চুঁচুড়া, 27 জুলাই : উৎপাদিত ফসলের তুলনায় চাহিদা কম । বাড়িতেই নষ্ট হচ্ছে ফসল । পয়সা খরচ করে চাষ করেও দাম পাচ্ছেন না । ফলে সমস্যায় রাজ্যের আলুচাষিরা । রাজ্যে অন্যতম আলু উৎপাদক জেলা হিসেবে পরিচিত হুগলি । সেখানকার কৃষকদের অভিযোগ, আলুচাষ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই সরকারের । যে পরিমাণ আলুর ফলন হয়েছে তা অন্য রাজ্যে রপ্তানি করা যেতে পারে । কিন্তু, সরকার এনিয়ে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না । কার্যত বাড়িতে নষ্ট হচ্ছে আলু । আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তাঁরা । উৎসাহ হারাচ্ছেন ।
চাষিরা ঋণ নিয়ে আলু চাষ শুরু করেছিলেন । চাষের মাঝে বৃষ্টির জন্য আলুচাষ ক্ষতির মুখে পড়েছিল । চাষিরা ভেবেছিলেন, যে আলু উৎপাদিত হবে তাতে ঋণ ঠিকই শোধ করা যাবে । কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি বলে জানাচ্ছেন আলুচাষিরা । এক চাষি যেমন বললেন, "লাভ তো দূরের কথা, ঋণ শোধের টাকা তুলতে পারিনি এখনও । ফলে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে ।"
তথ্য বলছে, রাজ্যে প্রতি বছর প্রায় 90 হাজার কুইন্টাল আলু উৎপাদিত হয় । যার মধ্যে হুগলি জেলায় এবার আলুর উৎপাদন হয়েছে হেক্টর প্রতি প্রায় 15 টন । হিমঘরে মজুত ছিল 16611514 কুইন্টাল । মজুত আলুর 30 শতাংশ বিক্রি হলেও বাকি আলুর কী হবে তা জানা নেই চাষিদের । তাঁরা জানাচ্ছেন, হিমঘরে বস্তা বস্তা জ্যোতি, চন্দ্রমুখী আলু নষ্ট হচ্ছে । এখন বাজারে জ্যোতি আলু বিক্রি হচ্ছে 12 টাকা কেজি দরে, চন্দ্রমুখী 20 টাকায় । আপাতদৃষ্টিতে খোলা বাজারে আলুর দাম ভালো মনে হলেও এতে লাভের লাভ হচ্ছে না, দাবি কৃষকদের । তাঁরা জানাচ্ছেন, খোলা বাজারে আলু যে দামে বিক্রি হচ্ছে তার অর্ধেক দামও তাঁরা পান না । এখন বাঁচার একমাত্র পথ হল রপ্তানি । অন্ধ্র ,উত্তরপ্রদেশ ও বিহারসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যেও আলু যায় । কিন্তু, সেসব রাজ্যে আগের তুলনায় বাংলার আলুর চাহিদা কমেছে ।
পোলবার এক চাষি দিলীপ ময়রা যেমন বললেন, "সরকার যদি আলু বাইরে না পাঠায় তাহলে বাংলার আলু শেষে নিলামে চলে যাবে । বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে । প্রতিদিন কাগজে দেখা যাচ্ছে চাষিরা আত্মহত্যা করেছে । কেন করছে সেটা দেখা উচিত সরকারের । কারণ আলু যদি চাষ করে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ঋণে জর্জরিত হয়ে যাব আমরা । এই ঋণের বোঝা নিয়ে পরেরবার চাষও করতে পারব না । তখন আত্মহত্যা ছাড়া আর উপায় থাকবে না । উত্তরপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশ নিজেরা আলুচাষ করায় বাংলার আলুর চাহিদা নেই । চাষিদের এক বিঘা আলুচাষ করতে 18 থেকে 20 হাজার টাকা লাগে । কিন্তু আলু বিক্রি করে অর্ধেক টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না ।"
আলু ব্যবসায়ী পুলক ঘোষ বলেন, "চাষিরা তো শেষ হচ্ছেনই । তারপর রয়েছি আমরা । আমরাও শেষ হয়ে যাচ্ছি । আমরা চাষিদের কাছ থেকে 230 থেকে 240 টাকা বস্তা আলুর বন্ড কিনে সেই আলু খুচরো বাজারে দিই । তাতে আমরাও আর লাভের মুখ দেখছি না । হিমঘরে দিনের পর দিন আলু পড়ে থাকায় 100 বস্তা আলু বাছাইয়ের পর 70 বস্তা আলু পরিষ্কার পাওয়া যাচ্ছে । বাকি কাটপিস ও ছোটো আলু কম পয়সায় বিক্রি হয় । পরিষ্কার আলুটা বাজারে 470 টাকা করে বেচা হচ্ছে । তারপরও খুচরো বিক্রেতাদের কাছে ধারেই চলে যায় আমাদের টাকা । আর আলু বাইরে পাঠানোর জন্য যে পরিকাঠামো দরকার । সেটা যেমন খরচ সাপেক্ষ তেমনই ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া আলু বাইরে পাঠানো অসম্ভব । সরকারি নিয়ম কানুন ও বাইরের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করলে আদৌ টাকা পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে । আগামী দিনে আলু ব্যবসায়ীরাও পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে ।"
আলু ব্যবসায়ীদের তরফে রাজ্য সম্পাদক লালু মুখোপাধ্যায় বলেন, "হুগলি জেলা তথা রাজ্যে আলু চাষ ও ব্যবসার সাথে এক কোটি মানুষ জড়িত । আগামী দিনে সরকার আলু নিয়ে না ভাবলে চাষি ও ব্যবসায়ী সকলেই শেষ হয়ে যাবে । হিমঘরে যা আলু মজুত হয়েছিল তার মধ্যে 30 থেকে 32 শতাংশ আলু বিক্রি হয়েছে । অগাস্ট মাসের শেষে 50 শতাংশ আলু বিক্রি হয়ে যাওয়ার কথা । কিন্তু বাজারের যা হাল তাতে মনে হয় না তা বিক্রি হবে । আলু ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনও গতি থাকছে না ।"
এবিষয়ে খুচরো ব্যবসায়ীদের গলায় আবার অন্য সুর । চুঁচুড়া বাজারের এক খুচরো বিক্রেতা বীরেন্দ্র কুমার সাউ বলেন, "চাষি থেকে খুচরো বাজারে আসতে অনেক কটা হাত ঘুরে আসার কারণেই দামটাও অনেক বেশি হয়ে যায় । এর মধ্যে মিডলম্যান থাকার ফলে এই অবস্থা । বাজারে আমরা 450 টাকা আলুর বস্তা কিনলেও সেখানে ওজনে কম থাকে । এর মধ্যেও বাছাইয়ের ব্যাপার থাকছে । এখন বর্তমান বাজার 12 টাকা থেকে 13 টাকা কেজি চলছে । কিন্তু মিডলম্যান না থাকলে আমাদের চলবে না । কারন অল্প আলুর জন্য হিমঘর থেকে আলু এনে, বাছাই করে, এখানে পর্যন্ত আনা সম্ভব হবে না । তার উপর ব্যবসায়ীদের কাছে সারা বছরে একটা ধার-বাকির ব্যাপার থাকে ।"
যদিও আলুচাষিদের এইসব দাবি খারিজ করেছে জেলা কৃষি বিপণন দপ্তর । তারা জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত আলুচাষের পরিস্থিতি ঠিকই আছে । সরকারি তরফে কোনও নির্দেশিকা আসেনি । বাজারে আলুর দামে তুলনামূলক সামঞ্জস্য আছে ।