কলকাতা, 29 অগস্ট: রাজ্য সঙ্গীতের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক এড়াতে পিছু হটলেন মমতা । মঙ্গলবার সর্বদল বৈঠকের প্রথমে প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে রাজ্য সংগীত হিসেবে 'বাংলার মাটি বাংলার জল' বেছে নেওয়ার পরেও শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেন । ইতিহাসবিদ তথা প্রাক্তন তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ সুগত বসু রাজ্য সংগীত হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বিশেষ গানটিকে নেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করেন । সভার শেষ পর্বে মুখ্যমন্ত্রী জানান, বাংলা দিবস কবে নির্ধারিত হবে, তা রাজ্য বিধানসভায় আলোচনার পর জানিয়ে দেওয়া হবে । কিন্তু এই দিনের সভা থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে 'বাংলার মাটি বাংলার জল' এই গানটিকে বেছে নেওয়া হচ্ছে । মুখ্যমন্ত্রী বলেন আসুন সবাই মিলে গাই ।
গান শেষ হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "রাখি বন্ধনের জন্য আপনাদের সবাইকে শুভেচ্ছা । আমার একটাই প্রস্তাব থাকবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এই গানটি লিখেছিলেন রাখি বন্ধনের সময়, তখন তিনি বাঙালিদের জন্য প্রোগ্রামটা করেছিলেন । সব সমাজকে নিয়েই কিন্তু যারা বাংলায় কথা বলে । কিন্তু বাংলায় যেহেতু বিভিন্ন পাশাপাশি ও ধর্মের লোক এখন বাস করে আজকে তিনি বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো বাঙালির বদলে বাংলার বলতেন । 'বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন'-এর জায়গায় যদি আমরা 'বাংলার প্রাণ বাংলার মন বাংলার ঘরে যত ভাই বোন' এটা ব্যবহার করতে পারি কি না, আমি আপনাদের মতামত চাইব । যদি আপনারা হ্যাঁ বলেন তাহলে আমি মনে করব সব ধর্মকে, সব বর্ণকে, সব জাতিকে সব ভাষাকে, একটা ছাতার তলায় নিয়ে আসতে পারব । এইটুকু সংবিধান তো অনেকেই করে । আমি আজকে আপনাদের মতামত চাইব ।"
এই নিয়ে মতামত দিতে প্রথমেই এগিয়ে আসেন বিশিষ্ট সাংবাদিক তথা তৃণমূল মুখপাত্র এবং তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ । তিনি বলেন, "কেএম সায়গল 'আমি যখন তোমায় শুনেছিলেম'-এই গানটিকে যখন ফিল্মে গেয়েছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গিয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন 'এইটুকু মোর রইল অভিমান কবি'... রবীন্দ্রনাথ 'কবি' শব্দটি লিখেছিলেন কিন্তু রোমান্টিক সিচুয়েশনে কবি শব্দটি যাচ্ছিল না । তখন ফিল্ম যিনি করেছিলেন পরিচালক সেটা বদল করে দিয়েছিলেন । তখন রবীন্দ্রনাথকে গিয়ে বলা হয় আপনার গানের শব্দ বদলে দেওয়া হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, শব্দটা বদলে যদি প্রাসঙ্গিকতা ঠিক থাকে, তাহলে তা আরও বেশি লোকের কাছে পৌঁছয় । তাহলে শব্দ বদলে ঠিক কাজ করা হয়েছে । গানের মানে তো বদলায়নি । আমরা সেই বিষয়টা এখানে নিতে পারি ।"
সাংবাদিকদের তরফ থেকে এক প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, "আমরা তো রবীন্দ্র সঙ্গীত হিসাবে করছি না । আমরা এটাকে রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে নিচ্ছি । তাহলে একটা শব্দ বদলানো যেতেই পারে ।" অনেকেই বলতে শুরু করেন এতে কোনও বাধা আছে বলে আমাদের মনে হয় না । অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার তরফ থেকেও এই বিষয়টিকে সমর্থন জানানো হয় । তবে বেঁকে বসেন এসইউসিআইয়ের প্রতিনিধি । তাঁর কথায়, "আমরা বলছি হয়তো প্রাসঙ্গিকতা ঠিক রেখেই বদল করা হবে । কিন্তু পরে এই নিয়েই একটা অযথা বিতর্ক তৈরি হবে। রবীন্দ্রনাথের গানে শব্দ বদল করা হচ্ছে এটাতে কিন্তু অযথা বিতর্ক তৈরি হবে । এক্ষেত্রে আমাদের এই বিতর্ক এগিয়ে যাওয়াই ভালো ।"
মুখ্যমন্ত্রী প্রত্যুত্তরে বলেন, "এটা তো আমরা রবীন্দ্রনাথের গান হিসাবে নিচ্ছি না । রাজ্যের গান হিসেবে নিচ্ছি ৷ এটাকে নিয়েও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনি মতামত দেওয়ার একটু সুযোগ রাখুন ৷ সবাই যদি রাজি না হয় তাহলে আমি এটাকে রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে নিচ্ছি না । শব্দ পরিবর্তন করা নিয়ে যদি সমস্যা হয় তাহলে আমরা 'ধনধান্য পুষ্পে ভরা' এই গানটিকেও বিবেচনা করতে পারি ।"
এরপর সভার ভিতর থেকে বলা হয় এই যুক্তিতে কোনও দ্বিমত নেই, আজকের দিনের প্রেক্ষিতে এই পরিবর্তন হলে ভালো হয় । তবে রবীন্দ্রনাথের গানে শব্দ পরিবর্তন করলে আমরা অযথা অহেতুক আমরা একটা বিতর্কের মধ্যে পড়ব । তাই বিষয়টি এড়িয়ে চলাই ভালো । মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "বিতর্ক হোক চাই না । আমি রবীন্দ্রনাথের লাইন পরিবর্তন করতেও চাই না । রাজ্যসঙ্গীত নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে । তাহলে কি 'ধনধান্য'কে রাজ্যসঙ্গীত করা হবে ?"
উত্তরে তখন বলা হয়, ওটা দেশ নিয়ে গান, রাজ্য নিয়ে নয় । এরপরই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করা হয়, বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু সময় দেওয়া হোক । এরপর পূর্বের সিদ্ধান্ত থেকে আসেন মুখ্যমন্ত্রী । তিনি বলেন, "আপনাদের সময় দিলাম । আপনারা যদি সমর্থন করেন তবেই 'বাংলার মাটি বাংলার জল'কে রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে বিবেচিত করা হবে । আপনারা যদি সম্মতি না-দেন আমরা করব না । আমার সিদ্ধান্ত আমি কারও উপর জোর করে চাপিয়ে দেব না । ভালো জিনিসে মতান্তর চাই না । ফলে 5 সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই বিষয়টি নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলবে ৷ তারপরে এই বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ৷"
আরও পড়ুন : সর্বদল বৈঠকে পয়লা বৈশাখেই পশ্চিমবঙ্গ দিবস নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত