তিনি বলেছিলেন 'খেলা হবে' ৷ এটা স্পষ্টতই ইতিহাস হওয়ার বা ইতিহাস শুরুর একটা প্রশ্ন ৷ ইভিএম খোলার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার মানুষের রায় ছড়িয়ে পড়ল ৷ তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিকই বলেছিলেন, 'খেলা হল' ৷
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেস টানা তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এল ৷ এই জোরালো জয়ের পর বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঠছে ৷ কখনও উঠেছে স্বজন-পোষণের অভিযোগ ৷ কখনও আবার পক্ষপাতিত্বের ৷ আর এত কিছু গুরুতর অভিযোগের মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের একবার নিজেকে রাজ্যের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরলেন ৷ এবং দ্বিতীয়ত আজকের জয়ের পর মমতা নিঃসন্দেহে কেন্দ্র বিরোধী শক্তিগুলোর মূল চালিকা শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন ৷ আজকের এই জয়ের পর তৃণমূল কংগ্রেস জাতীয় দল হিসেবে যেমন নিজেকে মেলে ধরতে পারল, তেমনই সর্বভারতীয় দল হিসেবে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে নিল ৷
বাংলার প্রতিটি বিন্দু পর্যবেক্ষণের পর এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, মেরুকরণের যে রাজনীতি বা ধর্মের ভিত্তিতে ভোটারদের মেরুকরণের চেষ্টা করেছিল (যা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট) তা কোনও ভাবেই সফল হয়নি ৷ মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং দক্ষিণ 24 পরগনা, হাওড়া জেলা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, মুসলিম সংখ্যালঘু ভোটাররা ভোট দেওয়ার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসকেই বেছে নিয়েছে ৷ ইঙ্গিতটা পুরোপুরি স্পষ্ট, তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর তৃণমূল কংগ্রেসকে বেছে নিয়েছিল (সব বিভ্রান্তি ও অভিযোগ সত্ত্বেও) একমাত্র বিজেপিতে সমূলে উপড়ে ফেলার জন্য ৷
আরও পড়ুন : গণি-মিথের অবসান, তৃণমূল ও বিজেপিতেই ভরসা রাখল মালদা
এই গোটা ভোট প্রক্রিয়াতেই রাজ্যের তৃতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে লড়াইতে থাকা বামফ্রন্ট, এবং তার মিত্র কংগ্রেস এবং এআইএসএফ শুধুই চুপসে গিয়েছে ৷ বাম- কংগ্রেসের চিরাচরিত ভোটাররা তৃণমূল কংগ্রেসকেই বেছে নিয়েছে ৷
একটা কথা খুব সহজেই বলা চলে, 2019 সালে বিজেপির উত্থানকে বন্ধ করার জন্য মানুষ ভোট দিয়েছেন ৷ 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে 18 টি আসনে জয় লাভ করেছিল বিজেপি ৷ বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে, 121 টি বিধানসভায় গেরুয়া ব্রিগেড তাদের ধ্বজা ওড়াতে সক্ষম হয়েছিল ৷ স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপির মনে একটা আশা তৈরি হয়েছিল ৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের ক্যারিশমা এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সভাপতি জে পি নাড্ডা সে ভাবেই ভোট কৌশল রচনা করেছিলেন ৷ কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, বি এল সন্তোষ এবং অরবিন্দ মেননের মতো নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ৷ কিন্তু, বিজেপি এবং তারা দলের প্রতিটি নেতা যে জিনিসটা পড়তে ব্যর্থ হয়েছিলেন তা হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার দলের কৌশলবিদদের দ্বারা তৈরি করা পরিকল্পনা ধরতে ৷
পিসি-ভাইপো জোটের উপর বিজেপি নেতারা যত বেশি আঘাত আনলেন, যোগী আদিত্যনাথের মতো বিজেপি নেতারা বাংলা বোমা তৈরির কারখানা ... এই রকম স্লোগান তুলে যত বেশি প্রচার করেছিলেন, তত বেশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দলের হাত শক্ত হয়েছে ৷ দল তত বেশি করে সুংসহত হয়েছে ৷
আরও পড়ুন : এই জয় মমতাকে জাতীয় নেত্রী করল, জাতীয় বিকল্প হলেন কি ?
মমতা এ সময় তাঁর আস্তিন থেকে দুটি শক্তিশালী তরোয়ালকে বাইরে এনেছেন ৷ প্রথমত, দুয়ারে সরকার ৷ যে প্রকল্পের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কার্যত ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন সরকারকে ৷ দুয়ারে সরকার প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ৷ পরিবারের সব থেকে বয়স্ক মহিলার নামে এই কার্ড দেওয়া হয় ৷ সন্দেহ নেই এই প্রকল্প খুব বেশি সংখ্যক মহিলা ভোটারকে নিজের দিকে টানতে পেয়েছে ৷ আর এ সবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের বহিরাগত তত্ত্বও ৷ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রচার স্লোগান বাংলা তারা নিজেরে মেয়েকেই চায়, রাজ্যের রাজনীতিতে অনুরণন তৈরি করেছিল ৷
এত কিছুর পরও বিজেপি এ বারে বিধানসভা নির্বাচনে তাদের আসন সংখ্যা 80-র কাছাকাছি নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে ৷ যেখানে 2016 সালে মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল তারা ৷ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে পাটিগণিতের হিসেবে 18 টি আসন পেয়েছিল বিজেপি ৷ মাত্র দুই থেকে 18 তে উঠে এসেছিল ৷ কিন্তু, এবার রাজনৈতিক রসায়ন রাজনৈতিক পাটিগণিতকে ছাড়িয়ে গিয়েছে ৷ নদিয়া এবং উত্তর 24 পরগনার মতো জেলাগুলি, যেখানে মতুয়া ভোট কোনও ভাবেই নিজেদের দিতে টানতে পারেনি বিজেপি ৷ আবার উত্তরবঙ্গ, বিশেষত জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, এবং কোচবিহারের মতো জেলাগুলিতে যেখানে রাজবংশীরা সব সময় নির্বাচনের ফলের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তাদেরও নিজের দিকে টানতে পারেনি বিজেপি ৷
ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর তাঁর কাজ, দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন ৷ বিজেপি প্রথম বারের মতো বাংলার বিধান সভায় বিরোধী দিল হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে ৷ বামফ্রন্ট এবং তার মিত্ররা আরও খালি হাতে থেকে গিয়েছে ৷ তবে, 2021 সালের গরমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একক প্রার্থী হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেকে আরও মজবুত করে তুলে ধরলেন ৷ 2024 সালের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গোনা শুরু হল ৷
(লেখক ইটিভি ভারতের নিউজ কো-অর্ডিনেটর)