হুগলি, 16 এপ্রিল: ইংরেজ শাসনকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার আঘাত থেকে বাঁচতে তৈরি হয়েছিল একাধিক আশ্রয়স্থল । মাটির উপর ইগলুর মতো দেখতে সেগুলি ৷ তবে ইগলুর তুলনায় অনেক বেশি মজবুত সেগুলি ৷ পাশ্চাত্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছোঁয়ায় তৈরি এই আশ্রয়স্থলগুলির নাম ছিল শেল্টার। এরকমই শেল্টার এখনও রয়েছে ভদ্রেশ্বরের এঙ্গাসে ৷ যা প্রায় একশো বছর ধরে ইতিহাস বহন করছে । বর্তমানে সেগুলিই সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন বোমারু বিমানের হামলা চলছিল ভারতে । সেই সময় আত্মঙ্কের আঁচ এসে পড়েছিল হুগলিতে । হুগলি নদীর দুই ধারে তখন তৈরি হয়েছিল একাধিক ইউরোপীয় জুট ইন্ডাস্ট্রি । ইংরেজ আমলে ভদ্রেশ্বরে এঙ্গাস জুটমিলের রমরমা অবস্থা । বিশ্বযুদ্ধের জন্য বিদেশি সাহেব থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই আতঙ্কিত । বিমান হামলা হলেই সাইরেন বাজত জুটমিল চত্বরে । বাসিন্দারা বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিত । কিন্তু বিশেষ করে ইউরোপীয়দের জন্য তৈরি হয়েছিল ইগলুর মতো মজবুত একটি আশ্রয়স্থল । বিশ্বযুদ্ধের সময় এই আশ্রয়ই মানুষের মুখে মুখে 'শেল্টার' নামে পরিচিতি পায় ।
ভদ্রেশ্বর চাঁপদানী জুটমিল এলাকায় এই ধরনের একাধিক শেল্টার তৈরি হয়েছিল । বিশেষ এক প্রকারের পাথরের মত শক্ত ইঁট দিয়ে এগুলি তৈরি হয় । তবে সেগুলি ইগলুর মতো ততোটা ছোট ছিল না । এই শেল্টারগুলি প্রায় 50 ফুট লম্বা, 12 ফুট চওড়া ও উচ্চতাও প্রায় 12 ফুট মতো । একশো বছরের বেশি সময় ধরে আজও বিদ্যমান এর মধ্যে কয়েকটি শেল্টার । কোনও বোমার আঘাতেও এখানে থাকা মানুষের ক্ষতি যাতে না হয় । জমির উপর এই সেল্টার করা হয় ৷ সেল্টারে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার সুবিধার কথা মাথা রেখে ছাদে তিনটি ভেন্টিলেশন সিস্টেম রয়েছে । এর দুই দিক আছে দুটি করে সুরক্ষিত লোহার দরজা ।
তবে এখন এই সেল্টার অবহেলায় পড়ে রয়েছে । বিশ্বযুদ্ধ মিটে গিয়েছে বহু বছর আগে । আর তাই মানুষের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে ইংরেজ আমলেই এই স্থাপত্য । স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এঙ্গাস দুর্গা মণ্ডপের কাছে একই সঙ্গে তিনটি সেল্টার ছিল । কিন্তু কালের নিয়মে বাকি দুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে । একটি মাত্র সেল্টার রয়েছে এখন ৷ কিন্তু তা এখন শিশুদের কেবল খেলার স্থলে পরিণত হয়েছে । এটাকে নানাভাবে ভাঙার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি ।
ইঁট ও চুন সুরকি দিয়ে তৈরি হলেও ভীষণ মজবুত এই স্থাপত্য শৈলী । পরবর্তীকালে এখানে এঙ্গাস কোয়ার্টার তৈরি হয় । ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর তা হাত বদল হয়ে এখন হয়েছে এঙ্গাস জুটমিলের । জুটমিলের আধিকারিক থেকে শ্রমিকরা এখনও এখানেই থাকেন । এখন যারা প্রবীণ তাদের একসময় এই সেল্টারকে ঘিরে শৈশব কেটেছে । কেউই এখানে লুকোচুরি খেলত । কেউ উপরে উঠে বসে আম খেত । এখনও তার ব্যতিক্রম হয় না । স্থানীয় ছেলেরা আজও এই সেল্টারে পাশে আশ্রয় নেয় ৷ খেলাধুলা ও গল্পের আসর বসায় । যদিও এখন কোনওরকম দুর্ঘটনা এড়াতে সেল্টারের দুটি দরজা তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা রয়েছে । মাঝে মধ্যে পুজোর জোগারের জন্য এটা ব্যবহার করা হয় ।
তবে স্থানীয় মানুষ ও ইতিহাসবিদের দাবি, বিশ্বযুদ্ধের এই স্মৃতি অনেকেরই অজানা । ভারতীয় বা রাজ্যের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এটিকে সংরক্ষণ করুক । আর এই ধরনের আঞ্চলিক স্থাপত্যকে সংরক্ষিত ও লিখিত ইতিহাস আকারে বর্ণিত করা উচিত । বিশ্বযুদ্ধের যে ধ্বংসলীলা বিশ্ব জুড়ে চলেছিল তার সাক্ষী হয়ে থাকুক এই আশ্রয়স্থল । তা নাহলে ভবিষ্যতে এই ধরনের বাস্তু স্থাপত্য নষ্ট হয়ে যাবে । বর্তমান থেকে প্রবীণ প্রজন্মের মতে দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছেন তারা এই সেল্টারকে ।
স্থানীয় বাসিন্দা সৌভিক দাস ও সুশান্ত ধারা বলেন, "বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমারু বিমানের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই ধরনের সেল্টার তৈরি করা হয়েছিল । আরও বেশ কয়েকটি সেল্টার এখানে তৈরি করা ছিল । পরবর্তীকালে তা ভাঙা পড়ে যায় । পুজোর সময় ব্যবহার করা হয় এটি । শুধু এখানেই নয় নর্থব্রুক জুট মিলেও এই ধরনের সেল্টারের দেখা মেলে । ছোটবেলা আমরা সকলেই এখানে খেলাধূলা করতাম । এটা ঘিরেই আমাদের জগৎ ছিল । বর্তমানে এর ভেতরে নোংরা হয়ে রয়েছে । সেভাবে খোলা হয় না । তালা বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই ।"
স্থানীয় শিক্ষক ও ইতিহাসবিদ শক্তিপদ ভট্টাচার্য জানান, গঙ্গার ধার ধরে শ্রীরামপুর থেকে ব্যান্ডেল পর্যন্ত অনেকগুলি ইউরোপিয়ান কলোনি তৈরি হয়েছিল । ভদ্রেশ্বর এঙ্গাস-সহ 1908 থেকে 1917 সালে অনেক কটি জুটমিল তৈরি হয় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এঙ্গাস কোয়াটারের কাছে এই ধরনের সেল্টার তৈরি হয়েছিল । ইগলু টাইপের এগুলি দেখতে ৷ বোম প্রতিরোধক ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই সমস্ত আশ্রয়স্থল । একশো বছরের হতে চলল এখনও অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে সেগুলি । এগুলিকে সংরক্ষণ করলে অনেক কিছু ইতিহাসের উঠে আসবে । এটিকে উদ্যোগ নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবে । ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষ থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এর গুরুত্ব বুঝতে পারবে ।
আরও পড়ুন: বেলুড়ের বন্ধ কারখানার জমিতে শিল্প পার্ক গড়ছে রাজ্য