কলকাতা,6 অক্টোবর : দিনের বেলা দাউ দাউ করে জ্বলছে বি টি রোডের টিটাগড়ের অঞ্চল । এলাকার দোকান পাট বন্ধ । থমথমে পরিবেশ । কী কারণে উত্তপ্ত হল ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল । কেন খুন হলেন এলাকার পরিচিত 'মস্তান' 'অপরাধী' মণীশ শুক্লা ? হঠাৎই ? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা না কি কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতায় দীর্ঘ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ।
মণীশ শুক্লার খুনের পর রাজ্য রাজনীতি মহলে তোলপাড় শুরু হয়েছে । কে এই মণীশ শুক্লা, তা নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে । 5 অক্টোবর রাতের নৃশংস ঘটনার পর থেকেই সরব হয়েছে BJP । রাজ্যপাল স্বরাষ্ট্রসচিব এবং রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশককে রাজভবনে ডেকে পাঠান । এরপরই প্রশ্ন উঠছে মণীশ শুক্লার পরিচয় নিয়ে ।
এক সময় ব্যারাকপুরের সাংসদ তড়িৎবরণ তোপদারের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন মণীশ শুক্লা । রাজ্যে পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে শিবির বদল করেন । তড়িৎ তোপদারকে ছেড়ে অর্জুন সিংয়ের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন ।
ব্যারাকপুর অঞ্চলের CPI(M) কর্মী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন । 2004 সাল থেকেই তড়িৎ তোপদারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মণীশ । CPI(M) এই প্রাক্তন সাংসদের ইলেকশন মেশিনারির অন্যতম কারিগর ছিলেন মণীশ । 2009 সালে লোকসভা ভোটের দিন CPI(M)-র হয়ে বুথ দখল করার অভিযোগ ওঠে মণীশের বিরুদ্ধে ।
বামফ্রন্ট শাসনকালের শেষদিকে পুলিশের উপর তেমন নিয়ন্ত্রণ ছিল না । তৎকালীন রাজ্যের প্রধান বিরোধী তৃণমূল গ্রাস করে নিয়েছিল অনেকটাই । মণীশের টিটাগড়ের বাড়িতে পুলিশ একাধিকবার তল্লাশি চালিয়েছে ।
রাজ্যে যে পালাবদল আসতে চলেছে সে কথা বুঝতে পারেন মনীশ । অর্জুন সিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান । বাম শাসনকালে শেষ লোকসভা নির্বাচনে সরকারিভাবে CPIM-র সঙ্গেই ছিলেন মণীশ । 2009 সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল অনেক কিছু । মণীশ যে CPIM থেকে দূরে যাচ্ছেন তাও স্পষ্ট ছিল । তারপর বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে । রাজ্যে পালাবদল ।
22টা মামলায় অভিযুক্ত মণীশ শুক্লা । বেআইনি অস্ত্র রাখা, একাধিক খুন এবং খুনের চেষ্টা সহ বেশকিছু মামলা ছিল তাঁর বিরুদ্ধে । রাজ্যে পালাবদলের পর তৃণমূল কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পরিচিত হন মণীশ । 2019 সালের পর অর্জুন সিংয়ের হাত ধরে ফের BJP-তে চলে আসেন । তাঁর আগে পর্যন্ত অর্জুন সিং, শীলভদ্র দত্ত সহ তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান ।
CPI(M) নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, টিটাগড় এবং ব্যারাকপুর সংলগ্ন এলাকায় মস্তান এবং অপরাধী গুন্ডা হিসেবে পরিচিত ছিলেন মণীশ । তৃণমূল কংগ্রেসই তাঁকে খুন করেছে । তৃণমূলের রাজত্বে খুন কোনও নতুন ঘটনা নয় ।
তিনি বলেন, "শাসকদল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসার পরই গরবেতায় খুন হন CPI(M)-র নেতা জিতেন নন্দী, অজিত লোহার প্রমুখ । কার্যত পুলিশের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছে শাসক দলের । রাজ্যে গুন্ডা রাজ কায়েম করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । মুখ্যমন্ত্রী নিজেই গুন্ডা নিয়ন্ত্রণ করেন ।"
যদিও সমগ্র ঘটনায় হতবাক নন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান । নোয়াপাড়ায় বিকাশ বসুর হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, "তৎকালীন বাম শাসনকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে মদত দিয়েছিলেন । বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । হিংসার রাজনীতির জনক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীদলকে খতম করার জন্য সেদিন বিকাশ বসুকে খতম হতে হয়েছিল । তারই রেশ চলছে এখন । কয়েকজন খুনিকে বিধায়ক করা হল । তিনি আবার BJP-তে চলে গেলেন । তৃণমূল কংগ্রেসের পথ নেয় BJP । নেতা ভাঙিয়ে অন্য দলের নেতা করতে হয় এই রাজনৈতিক দলগুলিকে । দুটি দল সমাজবিরোধী নির্ভরশীল হওয়ার জন্য পুরো ব্যারাকপুরে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে । এই মারাত্মক পরিণতির পিছনে শাসকদলের প্রশ্রয় সমাজবিরোধীদের বেড়ে উঠাই একমাত্র কারণ । যার ফলে এখনও উত্তপ্ত ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল । এই মণীশের অতীত সম্পর্কে সকলেই জানেন । সরকারের ষড়যন্ত্রের থানার সামনে নৃশংস খুন । CCTV খারাপ । অবিলম্বে প্রশাসনকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে দোষীদের শনাক্ত করতে হবে । CBI এবং CID কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলের মুখাপেক্ষী ।"
একদা তড়িৎপন্থী মণীশের খুন রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা অবস্থার অবনমনের কথা মনে করিয়ে দেয় । অভিযোগ করছেন তরিৎ তোপদার । এলাকার প্রাক্তন সাংসদ তিনি । তিনি জানান, বর্তমানে BJP কর্মী মণীশ শুক্লার উপর নৃশংস আক্রমণ এবং খুন থানার চৌহদ্দির মধ্যেই ঘটেছে বলা যায় । আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে । এর থেকেই বোঝা যায়, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে । গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল এবং অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রাজনীতিতে বেড়ে যাওয়ার মাঝখানে পড়ে মৃত্যু হল মণীশের । এমন ঘটনাও অতীতেও হয়েছে । বর্তমানে ঘটছে । আগামী দিনেও ঘটবে।
টিটাগড়ে না এসেই অনেকে মন্তব্য করছেন যেন হাতের তালুর মতো টিটাগড়কে চেনেন । সমগ্র ঘটনা সম্পর্কে জানেন । তড়িৎ তোপদার আবেদন জানিয়েছেন, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করুন । না হলে আসল ঘটনা চাপা পড়ে যাবে ।