ETV Bharat / state

সাংবাদিকের জেল, স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে ফেটে পড়ে পরাধীন ভারত

সালটা ১৮৮৩ । ৫ মে । কলকাতা হাইকোর্ট সেদিন লোকে লোকারণ্য । বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিড় জমিয়েছে যুব সমাজ । কারো চোখে আগুনে ভাষা । কারো মুখে সংশয় । কেউ করছেন প্রার্থনা ।

ছবি
author img

By

Published : Aug 15, 2019, 3:14 PM IST

Updated : Aug 15, 2019, 5:39 PM IST

কলকাতা, ১৫ অগাস্ট : সালটা ১৮৮৩ । ৫ মে । কলকাতা হাইকোর্ট সেদিন লোকে লোকারণ্য । বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিড় জমিয়েছে যুব সমাজ । কারো চোখে আগুনে ভাষা । কারো মুখে সংশয় । কেউ করছেন প্রার্থনা ।

নির্দিষ্ট সময়েই বিচারকক্ষে এলেন পাঁচজন । কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন ফুল বেঞ্চ । বিচারপতিদের একজনই মাত্র ভারতীয় । রমেশচন্দ্র মিত্র । তাঁকে নিয়ে তৎকালীন চিফ জাস্টিস স‍্যার রিচার্জ গার্থের রীতিমতো মাথাব্যথা । দীর্ঘ শুনানির পর বিচারপতি মিত্র চেয়েছিলেন দেশপ্রেমিক সাংবাদিক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হোক । কিন্তু বাকি চার বিচারপতির অন‍্য চিন্তা । সরকারও চায় সবক শেখাতে । ঐকমত্যের জন্য রায় ঘোষণার আগে গার্থ বিচারপতি মিত্রকে ডেকে পাঠান নিজের বাসভবনে । কিন্তু ব্যর্থ হন । পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের বাকি চার ব্রিটিশ বিচারপতি জেলে পাঠাতে চেয়েছিলেন “দা বেঙ্গলি" পত্রিকার সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথকে । সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের সাপেক্ষে যখন রায় ঘোষণা হয়, আদালত কক্ষে তখন পিন পড়লেও বুঝি শব্দ হবে । বিচারপতিরা ঘোষণা করেন, তিন মাসের জন্য জেলে যেতে হবে সুরেন্দ্রনাথকে । সঙ্গে জরিমানা দিতে হবে । ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে গোটা বাংলা । স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে সে দিন পালিত হয় অরন্ধন । ব্যবসায়ীরা বন্ধ করে দেন ব্যবসার কাজ । তারপরের ঘটনা ইতিহাস । কলকাতা ছাড়িয়ে আগ্রা, ফৈজাবাদ, অমৃতসর, লাহোর, পুনেতে হয় প্রতিবাদ সভা । সাংবাদিকের জেলযাত্রা নিয়ে যা ছিল অভূতপূর্ব । দোষ তেমন কিছু ছিল না ।

“দা বেঙ্গলি" পত্রিকায় স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় প্রতিবাদী লেখা লিখেছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । সেটা 1883 সাল । প্রবল জনমতের চাপে তার বছরদুয়েক আগে প্রত‍্যাহার করা হয়েছে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট । কিন্তু সংবাদপত্রের উপর শাসকের রক্তচক্ষু কমেনি এক ফোঁটাও । সুরেন্দ্রনাথের কলমের জেরে দা বেঙ্গলি তখন কলকাতার জনপ্রিয়তম কাগজ । স্বদেশি বিপ্লবীদের নয়নের মণি । সেখানে সুরেন্দ্রনাথ ব্রিটিশ ফতোয়া উপেক্ষা করে একের পর এক আগুন ঝরা লেখা লিখতেন শাণিত কলমে ।

আরও পড়ুন : বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে হত্যা করেন কানাইলাল, দেশমাতার সেই সন্তানের বাড়ি ভগ্নদশা

1883 সালে কোনও একজনের শালগ্রাম শিলাকে অসম্মান করে পুলিশ । সম্মানের শালগ্রাম শিলাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় । ঘটনা নিয়ে ব্যাপক গোলমাল চলে বাংলার বিভিন্ন অংশে । বাংলার বহু বিশিষ্টজন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান । সুরেন্দ্রনাথ বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ব্যাপক সমালোচনা করে একটি লেখা লিখেছিলেন । যে লেখা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় জনমানষে । তাঁর বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য পরিবেশন এবং ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ তুলে হাইকোর্টে মামলা করে ব্রিটিশ সরকার । বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ঘেঁটে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, তা হল, আসলে সুরেন্দ্রনাথের কলমকে ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশ । অকুতোভয় সাংবাদিকের কলম যেনতেন প্রকারেন থামাতে চেয়েছিল সরকার । তার কারাবাসের সাজা শোনার পর আনন্দমোহন বসু লিখেছিলেন, “ It has been demonstrated by the universal out brast of grif and indiganation which the event called fourth, that the people of different Indian provinces have learnt feel for one another , and that a common bond of unity fellow feeling is rapidly being established among them."

আরও পড়ুন : খণ্ডঘোষের ঘোষবাড়ির সুড়ঙ্গতে লুকিয়ে ছিলেন ভগৎ সিং

এই ঘটনা দেশবাসীর মধ্যে একাত্মতা বাড়িয়ে দেয় অনেকটাই । দেশবাসীর কাছে এটা ব্রিটিশের অত্যাচারের একটা উদাহরণ হয়ে ওঠে । বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছিলেন, “Surrendranath 's imprisonment called fourth the first real political demonstration all over Bengal. He had already become the idol of the younger generation of his countryman. His conviction and sentance was taken up by young bengal as an open chellenge to there national honour and an attack on their love of freedom and patriotism." মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখে প্রমাদ গোনে ব্রিটিশ । সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গেই হাজার হাজার মানুষ জেলে যেতে চেয়েছিলেন । অবস্থার তীব্রতা এবং গুরুত্ব বুঝে ৩ মাসের যায়গায় 15 দিনেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথকে । পরাধীন ভারতের সাংবাদিকদের উপর অত্যাচারের এই ঘটনা এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত ।

সাংবাদিকতার ইতিহাসে বাংলা বরাবরই ভারতকে পথ দেখিয়েছে । ভারতের প্রথম সংবাদপত্র এই বাংলা থেকেই প্রকাশিত হয় । সেই ইতিহাসেরও পাতায় পাতায় লেখা আছে শাসকের অত্যাচারের কাহিনি । ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি ভারতের সংবাদপত্রের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা একটা দিন । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেরও বটে । ইতিহাসবিদরা কেউই অস্বীকার করেন না, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধি প্রদর্শিত অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের শাণিত কলমের অবদান ছিল অনেকটাই । জনমত তৈরি, স্বদেশিদের কথা সমাজের প্রতিটি কোণায় পৌঁছে দেওয়া কিংবা বিভিন্ন বিপ্লবীর বিচারের নামে আদালতের একপেশে কাণ্ডকারখানার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লেখা হত সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় । যার ভিত্তিটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল 1780 সালে । “ বেঙ্গল গেজেট"-এর আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে । যার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি । যিনি নিজে একজন ব্রিটিশ ছিলেন । এই পত্রিকা জন্মলগ্ন থেকেই শুরু করে ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঊষালগ্নে জনমত তৈরিতে বেঙ্গল গেজেটের ভূমিকা ইতিহাস কখনওই অস্বীকার করেনি । তথ্য বলছে, এই সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার পরে প্রথম দিকে সরকার বিরোধী খবরের পাশাপাশি স্থান পেত ইংরেজ কম্পানির শাসন সংক্রান্ত তথ্য, পণ্য পরিবহন, জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত খবরা খবর । পরবর্তীকালে এই পত্রিকায় তৎকালীন গভর্নর জেনেরাল ওয়ারেন হেস্টিংস, তাঁর স্ত্রী অ্যানা মারিয়া এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে লিখতে শুরু করেন হিকি । এই কলমকে ভয় পায় ইংরেজ কম্পানি । আসলে বরাবরই বোধহয় শাসকের ভয়ের কারণ কলম । হিকির বেঙ্গল গেজেট প্রতিষ্ঠার আগে উইলিয়ামস বোল্টস নামে এক শিক্ষাবিদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন একটি সংবাদপত্র । সেই ভয় থেকেই বোল্টসকে কম্পানি জোর করে একটি ইংল্যান্ডগামী জাহাজে তুলে দেয় । পরে দু'জনে ফেরত যাওয়ার পর কম্পানির শাসন নিয়ে রীতিমতো সোচ্চার হয়েছিলেন বোল্টস । কিন্তু হিকির পত্রিকা আটকাতে পারেনি ব্রিটিশ। কারণ, ওয়ারেন হেস্টিংসের কাউন্সিল সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন বেঙ্গল গেজেটের সঙ্গে । তিনি 1781 সালে ফিরে যান ব্রিটেনে । তখন থেকেই তার উপর খড়্গহস্ত হয়ে ওঠেন ওয়ারেন হেস্টিংস । সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিচারপতি এলিজা ইম্পের সহযোগিতায় হিকির বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা শুরু করে ব্রিটিশ । রীতিমতো ষড়যন্ত্রের মুখে পড়ে বেঙ্গল গেজেটের দপ্তরে ৪০০ সশস্ত্র ব্রিটিশ পুলিশ হানা দেয় । পরে ভারতের সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠা পুরুষকে যেতে হয় জেলে ।

আরও পড়ুন: 18 অগাস্ট মালদায় প্রথম উড়েছিল স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা

তারপরও কলম থামেনি । এতে আরও ভয় পেয়ে যায় ব্রিটিশরা । 1782 সালে ওয়ারেন হেস্টিংস বন্ধ করে দেন এই পত্রিকা । 1785 সাল । কলকাতার বুকে জন্ম নেয় আরও একটি সংবাদপত্র । “বেঙ্গল জার্নাল"। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান অস্বীকার করার নয় । যদিও প্রথম দিকে সরকারি বিজ্ঞাপন ছাপার কাজেই বেশি মনোযোগী ছিল । কিন্তু 1791 সালে পত্রিকার সম্পাদক উইলিয়াম ডুয়েল শুরু করে দেন সরকার বিরোধিতা । এই পত্রিকাতেই প্রকাশ পায়, “ লর্ড কর্নওয়ালিস মারাঠা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন ।" ব্রিটিশের দাবি ছিল, এই খবর প্রকাশের জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে । কিন্তু তিনি সেই ক্ষমা চাননি । এরপর তাঁকে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে উদ্যত হয় সরকার । নানা ভাবে তিনি এ দেশে থেকে যেতে সমর্থ হন । কিন্তু কর্নওয়ালিস বন্ধ করে দেন বেঙ্গল জার্নাল । এতে দমে যাননি ডুয়েল । 1794 সালে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন সংবাদপত্র । শুরু করেন সরকার বিরোধিতা । ফের ব্রিটিশ সরকার তাঁর উপর শুধু করে অত্যাচার । তাঁর বাড়িতে মাঝেমধ্যেই সশস্ত্র পুলিশ পাঠিয়ে তল্লাশি চালানো হয় । সরকার এই পত্রিকার পাঠক এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের উপর চাপ তৈরি করে । সেই চাপে একটা সময় পত্রিকা বিক্রি করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেন তিনি । কিন্তু এরই মাঝে 1794 সালে ২৭ ডিসেম্বর রীতিমতো লাট ভবনে ডেকে পাঠিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় । গ্রেপ্তারের পর তিনদিন তাঁকে ফোর্ট উইলিয়ামের দুর্গে আটকে রাখা হয় । পরে তাঁকে জোর করে ইংল্যান্ডগামী জাহাজে তুলে দেওয়া হয় ।


ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের ইতিহাস বলছে, যখনই নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম তৈরির চেষ্টা হয়েছে তখনই ব্রিটিশ সরকার তার টুঁটি টিপে ধরার চেষ্টা করেছে। “এশিয়াটিক মিরর" পত্রিকার সম্পাদককে মহীশূর যুদ্ধের পর পড়তে হয়েছিল শাসকের রোষানলে। তার জেরেই 1799 সালে ওয়েলেসলি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চালু করেন বেশ কিছু কঠোর আইন । তার মধ্যে ছিল, রবিবার সংবাদপত্র প্রকাশ না করার ফতোয়া । সরকারের প্রধান সচিবের অজান্তে কোনও সংবাদপত্র প্রকাশ করা যাবে না বলেও ফতোয়া দেওয়া হয় । এইগুলি অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠানোর কথা জানিয়ে দেওয়া হয় । তারপর বিভিন্ন সময় শাসক দাঁত বের করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সংবাদপত্রের উপরে । জারি হয়েছে সেন্সরশিপ । বহু দেশপ্রেমী সাংবাদিক নানাভাবে অত্যাচারের শিকার হয়েছেন ব্রিটিশের । সংবাদমাধ্যমকে পড়তে হয়েছে শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে । কলম কিন্তু থেমে থাকেনি৷

তথ্যসূত্র: 1. বেঙ্গল জার্নাল 2. মহাত্মা কৃষ্ণদাস পাল জীবন ও ভাবনা-ডঃ সুবোধ চৌধুরি 3. হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান জার্নালিজ়ম- মোহিত মৈত্র ; কৃতজ্ঞতা: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা

কলকাতা, ১৫ অগাস্ট : সালটা ১৮৮৩ । ৫ মে । কলকাতা হাইকোর্ট সেদিন লোকে লোকারণ্য । বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিড় জমিয়েছে যুব সমাজ । কারো চোখে আগুনে ভাষা । কারো মুখে সংশয় । কেউ করছেন প্রার্থনা ।

নির্দিষ্ট সময়েই বিচারকক্ষে এলেন পাঁচজন । কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন ফুল বেঞ্চ । বিচারপতিদের একজনই মাত্র ভারতীয় । রমেশচন্দ্র মিত্র । তাঁকে নিয়ে তৎকালীন চিফ জাস্টিস স‍্যার রিচার্জ গার্থের রীতিমতো মাথাব্যথা । দীর্ঘ শুনানির পর বিচারপতি মিত্র চেয়েছিলেন দেশপ্রেমিক সাংবাদিক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হোক । কিন্তু বাকি চার বিচারপতির অন‍্য চিন্তা । সরকারও চায় সবক শেখাতে । ঐকমত্যের জন্য রায় ঘোষণার আগে গার্থ বিচারপতি মিত্রকে ডেকে পাঠান নিজের বাসভবনে । কিন্তু ব্যর্থ হন । পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের বাকি চার ব্রিটিশ বিচারপতি জেলে পাঠাতে চেয়েছিলেন “দা বেঙ্গলি" পত্রিকার সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথকে । সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের সাপেক্ষে যখন রায় ঘোষণা হয়, আদালত কক্ষে তখন পিন পড়লেও বুঝি শব্দ হবে । বিচারপতিরা ঘোষণা করেন, তিন মাসের জন্য জেলে যেতে হবে সুরেন্দ্রনাথকে । সঙ্গে জরিমানা দিতে হবে । ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে গোটা বাংলা । স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে সে দিন পালিত হয় অরন্ধন । ব্যবসায়ীরা বন্ধ করে দেন ব্যবসার কাজ । তারপরের ঘটনা ইতিহাস । কলকাতা ছাড়িয়ে আগ্রা, ফৈজাবাদ, অমৃতসর, লাহোর, পুনেতে হয় প্রতিবাদ সভা । সাংবাদিকের জেলযাত্রা নিয়ে যা ছিল অভূতপূর্ব । দোষ তেমন কিছু ছিল না ।

“দা বেঙ্গলি" পত্রিকায় স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় প্রতিবাদী লেখা লিখেছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । সেটা 1883 সাল । প্রবল জনমতের চাপে তার বছরদুয়েক আগে প্রত‍্যাহার করা হয়েছে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট । কিন্তু সংবাদপত্রের উপর শাসকের রক্তচক্ষু কমেনি এক ফোঁটাও । সুরেন্দ্রনাথের কলমের জেরে দা বেঙ্গলি তখন কলকাতার জনপ্রিয়তম কাগজ । স্বদেশি বিপ্লবীদের নয়নের মণি । সেখানে সুরেন্দ্রনাথ ব্রিটিশ ফতোয়া উপেক্ষা করে একের পর এক আগুন ঝরা লেখা লিখতেন শাণিত কলমে ।

আরও পড়ুন : বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে হত্যা করেন কানাইলাল, দেশমাতার সেই সন্তানের বাড়ি ভগ্নদশা

1883 সালে কোনও একজনের শালগ্রাম শিলাকে অসম্মান করে পুলিশ । সম্মানের শালগ্রাম শিলাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় । ঘটনা নিয়ে ব্যাপক গোলমাল চলে বাংলার বিভিন্ন অংশে । বাংলার বহু বিশিষ্টজন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান । সুরেন্দ্রনাথ বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ব্যাপক সমালোচনা করে একটি লেখা লিখেছিলেন । যে লেখা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় জনমানষে । তাঁর বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য পরিবেশন এবং ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ তুলে হাইকোর্টে মামলা করে ব্রিটিশ সরকার । বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ঘেঁটে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, তা হল, আসলে সুরেন্দ্রনাথের কলমকে ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশ । অকুতোভয় সাংবাদিকের কলম যেনতেন প্রকারেন থামাতে চেয়েছিল সরকার । তার কারাবাসের সাজা শোনার পর আনন্দমোহন বসু লিখেছিলেন, “ It has been demonstrated by the universal out brast of grif and indiganation which the event called fourth, that the people of different Indian provinces have learnt feel for one another , and that a common bond of unity fellow feeling is rapidly being established among them."

আরও পড়ুন : খণ্ডঘোষের ঘোষবাড়ির সুড়ঙ্গতে লুকিয়ে ছিলেন ভগৎ সিং

এই ঘটনা দেশবাসীর মধ্যে একাত্মতা বাড়িয়ে দেয় অনেকটাই । দেশবাসীর কাছে এটা ব্রিটিশের অত্যাচারের একটা উদাহরণ হয়ে ওঠে । বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছিলেন, “Surrendranath 's imprisonment called fourth the first real political demonstration all over Bengal. He had already become the idol of the younger generation of his countryman. His conviction and sentance was taken up by young bengal as an open chellenge to there national honour and an attack on their love of freedom and patriotism." মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখে প্রমাদ গোনে ব্রিটিশ । সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গেই হাজার হাজার মানুষ জেলে যেতে চেয়েছিলেন । অবস্থার তীব্রতা এবং গুরুত্ব বুঝে ৩ মাসের যায়গায় 15 দিনেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথকে । পরাধীন ভারতের সাংবাদিকদের উপর অত্যাচারের এই ঘটনা এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত ।

সাংবাদিকতার ইতিহাসে বাংলা বরাবরই ভারতকে পথ দেখিয়েছে । ভারতের প্রথম সংবাদপত্র এই বাংলা থেকেই প্রকাশিত হয় । সেই ইতিহাসেরও পাতায় পাতায় লেখা আছে শাসকের অত্যাচারের কাহিনি । ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি ভারতের সংবাদপত্রের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা একটা দিন । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেরও বটে । ইতিহাসবিদরা কেউই অস্বীকার করেন না, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধি প্রদর্শিত অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের শাণিত কলমের অবদান ছিল অনেকটাই । জনমত তৈরি, স্বদেশিদের কথা সমাজের প্রতিটি কোণায় পৌঁছে দেওয়া কিংবা বিভিন্ন বিপ্লবীর বিচারের নামে আদালতের একপেশে কাণ্ডকারখানার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লেখা হত সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় । যার ভিত্তিটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল 1780 সালে । “ বেঙ্গল গেজেট"-এর আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে । যার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি । যিনি নিজে একজন ব্রিটিশ ছিলেন । এই পত্রিকা জন্মলগ্ন থেকেই শুরু করে ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঊষালগ্নে জনমত তৈরিতে বেঙ্গল গেজেটের ভূমিকা ইতিহাস কখনওই অস্বীকার করেনি । তথ্য বলছে, এই সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার পরে প্রথম দিকে সরকার বিরোধী খবরের পাশাপাশি স্থান পেত ইংরেজ কম্পানির শাসন সংক্রান্ত তথ্য, পণ্য পরিবহন, জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত খবরা খবর । পরবর্তীকালে এই পত্রিকায় তৎকালীন গভর্নর জেনেরাল ওয়ারেন হেস্টিংস, তাঁর স্ত্রী অ্যানা মারিয়া এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে লিখতে শুরু করেন হিকি । এই কলমকে ভয় পায় ইংরেজ কম্পানি । আসলে বরাবরই বোধহয় শাসকের ভয়ের কারণ কলম । হিকির বেঙ্গল গেজেট প্রতিষ্ঠার আগে উইলিয়ামস বোল্টস নামে এক শিক্ষাবিদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন একটি সংবাদপত্র । সেই ভয় থেকেই বোল্টসকে কম্পানি জোর করে একটি ইংল্যান্ডগামী জাহাজে তুলে দেয় । পরে দু'জনে ফেরত যাওয়ার পর কম্পানির শাসন নিয়ে রীতিমতো সোচ্চার হয়েছিলেন বোল্টস । কিন্তু হিকির পত্রিকা আটকাতে পারেনি ব্রিটিশ। কারণ, ওয়ারেন হেস্টিংসের কাউন্সিল সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন বেঙ্গল গেজেটের সঙ্গে । তিনি 1781 সালে ফিরে যান ব্রিটেনে । তখন থেকেই তার উপর খড়্গহস্ত হয়ে ওঠেন ওয়ারেন হেস্টিংস । সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিচারপতি এলিজা ইম্পের সহযোগিতায় হিকির বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা শুরু করে ব্রিটিশ । রীতিমতো ষড়যন্ত্রের মুখে পড়ে বেঙ্গল গেজেটের দপ্তরে ৪০০ সশস্ত্র ব্রিটিশ পুলিশ হানা দেয় । পরে ভারতের সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠা পুরুষকে যেতে হয় জেলে ।

আরও পড়ুন: 18 অগাস্ট মালদায় প্রথম উড়েছিল স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা

তারপরও কলম থামেনি । এতে আরও ভয় পেয়ে যায় ব্রিটিশরা । 1782 সালে ওয়ারেন হেস্টিংস বন্ধ করে দেন এই পত্রিকা । 1785 সাল । কলকাতার বুকে জন্ম নেয় আরও একটি সংবাদপত্র । “বেঙ্গল জার্নাল"। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান অস্বীকার করার নয় । যদিও প্রথম দিকে সরকারি বিজ্ঞাপন ছাপার কাজেই বেশি মনোযোগী ছিল । কিন্তু 1791 সালে পত্রিকার সম্পাদক উইলিয়াম ডুয়েল শুরু করে দেন সরকার বিরোধিতা । এই পত্রিকাতেই প্রকাশ পায়, “ লর্ড কর্নওয়ালিস মারাঠা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন ।" ব্রিটিশের দাবি ছিল, এই খবর প্রকাশের জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে । কিন্তু তিনি সেই ক্ষমা চাননি । এরপর তাঁকে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে উদ্যত হয় সরকার । নানা ভাবে তিনি এ দেশে থেকে যেতে সমর্থ হন । কিন্তু কর্নওয়ালিস বন্ধ করে দেন বেঙ্গল জার্নাল । এতে দমে যাননি ডুয়েল । 1794 সালে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন সংবাদপত্র । শুরু করেন সরকার বিরোধিতা । ফের ব্রিটিশ সরকার তাঁর উপর শুধু করে অত্যাচার । তাঁর বাড়িতে মাঝেমধ্যেই সশস্ত্র পুলিশ পাঠিয়ে তল্লাশি চালানো হয় । সরকার এই পত্রিকার পাঠক এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের উপর চাপ তৈরি করে । সেই চাপে একটা সময় পত্রিকা বিক্রি করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেন তিনি । কিন্তু এরই মাঝে 1794 সালে ২৭ ডিসেম্বর রীতিমতো লাট ভবনে ডেকে পাঠিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় । গ্রেপ্তারের পর তিনদিন তাঁকে ফোর্ট উইলিয়ামের দুর্গে আটকে রাখা হয় । পরে তাঁকে জোর করে ইংল্যান্ডগামী জাহাজে তুলে দেওয়া হয় ।


ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের ইতিহাস বলছে, যখনই নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম তৈরির চেষ্টা হয়েছে তখনই ব্রিটিশ সরকার তার টুঁটি টিপে ধরার চেষ্টা করেছে। “এশিয়াটিক মিরর" পত্রিকার সম্পাদককে মহীশূর যুদ্ধের পর পড়তে হয়েছিল শাসকের রোষানলে। তার জেরেই 1799 সালে ওয়েলেসলি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চালু করেন বেশ কিছু কঠোর আইন । তার মধ্যে ছিল, রবিবার সংবাদপত্র প্রকাশ না করার ফতোয়া । সরকারের প্রধান সচিবের অজান্তে কোনও সংবাদপত্র প্রকাশ করা যাবে না বলেও ফতোয়া দেওয়া হয় । এইগুলি অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠানোর কথা জানিয়ে দেওয়া হয় । তারপর বিভিন্ন সময় শাসক দাঁত বের করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সংবাদপত্রের উপরে । জারি হয়েছে সেন্সরশিপ । বহু দেশপ্রেমী সাংবাদিক নানাভাবে অত্যাচারের শিকার হয়েছেন ব্রিটিশের । সংবাদমাধ্যমকে পড়তে হয়েছে শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে । কলম কিন্তু থেমে থাকেনি৷

তথ্যসূত্র: 1. বেঙ্গল জার্নাল 2. মহাত্মা কৃষ্ণদাস পাল জীবন ও ভাবনা-ডঃ সুবোধ চৌধুরি 3. হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান জার্নালিজ়ম- মোহিত মৈত্র ; কৃতজ্ঞতা: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা

Intro:কলকাতা, ১৫ অগাস্ট: সালটা ১৮৮৩। ৫ মে। কলকাতা হাইকোর্ট সেদিন লোকে লোকারণ্য। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিড় জমিয়েছে যুব সমাজ। কারো চোখে আগুনে ভাষা। কারো মুখের ভূগোলে সংশয়। কেউ করছেন প্রার্থনা।


Body:নির্দিষ্ট সময়েই বিচারকক্ষে এলেন পাঁচজন। কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন ফুল বেঞ্চ। বিচারপতিদের একজনই মাত্র ভারতীয়। রমেশচন্দ্র মিত্র। তাঁকে নিয়ে তৎকালীন চিফ জাস্টিস স‍্যার রিচার্জ গার্থের রীতিমত মাথা ব্যাথা। দীর্ঘ ট্রায়ালের পর বিচারপতি মিত্র চেয়েছিলেন দেশপ্রেমিক সাংবাদিক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু বাকি চার বিচারপতির অন‍্য মতলব। সরকারও চায় সবক শেখাতে। এক‍্যমত‍্যের জন‍্য রায় ঘোষণার আগে গার্থ বিচারপতি মিত্রকে ডেকে পাঠান না নিজের বাসভবনে। কিন্তু ব্যর্থ হন। পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের বাকি চার ব্রিটিশ বিচারপতি জেলে পাঠাতে চেয়েছিলেন “দ‍্য বেঙ্গলি" পত্রিকার সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের সাপেক্ষে যখন রায় ঘোষণা হয়, আদালত কক্ষে তখন পিন পরলেও বুঝি শব্দ হবে। বিচারপতি ঘোষণা করেন, তিন মাসের জন্য জেলে যেতে হবে সুরেন্দ্রনাথকে। সঙ্গে জরিমানা দিতে হবে। ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে গোটা বাংলা। স্বতঃস্ফূর্ত হরতালে সে দিন পালিত হয় অরন্ধন। ব্যবসায়ীরা বন্ধ করে দেন ব্যবসার কাজ। তারপরের ঘটনা ইতিহাস। কলকাতা ছাড়িয়ে আগ্রা, ফৈজাবাদ, অমৃতসর, লাহোর, পুনেতে হয় প্রতিবাদ সভা। সাংবাদিকের জেলযাত্রা নিয়ে যা ছিল অভূতপূর্ব। দোষ তেমন কিছু ছিল না। “দ্য বেঙ্গলি" পত্রিকায় স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় প্রতিবাদী লেখা লিখেছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা 1883 সাল। প্রবল জনমতের চাপে তার বছরদুয়েক আগে প্রত‍্যাহার করা হয়েছে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট। কিন্তু সংবাদপত্রের ওপর শাসকের রক্তচক্ষু কমেনি এক ফোঁটাও। সুরেন্দ্রনাথের আগুনে কলমে দ্য বেঙ্গলি তখন কলকাতার জনপ্রিয়তম কাগজ। স্বদেশী বিপ্লবীদের নয়নের মণি। সেখানে সুরেন্দ্রনাথ ব্রিটিশ ফতোয়া উপেক্ষা করে একের পর এক আগুন ঝরা লেখা লিখতেন শাণিত কলমে। 1883 সালে কোন একজনের শালগ্রাম শিলাকে অসম্মান করে পুলিশ। সম্মানের শালগ্রাম শিলাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। ঘটনা নিয়ে ব্যাপক গোলমাল চলে বাংলার বিভিন্ন অংশে। বাংলার বহু বিশিষ্টজন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। সুরেন্দ্রনাথ বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ব্যাপক সমালোচনা করে একটি লেখা লিখেছিলেন। যে লেখা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় জনমানষে। তাঁর বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য পরিবেশন এবং ধর্মীয় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ তুলে হাইকোর্টে মামলা করে ব্রিটিশ সরকার। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ঘেঁটে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, তা হল, আসলে সুরেন্দ্রনাথের কলমকে ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশ। অকুতোভয় সাংবাদিকের কলম যেনতেন প্রকারেন থামাতে চেয়েছিল সরকার। তার কারাবাসের সাজা শোনার পর আনন্দমোহন বসু লিখেছিলেন, “ It has been demonstrated by the universal out brast of grif and indiganation which the event called fourth, that the people of different Indian provinces have learnt feel for one another , and that a common bond of unity fellow feeling is rapidly being established among them" এই ঘটনা দেশবাসীর মধ্যে একাত্মতা বাড়িয়ে দেয় অনেকটাই। দেশবাসীর কাছে এটা ব্রিটিশের অত্যাচারের একটা উদাহরণ হয়ে ওঠে। বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছিলেন, “Surrendranath 's imprisonment called fourth the first real political demonstration all over Bengal. He had already become the idol of the younger generation of his countryman. His conviction and sentance was taken up by young bengal as an open chellenge to there national honour and an attack on their love of freedom and patriotism." মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখে প্রমাদ গোনে ব্রিটিশ। সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গেই হাজার হাজার মানুষ জেলে যেতে চেয়েছিলেন। অবস্থার তীব্রতা এবং গুরুত্ব বুঝে ৩ মাসের যায়গায় 15 দিনেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথকে। পরাধীন ভারতের সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচারের এই ঘটনা এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। সাংবাদিকতার ইতিহাসে বাংলা বরাবরই ভারতকে পথ দেখিয়েছে। ভারতের প্রথম সংবাদপত্র এই বাংলা থেকেই প্রকাশিত হয়। সেই ইতিহাসেরও পাতায় পাতায় লেখা আছে শাসকের অত্যাচারের কাহিনী। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি ভারতের সংবাদপত্রের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা একটা দিন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেরও বটে। ইতিহাসবিদরা কেউই অস্বীকার করেন না, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধী প্রদর্শিত অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের শাণিত কলমের অবদান ছিল অনেকটাই। জনমত তৈরি, স্বদেশীদের কথা সমাজের প্রতিটি কোণায় পৌঁছে দেওয়া কিংবা বিভিন্ন বিপ্লবীর বিচারের নামে আদালতের একপেশে কাণ্ডকারখানার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লেখা হতো সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। যার ভিত্তিটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮০ সালে। “ বেঙ্গল গেজেট" এর আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে। যার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। যিনি নিজে একজন ব্রিটিশ ছিলেন। এই পত্রিকা জন্মলগ্ন থেকেই শুরু করে ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঊষালগ্নে জনমত তৈরিতে বেঙ্গল গেজেটের ভূমিকা ইতিহাস কখনোই অস্বীকার করেনি। তথ্য বলছে, এই সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার পরে প্রথম দিকে সরকারবিরোধী খবরের পাশাপাশি স্থান পেত ইংরেজ কোম্পানির শাসন সংক্রান্ত তথ্য, পণ্য পরিবহণ, জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত খবরা খবর। পরবর্তীকালে এই পত্রিকায় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস, তাঁর স্ত্রী আনা মারিয়া এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে লিখতে শুরু করেন হিকি। এই কলমকে ভয় পায় ইংরেজ কোম্পানি। আসলে বরাবরই বোধহয় শাসকের ভয়ের কারণ কলম। হিকির বেঙ্গল গেজেট প্রতিষ্ঠার আগে উইলিয়ামস বোল্টস নামে এক শিক্ষাবিদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন' একটি সংবাদপত্র। সেই ভয় থেকেই বোল্টসকে কম্পানি জোর করে একটি ইংল্যান্ডগামী জাহাজে তুলে দেয়। পরে দুইজনে ফেরত যাবার পর কোম্পানির শাসন নিয়ে রীতিমত সোচ্চার হয়েছিলেন বোল্টস। কিন্তু হিকির পত্রিকা আটকাতে পারেনি ব্রিটিশ। কারণ, ওয়ারেন হেস্টিংসের কাউন্সিল সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন বেঙ্গল গেজেটের সঙ্গে। তিনি ১৯৮১ সালে ফিরে যান ব্রিটেনে। তখন থেকেই তার ওপর খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন ওয়ারেন হেস্টিংস। সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিচারপতি এলিজা ইম্পের সহযোগিতায় হিকির বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা শুরু করে ব্রিটিশ। রীতিমত ষড়যন্ত্রের মুখে পড়ে বেঙ্গল গেজেটের দপ্তরে ৪০০ সশস্ত্র ব্রিটিশ পুলিশ হানা দেয় । পরে ভারতের সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠা পুরুষকে যেতে হয় জেলে। কিন্তু তার পরেও কলম থামেনি। এতে আরও ভয় পেয়ে যায় ব্রিটিশ। 1782 সালে ওয়ারেন হেস্টিংস বন্ধ করে দেন এই পত্রিকা। 1785 সাল। কলকাতার বুকে জন্ম নেয় আরো একটি সংবাদপত্র‌। “বেঙ্গল জার্নাল"। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান অস্বীকার করার নয়। যদিও প্রথম দিকে সরকারি বিজ্ঞাপন ছাপার কাজেই বেশি মনোযোগী ছিল। কিন্তু 1791 সালে পত্রিকার সম্পাদক উইলিয়াম ডুয়েল শুরু করে দেন সরকার বিরোধিতা। এই পত্রিকাতেই প্রকাশ পায়, “ লর্ড কর্নওয়ালিস মারাঠা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন।" ব্রিটিশের দাবি ছিল, এই খবর প্রকাশের জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু তিনি সেই ক্ষমা চাননি। এরপর তাকে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে উদ্যত হয় সরকার। নানা ভাবে তিনি এ দেশে থেকে যেতে সমর্থ হন। কিন্তু কর্নওয়ালিস বন্ধ করে দেন বেঙ্গল জার্নাল। এতে দমে যাননি ডুয়েল। 1794 সালে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন সংবাদপত্র। শুরু করেন সরকার বিরোধিতা। ফের ব্রিটিশ সরকার তার ওপর শুধু করে অত্যাচার। তার বাড়িতে মাঝেমধ্যেই সশস্ত্র পুলিশ পাঠিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। সরকার এই পত্রিকার পাঠক এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর চাপ তৈরি করে। সেই চাপে একটা সময় পত্রিকা বিক্রি করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেন তিনি। কিন্তু এরই মাঝে ১৯৯৪ সালে ২৭ ডিসেম্বর রীতিমত লাট ভবনে ডেকে পাঠিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তিন দিন তাকে ফোর্ট উইলিয়ামের দুর্গে আটকে রাখা হয়। পরে তাকে জোর করে ইংল্যান্ড গামী জাহাজে তুলে দেওয়া হয়।


