চুঁচুড়া, 29 সেপ্টেম্বর : সাজানো গোছানো ঠাকুর দালান ৷ মন্দিরে ভেতরে মা অন্নপূর্ণার অধিষ্ঠান ৷ তাই সারাবছর ধরেই চলে নিত্যপুজো ৷ তবে দুর্গাপুজোর জন্য প্রতিবছরই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন হুগলির চুঁচুড়ার চকবাজারের নন্দী বাড়ির সদস্যরা ৷ মা অন্নপূর্ণা ছাড়াও ধুমধাম করে দেবী দূর্গাকে বরণ করে নেন বাড়ির মেয়েরা ৷ চলে হই হুল্লোড় ৷ এবছর 96 বছরে পা দিতে চলেছে নন্দী বাড়ির পুজো ৷ আর এই পুজোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ মন্দিরের রান্নাঘর ৷
চুঁচুড়ার নন্দী বাড়ির পুজোর ভোগ রান্নার জন্য আস্ত একটি রান্নাঘর রয়েছে । ভোগের বাসনকোসন সবই আলাদা ৷ ঠাকুরের সেবার জন্য রয়েছে পুরোহিত ও কাজের লোক । এমনিতে সারা বছরই মায়ের ভোগ রান্না হয় ৷ তবে পুজোর কয়েকটা দিন মেনুতে আসে বদল ৷ ভোগ থেকে মিষ্টি সহ পঞ্চব্যঞ্জন রান্নায় ব্যস্ত থাকেন পাঁচজন ঠাকুর । কয়েক বছরের মধ্যেই একশো বছরে পা দেবে চকবাজার নন্দী বাড়ির পুজো ৷ পূর্বপুরুষ নরেন্দ্রনাথ নন্দী প্রথমে অন্নপূর্ণা পুজোর সূচনা করেন । পরবর্তীকালে 1925 সালে নন্দী বাড়িতে একচালা দশভূজার পুজো প্রচলন শুরু হয় ।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্যান্ডেলের জিটি রোডের মানচিত্র পরিবর্তন করে ইংরেজদের নজরে আসেন নরেন্দ্রনাথ নন্দী । শের শাহের তৈরী জিটি রোড আগে ছিল ব্যান্ডেল চার্চের সামনে দিয়ে । কেওটা থেকে টায়ারবাগান হয়ে ব্যান্ডেল চার্চের সামনে দিয়ে বালির মোড় থেকে রায়বাজার হয়ে শরৎ সরণী, এই ছিল পুরানো জিটি রোড । শহরে যানজট কমাতে বৃটিশরা এতটা ঘুরপথে না গিয়ে জিটি রোডকে সোজা করতে চেয়েছিল । সাহাগঞ্জের পর কেওটা থেকে একদম সোজা ব্যান্ডেল মোড় হয়ে কোদালিয়ায় শরৎ সরণীতে মিশিয়ে দেওয়া হয় জিটি রোড । এই পরিবর্তন করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ নন্দী । তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে এরপর আরও সরকারি কাজের বরাত দেয় ব্রিটিশ সরকার ।
আরও পড়ুন : Durga Pujo : প্রায় চারশো বছর ধরে মূর্তি ছাড়া পূজিত হচ্ছেন বর্ধমানের রাজপরিবারের পটেশ্বরী দুর্গা
সেইসময় সাহেবদের যাতায়াত ছিল নন্দী বাড়িতে । কাছারি বাড়িতে সাহেবী চেয়ার টেবিলে আজও রয়েছে ৷ সেই সময় বড় দিনে সাহেবদের থেকে দামী সুরা, কেক উপহার পেতেন নরেন্দ্রনাথ বাবু । সাহেবদের কল্যাণে ঠিকাদারি থেকে একসময় প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠেন । ধর্মপ্রাণ মানুষটি অন্নপূর্ণা মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন ৷ রাধাকৃষ্ণ ও নারায়ণের প্রতিষ্ঠা করে যান । এর পাশাপাশি দুর্গাপুজোর সূচনা করেন ৷ সেই থেকে নন্দী বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে পরিবারের লোকজন এই রীতি বহন করে আসছে । চুঁচুড়ায় এখনও দেবত্ব সম্পত্তি আছে । সেখান থেকেই চলে এই নিত্যপুজো এবং দুর্গা পুজোর খরচ ৷ আজও কুমোরটুলি থেকে সাজ আসে দুর্গা প্রতিমার সাজ ৷ দুর্গা পুজোর চারটে দিন পরিবারের লোকজন ও আসে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ।
মহালয়ার পরদিন প্রতিপদ থেকে পুজো শুরু হয়ে যায় নন্দী বাড়িতে । দশ দিন ধরে চলে চন্ডীপাঠ । ষষ্ঠীতে হয় বোধন । একচালার প্রতিমা, বছরের পর বছর ধরে একই কাঠামোয় হয় প্রতিমা গড়া । আগে জন্মাষ্টমীর দিন হত কাঠামো পুজো । করোনার জন্য গতবছর থেকে সেই নিয়মে বদল হয়েছে । রথযাত্রা থেকে উল্টো রথের সময় কোনও একটা শুভদিন দেখে হয় কাঠামো পুজো । তারপর শুরু হয় প্রতিমা তৈরি । আগে সপ্তমীর দিন দরিদ্র সেবা হত । জামাকাপড়, মিষ্টি, টাকা দেওয়া হত । বছর দশেক ধরে তা বন্ধ করা হয়েছে । তার পরিবর্তে হাসপাতাল, অনাথাশ্রম, স্কুলে সাহায্য করা হয় । অষ্টমীতে হয় কুমারী পুজো । সন্ধিপুজোয় আঁখ, ছাঁচিকুমড়ো বলি দেওয়া হয় ।
আরও পড়ুন : Mankundu Durga Puja: মানকুণ্ডুর খাঁ বাড়িতে অষ্টধাতুর দেবী ‘জয়দুর্গা’ রূপে পূজিত হন
চকবাজার ইমামবাড়া অঞ্চলে অনেক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বাস । তাঁরা নন্দী বাড়ির পুজোয় আসেন । করোনার জন্য গতবছর থেকে একঘণ্টা ধরে দল ভাগ করে পুষ্পাঞ্জলি ব্যবস্থা করা হয়েছে । নন্দী বাড়ির এস্টেটের মধ্যেই রয়েছে নানা ফল ফুলের গাছ । তুলসি থেকে বেল নারকেল সবই রয়েছে । পুজোর ফুল নন্দী বাড়ির বাগান থেকেই পাওয়া যায় । দশমীর দিন এলাকা ঘুরিয়ে কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় । চুঁচুড়ার চাঁদনী ঘাটে হয় বিসর্জন ।
শোনা যায়, কাজি নজরুল ইসলাম হুগলি জেলে বন্দী ছিলেন বেশ কিছুদিন । ছাড়া পাওয়ার পর তিনি নাকি বেশ কিছুদিন নন্দী বাড়িতে ছিলেন । সেই নন্দীবাড়ির বর্তমান প্রজন্ম তাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন সযত্নে ।
আরও পড়ুন : Durga Puja : পীরের মাজারে ধ্বজা উড়িয়ে শুরু হয় চূড়ামণ রাজবাড়ির মাতৃ আরাধনা