কলকাতা, 6 অক্টোবর : শহর কলকাতার বেশ কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে ইতিহাস আজও পায়ে পায়ে হাঁটে । সাবেক কলকাতার ছবিটা এখানে ধরা পড়ে । উত্তর কলকাতার সে রকমই একটি জায়গা পাথুরিয়াঘাটা ।
তথ্য বলে শহর কলকাতায় কোনও কোনও বারোয়ারি পূজার বয়স কম বেশি একশো । আয়োজক মূলত সমাজের অভিজাত শ্রেণির মানুষজন । বাকিরা নিতান্তই সাধারণ । এলিট বা সম্ভ্রান্তদের বাড়িতে তদানীন্তন ইংরেজ প্রশাসনের আগমন ঘটত । এবং সেটা ছিল স্ট্যাটাস সিম্বল বা শ্লাঘার বিষয় । 240 বছর আগে সেটাই ছিল সম্ভ্রান্ত রীতি ।
প্রাসাদ নগরী কলকাতার আজও কিছু চিহ্ন রয়ে গিয়েছে । বড় বড় খিলান, কড়ি-বড়গা, গাড়ি বারান্দা, বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না, দেওয়াল জোড়া তৈলচিত্র ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয় । পাথুরিয়াঘাটার 46 নম্বর ঘোষ বাড়িটির ছত্রে ছত্রে ইতিহাসের হাতছানি ।
240 বছর আগে এ রকমই এক দুর্গা পুজোর দিনে ঘোষবাড়ির সিংহদুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিল ওয়ারেন হেস্টিংসের ফিটন । তদানীন্তন ইংরেজ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তার আগমনে আকাশ বাতাস আলোড়িত হয়েছিল বাদ্যির আওয়াজে ।
1872 সালে হুগলি থেকে কলকাতায় এসে পাথুরিয়াঘাটায় বাড়ি তৈরি করেছিলেন রামলোচন ঘোষ । পরে এই বাড়ির পাশে আরও একটি ঘোষ বাড়ি তৈরি হয়, যা খেলাৎ ঘোষের বাড়ি নামে সকলে চেনেন । এই বাড়ির পুজোয় এসেছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ । খেলাৎ ঘোষের উলটো দিকের বাড়িটি পাথুরিয়াঘাটা মল্লিকদের । এই বাড়িতে ঠাকুরের ভাব সমাধি হয়েছিল ।
ইতিহাস এখানে সত্যিই থমকে দাঁড়িয়ে । রামলোচন ঘোষের বাড়ির সঙ্গে ক্রিকেটের নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে । সে কথায় পরে আসব । অষ্টমীতে রামলোচন ঘোষের ঠাকুর দালানে দাঁড়িয়ে মনে হল ইতিহাস এখানে জীবন্ত । মায়ের সনাতনী রূপে একটু বৈচিত্র্য রয়েছে । অসুরের রং সবুজ । যা বোধ হয় ঈর্ষার প্রতীক । সিংহের মুখে ঘোড়ার আদল । পশুরাজের শক্তি ও গতির মিশেলের জন্যই অশ্বের আদল । পাশে রাখা দুটি রথ ।
1873 সালে এসেছিলেন হেস্টিংস । রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে তাঁদের যাতে অসুবিধা না হয় সে জন্য হেস্টিংস দম্পতির মাথায় ছাতা ধরতে হয়েছিল । প্রতিমার আদলে যেমন অভিনবত্ব রয়েছে তেমনই এ বাড়ির পুজোর বিসর্জনে চমক রয়েছে । উত্তর কলকাতার আর পাঁচটা বনেদি বাড়ির পুজোর মত বিসর্জনের দিন নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হয় না । কিন্তু প্রতিমা বিসর্জন হয় তিন নৌকায় ।
দেওয়াল জোড়া বেলজিয়াম কাচের আয়না, বেলোয়ারি ঝাড়বাতি, অজস্র তৈলচিত্র, সিন্দুক ইতিহাস বহন করে চলেছে । দুর্গাপুজোর সময় এ বাড়ি যেন মিলন ক্ষেত্র । দেশ-বিদেশে থাকা আত্মীয় পরিজনের ঘরে ফেরার সময় এই দুর্গাপুজো । পুজোর রোজনামচা সামলানো,প্রসাদ এবং আড্ডায় পাথুরিয়াঘাটা ঘোষ বাড়ি যেন প্রাণ পায় । ভোর চারটে থেকে উঠে পুজোর কাজ শুরু হয় । প্রসাদের অন্যতম আকর্ষণ ক্ষীরের কচুরি ।
আগেরই বলেছিলাম এ বাড়ির সঙ্গে ক্রিকেটের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে । এ বাড়ির মেয়ে চন্দ্রলেখা ঘোষকে বিয়ে করেছিলেন জগমোহন ডালমিয়া । বিশ্ব ক্রিকেটের আলোচিত ব্যক্তিটি ও তাঁর স্ত্রী চন্দ্রলেখা দু'জনেই প্রয়াত । তবুও জগমোহন ডালমিয়া এ বাড়ির আলোচনায় বারেবারে ফিরে আসেন । জগমোহন ডালমিয়া পুত্র অভিষেক এখন CAB-র যুগ্মসচিব । তাঁর কন্যা বৈশালি বিধায়িকা । অভিষেক বলছেন পুজোর সময় তাঁর ঠিকানা পাথুরিয়াঘাটা ।
ইতিহাস এখানে থমকে । আজও মনে হয় সিংহদুয়ারে হেস্টিংসের ফিটন থামা সময়ের অপেক্ষা ।