Conclusion:ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের ইতিহাস বলছে, যখনই নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম তৈরির চেষ্টা হয়েছে তখনই ব্রিটিশ সরকার তার টুঁটি টিপে ধরার চেষ্টা করেছে। “এশিয়াটিক মিরর" পত্রিকার সম্পাদককে মহীশূর যুদ্ধের পর পড়তে হয়েছিল শাসকের রোষানলে। তার জেরেই ১৯৯৯ সালে ওয়েলেসলি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চালু করেন বেশ কিছু কঠোর আইন। তার মধ্যে ছিল, রবিবার সংবাদপত্র প্রকাশ না করার ফতোয়া। সরকারের প্রধান সচিবের অজান্তে কোন সংবাদপত্র প্রকাশ করা যাবে না বলেও ফতোয়া দেওয়া হয়। এইগুলি অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইংল্যান্ডের ফেরত পাঠানোর কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। তারপরে বিভিন্ন সময় শাসক দাঁত বের করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সংবাদপত্রের উপরে। জারি হয়েছে সেন্সরশিপ। বহু দেশপ্রেমী সাংবাদিক নানাভাবে অত্যাচারের শিকার হয়েছেন ব্রিটিশের। সংবাদমাধ্যমকে পড়তে হয়েছে শাসকের রক্ত চক্ষুর সামনে। কলম কিন্তু থেমে থাকেনি! তথ্যসূত্র: বেঙ্গল জার্নাল মহাত্মা কৃষ্ণ দাস পাল, জীবন ও ভাবনা, ডঃ সুবোধ চৌধুরী হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান জার্নালিজম, মোহিত মৈত্র কৃতজ্ঞতা: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা
Last Updated : Aug 15, 2019, 5:39 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.