কলকাতা, 8 ডিসেম্বর: কলকাতার মল্লিক বাজার মোড়ে লোয়ার সার্কুলার কবরস্থানের পিছনের অংশে পরিত্যক্ত অবস্থায় এখনও আছে এশিয়ার প্রাচীনতম গ্যাস চুল্লি । ঘরটি জরাজীর্ণ হলেও আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে । লন্ডনের ভিলেজ চার্চের আদলে এটি তৈরি হয়েছিল । ফরাসি সংস্থা এই চুল্লি নির্মাণ করে । আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, সুখলতা রাও, নেলি সেনগুপ্তদের এখানেই দাহ করা হয়েছে । এখানে একাধিকবার পরিচিতদের দাহ কাজে উপস্থিত হন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । অবিভক্ত ভারতে, ইউরোপের বহু বড় ব্যবসায়ী থেকে বিশিষ্ট মানুষকে এখানে সৎকার করা হয়েছে ।
ইতিহাসের ভান্ডার এই গ্যাস চুল্লি । এ বার তাকে সংস্কার করে তথ্যচিত্র ও লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো করার প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়েছে খ্রিস্টান বেরিয়াল বোর্ড । এই চুল্লির সঙ্গেই অদূরে থাকা সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিকে নিয়েই কাজ হবে । তৎকালীন ইতিহাস তথ্যচিত্র ও লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হবে বলে জানান বোর্ডের সাম্মানিক সদস্য রণজয় বসু ।
বিধান রায়ের আমলে গ্যাসের সমস্যার জন্য বন্ধ হয়েছে চুল্লি । তারপর থেকেই পড়ে আছে । বাম আমলে অনেকেই চেয়েছিলেন চুল্লির আশপাশের বিরাট ফাঁকা জমিতে হোক অবৈতনিক বিদ্যালয় । তেমনই তৃণমূল আমলে সেখানে প্রাথমিক হাসপাতাল করার পরিকল্পনা করেছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর । তবে কেউই এই চুল্লি রক্ষায় সদর্থক ভূমিকা নেয়নি । এখন এই চুল্লি অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালাচ্ছে ।
এক সময় কবরস্থানের জায়গায় অভাব, মহামারি এ সব কারণে এই চুল্লি তৈরি করে ব্রিটিশ শাসক । ব্রহ্মসমাজের অনেককেই এখানে দাহ করা হয় । বহু খ্রিস্ট ধর্মের মানুষও তাঁদের পরিজনদের দেহ দাহ করে সেই ছাই কবরে চাপ দিত, তাতে জায়গা কম লাগত । সেই সময় বিদ্যুৎ আসেনি । গ্যাস বাতি ছিল ভরসা । ফরাসি কোম্পানি এই গ্যাস চুল্লি নির্মাণ করে । রাজাবাজার এলাকা থেকেই বায়োগ্যাস আসত লাইন মারফত এই চুল্লিতে । সেখানে উৎপাদন বন্ধ হয় ।
এর পর স্বাধীন ভারতে বিধান রায়ের সরকারের সময় মাটির নিচে লাইন করে গ্যাস আনা হয় । তবে মাঝে মধ্যেই পরিষেবায় ছেদ পড়ে । ফলে সঠিক ভাবে দাহ কাজ হত না । সমস্যার জেরে বন্ধ হয় দাহ কাজ । পরে ডানকুনি থেকে গ্যাসে লাইন করার কথা হলেও আর হয়নি । ফলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এই চুল্লি । রাতবিরেতে টুকটাক লোহা চুরি হচ্ছে । বয়সের চাপে দেওয়ালে ফাটল । গজিয়েছে বিরাট বিরাট গাছ । চিনে যখন লং মার্চ হয়, বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ পালিয়ে এ দেশে এসেছিলেন । ট্যাংরা এলাকায় বসবাস করেন তাঁরা । তাঁদের শেষকৃত্যও এখানে হত একসময়ে ।
গোপালকৃষ্ণ গান্ধি রাজ্যপাল থাকাকালীন একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন । পর্যটন ফতরের সঙ্গে কথা খানিকটা এগিয়েছিল । তবে শেষমেষ বাস্তবায়িত হয়নি । খ্রিষ্টান বেরিয়াল বোর্ডের সাম্মানিক সদস্য রণজয় বসু বলেন, "ইতিহাসের ভান্ডার বলা চলে এই গ্যাস চুল্লি ও লোয়ার সার্কুলার আর সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি । সেই ইতিহাসকে সহজ ভাবে তুলে ধরা, রহস্য রোমাঞ্চের আদলে যাতে দর্শক আকর্ষণ করা যায় সেই পরিকল্পনা অনেকটা এগিয়েছে । সম্প্রতি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে আমরা এই গ্যাস চুল্লি ভবনটি সংস্কার করব । আশপাশের ফাঁকা জমি পরিষ্কার করে বাগান ও তথ্য চিত্র ও লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো করার পরিকাঠামো করব । কিন্তু এটা বড় খরচ । তাই চাইছিলাম কোনও বড় কোম্পানি যদি সিএসআর টাকা দিয়ে সাহায্য করে । সংস্কারের কাজ, তথ্যচিত্র, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড নিয়ে সোসাইটি ফর হেরিটেজ অ্যান্ড আর্কিওলজি ম্যানেজমেন্ট ও রিচ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কথা এগিয়েছে ।সরকারি অনুমতি নেওয়ার বিষয় আছে । এই কাজ বাস্তবায়িত হলে নজির তৈরি হবে । ভারতের বুকে কোনও কবরস্থান ও গ্যাস চুল্লি নিয়ে এই প্রথম তথ্যচিত্র হবে । পেশাগত ইতিহাসবিদ, স্ক্রিপ্ট রাইটারের সঙ্গে কথা চলছে ।"
উল্লেখ্য, স্যার লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও, উইলিয়াম জোন্স-সহ বহু প্রসিদ্ধ মানুষের কবর আছে সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে ।
আরও পড়ুন: