হায়দরাবাদ, 7 জানুয়ারি: 'মাছ-ভাত' তত্ত্বে এক সময় ব্রিগেড ভরাতেন সুভাষ চক্রবর্তীরা ৷ সে দিন অতীত ৷ মাছ-ভাতের জায়গা দখল করেছে 'ডিম্ভাত' ৷ ব্রিগেডের খোল-নলচেরও আমূল বদল ঘটেছে ৷ এক সময়ের লাল ব্রিগেডে বসেছে গীতা পাঠের আসরও ৷ এই আবহে শনিবারের বাম ছাত্র-যুবদের ব্রিগেড সমাবেশে নতুন বার্তা কী আসে, সেদিকেই চোখ ছিল রাজনৈতিক মহলের একাংশের ৷ আনুষ্ঠানিকভাবে এদিনের সমাবেশের আয়োজক বাম যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই হলেও, বামফ্রন্ট যে এর মধ্যে দিয়ে একরকম শক্তি প্রদর্শন করতে চেয়েছে তা স্পষ্ট ৷ আর এই 'ইনসাফ সভা'র শেষে আক্ষরিক অর্থেই উচ্ছ্বসিত রাজ্যের বাম নেতৃত্বও ৷
2011-এর পর থেকেই আলিমুদ্দিনের অন্দরে তরুণদের জায়গা ছেড়ে দেওয়ার একটা দাবি উঠেছিল ৷ আর সেই দাবি কার্যত জোরালো হয়ে উঠেছিল 2016-এর বিধানসভা ভোটের পর ৷ যদিও সিপিএমের অন্দরে সেই পট পরিবর্তন হতে অনেকটাই সময় লেগে যায় ৷ মহম্মদ সেলিমকে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক করতেও আলিমুদ্দিনের সময় লেগেছে প্রায় 10 বছর ৷ আর ডিওয়াইএফআই বা এসএফআই-এর মতো যুব সংগঠনকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে 2021-এর আরও একটা বিধানসভা ভোট চলে গিয়েছে ৷ আর 2011 থেকে 2021-এর রক্তক্ষরণও স্পষ্ট হয়েছে অন্তত বিধানসভার চিত্র থেকেই ৷ 10 বছরে বিধায়ক সংখ্য়া 25 থেকে শূন্যে নেমেছে সিপিএমের ৷ রাজ্য থেকে সংসদেও কোনও প্রতিনিধি নেই বামেদের ৷ এই অবস্থায় আরও একটি লোকসভা ভোটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেশ ৷ রাজনৈতিক দলগুলির কাছে চ্য়ালেঞ্জ কঠিন ৷ আর বাংলায় অবিজেপি দলগুলির ছন্নছাড়া অবস্থা সেই কঠিন পরিস্থিতিকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহল মহল ৷
'দিল্লিতে দোস্তি, বাংলায় কুস্তি' ৷ কেন্দ্রে যে দল যখনই ক্ষমতায় এসেছে তার সঙ্গে বাংলার তিন রাজনৈতিক দল বাম-কংগ্রেস-তৃণমূলের 'জোট' বা 'বাইরে থেকে সমর্থন'-এর তত্ত্ব নিয়ে এই স্লোগান রীতিমতো পরিচিত হয়ে উঠেছে ৷ চলতি লোকসভা ভোটের আগেও সেই পরিচিত স্লোগানই এখন বিজেপি নেতৃত্বের মুখে ৷ 'ইন্ডিয়া' জোটের তিন গুরুত্বপূর্ণ শরিক বাম-কংগ্রেস-তৃণমূল বাংলায় যেভাবে নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে তাতে আদৌ এ রাজ্যে আসন ভাগাভাগির চিত্রটা কী হবে, তা কালের গর্ভেই নিহীত ৷ তার আগে এদিনের ব্রিগেড অবশ্য কিছুটা হলেও অক্সিজেন দেবে বামেদের তা বলাই বাহুল্য ৷ কারণ, অবশ্যই সংখ্য়া বল ৷ প্রায় দুই লক্ষ লোকের সমাগম হয়েছে বলে আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছে বামেরা ৷ কিন্তু তারপরও প্রশ্ন উঠছে, এই লোকবলকে আদৌ ভোটে পরিবর্তন করতে পারবে বামেরা ?
বামেদের বিশেষত সিপিএমের এক সময়ের গড় বলে পরিচিত দুই 24 পরগনা, বাঁকুড়া, হুগলি, পুরুলিয়া, উত্তরের কোচবিহার বা জলপাইগুড়ি কার্যত ছিনিয়ে নিয়েছে গেরুয়া শিবির ৷ 2019-এর 3 ফেব্রুয়ারির পর 2021 সালের ফেব্রুয়ারিতে বিধানসভা ভোটের আগে শেষ ব্রিগেড সমাবেশ করেছিল বামেরা ৷ দুই ক্ষেত্রেই বাম শরিক দলগুলির ডাকেই ব্রিগেড সমাবেশ হয়েছিল ৷ আর দু'বারই মাঠে উপচে পড়া লোকের ভিড় দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিল খোদ বাম নেতৃত্ব ৷ 2021-এ অবশ্য বামেদের ব্রিগেডের অংশীদারি ছিল কংগ্রেসও ৷ কিন্তু বিধানসভা ভোটে তার কোনও প্রতিফলনই দেখা যায়নি ৷ বরং 19-এর লোকসভার পর 21-এর বিধানসভায় 77টি আসন নিয়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পায় বিজেপি ৷ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দাবি, বাম বা বাম-কংগ্রেস জোটের ব্রিগেডে লোক হলেও তাদের ভোট বাক্সে কনভার্ট করতে পারেনি তারা ৷ কারণ হিসাবে ব্যাখ্য়া করা হচ্ছে, আদতে নেতৃত্বহীনতা, ইস্যু ভিত্তিক ধারাবাহিক লড়াইয়ের অভাব, ক্ষমতা বিরোধী হাওয়াকে ধরতে না-পারা, বুথ স্তরে সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং চেহারার অভাবই এর জন্য মূলত দায়ী ৷ সেক্ষেত্রে মীনাক্ষী মুখোপাধ্য়ায়কে প্রোজেক্ট করার ডিভিডেন্ড এবার অন্তত বামেদের পাওয়া উচিৎ বলেও মনে করছে রাজনৈতিক মহল ৷
বাংলায় বাম-কংগ্রেস-বিজেপির মূল প্রতিপক্ষ যদি তৃণমূল বা আরও সরলীকরণ করলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হন, তবে তাঁর প্রতিপক্ষে মীনাক্ষী মুখোপাধ্য়ায়ের চেহারা অনেক বেশি কার্যকর বলেই মত ওয়াকিবহল মহলের ৷ এর পিছনেও কারণ হিসাবে ব্যাখ্য়া দেওয়া হচ্ছে, এই মুহূর্তে দুর্নীতিতে জর্জরিত রাজ্যের শাসকদলের বিপরীতে যারা লড়াই করছে, সেই বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধেও অ্যান্টি ইনকামবেন্সি হাওয়া বহমান ৷ রাজ্য বিজেপির মুখ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর ৷ ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিও প্রভাব ফেলেছে বঙ্গে ৷ এই অবস্থায় মিনাক্ষীর মতো চেহারা যদি বামেরা সামনে আনে, তবে তৃণমূল স্তরে বিশেষত গ্রামীন এলাকায় দল কিছুটা হলেও চাঙ্গা হতে পারে ৷ যে গ্রামের ভোটের উপরেই একসময় দাঁড়িয়েছিল সিপিএম, 11-এর পর ধীরে ধীরে গ্রাম বামেদের থেকে মুখ ফিরিয়েছে ৷ আর সেই ভোট ব্যাঙ্ককে ধরতে তরুণ মহিলা মুখ বামেদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকর হবে বলেও মনে করা হচ্ছে ৷ আর 'মাঠ দখলের লড়াই'-এর মধ্যে দিয়ে মীনাক্ষীর দাবিকে সেলিমের সমর্থন, সেই বার্তাই দিয়েছে কী, প্রশ্ন থাকছে ৷
আরও পড়ুন: