কলকাতা, 5 ডিসেম্বর: পরম আদরে সবার চোখ এড়িয়ে হয়তো গোপনে প্রেমিকাকে প্রেমপত্র লিখেছিলেন প্রেমিক ৷ সেই চিঠিই ধরুন প্রেমিকার হাতে পৌঁছনোর আগে তা পড়ে ফেললেন অন্য কেউ ৷ আবার ধরুন, কাছের কোনও মানুষকে পাঠানো কোনও গোপন জিনিসের পার্সেল প্রাপক খোলার আগেই তা অন্য কেউ দেখে ফেললেন ৷ না, গল্পকথা নয় ৷ ডাক বিভাগের নয়া আইনে এমনই আশংকা দেখা দিয়েছে নাগরিকদের মনে ৷ বিরোধীরা আগেই সরব হয়েছিলেন ৷ এ বার এই বিলের বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন বিশিষ্টরাও ৷
আগামী দিনে পোস্ট অফিস মারফৎ চিঠি বা পার্সেল পাঠানোর আগে পাঁচবার ভাবতে হবে প্রেরককে । কারণ আপনার সেই গোপন চিঠি বা গোপন বস্তুটি প্রাপকের হাতে পৌঁছনোর আগে অন্য কেউ দেখে ফেলতে পারেন বা জেনে নিতে পারেন । সেটি অপরাধমূলক মনে হলে ভারতীয় ডাক বিভাগের অফিসাররা শুল্ক দফতর অথবা প্রশাসনিক দফতরে পাঠিয়ে দেবেন । কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে আইন করে এই অধিকার দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় ডাক বিভাগের অফিসারদের । যা নিয়ে সরব সমাজের বিশিষ্টরা । তাঁদের দাবি, জনগণের উপর কোনও ভাবেই নজরদারি চালাতে পারে না সরকার । বিশেষ করে যেখানে ব্যক্তি গোপনীয়তার বিষয় থাকে ।
গতকাল রাজ্যসভায় ভারতীয় ডাক বিভাগ আইন সংশোধনের বিল পাশ হয়েছে । আইনের পরিবর্তন করে ভারতীয় আইন তৈরির জন্য এই বিল পাশ করিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার । সেই বিলের একাধিক বিষয়ের মধ্যে নয় নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ভারতীয় ডাক বিভাগের অফিসাররা চাইলে যে কোনও ব্যক্তির পাঠানো পার্সেল বা চিঠি খুলে দেখতে পারবেন । যদি তা অপরাধমূলক হয়, তখন সে বিষয়ে আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন তিনি । আর এখানেই চিঠি বা পার্সেল প্রেরকের গোপনীয়তা বা নিজস্বতার যে অধিকার রয়েছে তা হরণের অভিযোগ উঠছে । বিল পাশের সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা এই বিষয়টি নিয়ে সরব হন । রাষ্ট্র কখনও নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয়ে নজরদারি চালাতে পারে না বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা ।
বিশিষ্ট সমাজকর্মী মীরাতুন নাহার বলেন, "কোন সরকার আইন তৈরি করল, ব্রিটিশ সরকার না অন্য কোনও সরকার আইন তৈরি করল তা প্রাসঙ্গিক নয় । সেই আইনটি দেশবাসীর স্বার্থ খর্ব করছে কি না, অধিকার হরণ করছে কি না, দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষা করছে কি না, সেটাই হচ্ছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় । প্রতিটি দেশবাসীর নিজস্ব স্বাধীনতা রয়েছে, অধিকার রয়েছে তাঁর গোপনীয়তা বজায় রাখা । তাঁর নিজস্বতা বজায় রাখার । তিনি যা লিখে পাঠাবেন বা যা কিছু পাঠাবেন সে ক্ষেত্রে তাঁর গোপনীয়তা এবং নিজস্বতা বজায় রাখার অধিকার আছে । দেশের সরকারকে সর্বদা মাথায় রাখতে হবে ব্যক্তির সেই অধিকার বা গোপনীয়তা যাতে খর্ব না হয় । ফলে এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার বিভাগের জন্য যে আইন করতে চাইছে, তা অবশ্যই জনস্বার্থ বিরোধী । দেশবাসীর মানবাধিকারও খর্ব করবে । এই নজরদারি কখনওই কাঙ্খিত নয় । সরকার জনগণের । ফলে জনগণ যা বলবে সরকার সেটাই মানবে । সরকার জনগণের উপর নজরদারি করবে, তার জন্য জনগণ সরকারকে নির্বাচিত করে না ।"
ব্যস্ততার কারণে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার এ বিষয়ে বিস্তারিত মতামত না জানালেও তিনি বলেন, "এটা খুব খারাপ বিষয় ৷ নজরদারি চালাতে পারে না সরকার ।"
সিপিআইএম নেতা রবীন দেব এ প্রসঙ্গে বলেন, "মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার যে রীতিনীতি ছিল, সেগুলো ধারাবাহিকভাবে কেড়ে নিচ্ছে কেন্দ্রের মোদি সরকার । সবই জলাঞ্জলি দিচ্ছে । একদিকে ধর্মীয় উন্মাদনা, অন্যদিকে ব্যক্তিগত অধিকার হরণের ধারাবাহিকতা । স্বাধীনতার 76 বছর পরেও সাধারণ মানুষের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে যে আইন ছিল, তা একটার পর একটা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে । যা সাংবিধানিক নীতিগত পদ্ধতিগতভাবে সরকার কখনওই করতে পারে না ।"
অন্যদিকে গতকালই রাজ্যসভায় তৃণমূলের সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় বলেছেন, "পেগাসাসের পরে পোস্টাল বিল এনে সরকার গণতান্ত্রিক দেশটিকে নজরদারি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে ।"
আরও পড়ুন: