযোগ উঠেছে ৷ কিন্তু কখনও আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশে বা অন্য কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি ।’’
আরও পড়ুন : প্রোটোকল ভেঙে আলাপন বিতর্কে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন মমতা, বলছে কেন্দ্র
সলিসিটর জেনারেল আরও বলেন," বিক্ষোভ, ধর্না, রাজ্যের মন্ত্রীদের অবস্থান চাপের রাজনীতি এসব থেকে নিম্ন আদালতের বিচারক নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পেরেছিলেন কিনা সেটা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে ।" ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সলিসিটর জেনারেলের উদ্দেশ্যে তখন প্রশ্ন করেন ,"আপনি বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাইছেন?’’ সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা বলেন," বিচারপতিকে শুধু নিরপেক্ষ হলে হবে না নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সবকিছু দেখা দরকার ।" বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় তখন সলিসিটর জেনারেলের উদ্দেশ্যে বলেন," আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা খোলা । ওপেন কোর্টে বিচার হয় । সেখানে যে কেউ উপস্থিত থাকতে পারেন । কে হাইপ্রোফাইল কে লো প্রোফাইল তাই দিয়ে বিচার প্রক্রিয়া নির্ধারিত হয় না । পাশাপাশি যে কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখানোর অধিকার মানুষের আছে । তাহলে বিচারক কীভাবে প্রভাবিত হবেন?"
পাশাপাশি বিচারপতি সৌমেন সেন বলেন," মামলা রুদ্ধদ্বার কক্ষে হয়েছে । ভার্চুয়ালি হয়েছে । বিচারককে প্রভাবিত করার সুযোগ কীভাবে হল? " তখন সলিসিটর জেনারেল বলেন," কয়েক হাজার মানুষ পাথর ছুড়েছেন, ইট ছুড়েছেন এই পরিস্থিতিতে সিবিআই আধিকারিকরা কী করবেন?" তখন বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বলেন," যদি আপনাদের মনে হয় এতই অনিয়ম হয়েছে, তাহলে সিবিআই কেন মামলা মুলতবি করার জন্য বিচারককে বলেননি?" এরপরই আজকের মতো শুনানির শেষের কথা ঘোষণা করা হয় ৷