বাংলার দ্বিতীয় বহুল চর্চিত আসনটির ভাগ্য কোন পথে ?
গত 1 লা এপ্রিল ছিল নন্দীগ্রামে ভোট ৷ সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর দ্বৈরথের সাক্ষী ছিল গোটা বাংলা ৷ এই পরিস্থিতিতেই 10 এপ্রিল চতুর্থ দফার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ৷
সিঙ্গুর আন্তজার্তিক পরিচিতি লাভ করেছিল 2006 সালে ৷ যে সময় বামেদের পরাস্থ করতে এবং বাংলার মাটিতে নিজের জমি শক্ত করার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে এই সিঙ্গুরের মাটিকেই বেছে নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ সে সময় টাটা মোটরসের গাড়ি কারখানা তৈরির জন্য বাম-জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন মমতা ৷ সেই আন্দোলন তৃণমূল কংগ্রেসের জমি শক্ত করেছিল, রাজনৈতিক ভাবে তাদের জুগিয়েছিল অক্সিজেন ৷ তবে, শনিবারের ভোট নিঃসন্দেহে তৃণমূল নেত্রীর কাছে একেবারে অন্য খেলা হতে চলেছে ৷
2001 সালে সিঙ্গুরে তৃণমূল কংগ্রেস যখন ঈর্ষনীয় ভাবে তাদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে, তখন তারা আন্দোলনের সামনের সারিতে রেখেছিল স্থানীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে ৷ যিনি কৃষি নির্ভর স্থানীয় মানুষ জনের মনে সহজে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন ৷ এই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য 2001 সাল থেকে পর পর চার বার সিঙ্গুর থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন ৷ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, যিনি মাস্টারমশাই নামে পরিচিত, জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে মমতাকে সমর্থন করছিলেন ৷ অনেকেই বলেন, সে সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন এই মাস্টারমশাই ৷
তবে, 2016-র সিঙ্গুরের আর 2021-এর সিঙ্গুরের মধ্যে অনেক পার্থক্য ৷
আরও পড়ুন : ভোট আসে-যায়, সিঙ্গুর রয়ে যায় সিঙ্গুরেই
গত এক বছর বেশ বেসুরো লেগেছিল এই মাস্টারমশাইকে ৷ 89 বছরের মাস্টারমশাইকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে দল বিরোধী বক্তব্য পেশ করতেও শোনা গিয়েছিল ৷ শেষ পর্যন্ত এবারের ভোটে মমতা তাঁকে প্রার্থী করেননি ৷ ফলস্বরূপ, রবীন্দ্রনাথবাবু বিজেপিতে যোগ দেন ৷ টিকিট না দেওয়া প্রসঙ্গে তৃণমূলের যুক্তি ছিল, বয়স হয়েছে মাস্টারমশাইয়ের, সে কারণে বিধানসভা নির্বাচনের ধকল নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না ৷
বিজেপিও যেন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ৷ কালবিলম্ব না করে মাস্টারমশাইকে তারা সিঙ্গুর থেকে বেচারাম মান্নার বিরুদ্ধে প্রার্থী করে ৷ বেচারামও এতদিন তৃণমূলের বিধায়ক ছিলেন, তবে পাশ্ববর্তী হরিপাল কেন্দ্র থেকে ৷ এবার হরিপাল থেকে মমতা বেচারাম মান্নার স্ত্রী করবীকে প্রার্থী করেছেন ৷ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর যে গুরুত্ব মমতার কাছে, সিঙ্গুরের ক্ষেত্রে বেচারাম মান্না তাঁর কাছে ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ৷ বেচারাম সিঙ্গুরকে হাতের তালুর মতো চেনেন ৷ এবং তৃণমূল স্তরে গভীর যোগাযোগের মাধ্যমে জানেন বর্তমান পরিস্থিতি ৷ স্বাভাবিক ভাবেই গেরুয়া শিবির যখন সিঙ্গুরে ঝড় তোলার চেষ্টা করছে, তখন বেচারাম যে তাদের প্রথম পছন্দ হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই ৷ বিজেপি প্রথমে বেচারাম মান্নার সঙ্গেই আলোচনা শুরু করেছিল ৷ কিন্তু, দল বদল করতে অস্বীকার করেছিলেন তিনি ৷ এর পরই মাস্টারমশাইয়ের দল বদল ৷ এবং বিজেপিতে যোগ দেওয়া ও প্রার্থী হওয়া ৷
সিঙ্গুরের বিগত দিনের পরিসংখ্যান বেশ কিছু আকর্ষণীয় তথ্য সামনে আনে ৷ একদা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি সিঙ্গুরকে অনেকটাই অন্য চেহারায় দেখা গিয়েছে 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে ৷ বিজেপি ঝড়ের গতিতে 18 টি আসনে উঠে আসে ৷ শুধু এখানেই শেষ নয় ৷ হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায় এই সিঙ্গুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে 11 হাজার ভোটে এগিয়ে ছিলেন গত লোকসভা ভোটে ৷ তৃণমূলের ভোট বাক্সে যে টান পড়ছে তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল 2016 সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৷ সেবার তৃণমূল 50 শতাংশ ভোট পায়, অথচ এই সিঙ্গুরেই 2011 সালে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল 57.61 শতাংশ ৷ মমতা হয়তো কোনও দিনই সিঙ্গুরে হেরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন না ৷ তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, বাস্তব সব সময়ই রূঢ় এবং কঠিন ৷ এটা স্বীকার করতেই হবে যে, 2019 সালে মমতা সিঙ্গুর থেকে হেরে গিয়েছিলেন ৷
সিঙ্গুর বিধানসভা কেন্দ্রটির মধ্যে যে গ্রাম গুলি রয়েছে, সেখানকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ধীরে ধীরে পুঞ্জিভূত হচ্ছিল ৷ বিশেষ করে টাটা মোটরসের দেওয়া চাকরির প্রতিশ্রুতি যুবকদের মনে এখনও রয়েছে ৷ আন্দোলনের জেরে সেই চাকরি আর হয়নি কারও ৷ যদিও, তৃণমূল অধিগ্রহণ করা জমি টাটা মোটরসের সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে আইনি লড়াইয়ের পর ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক জমিদাতাদের ফেরত দিয়েছে । তবে, সেই জমির বেশির ভাগ অংশই এখন চাষবাসের অযোগ্য ৷ বাইরে এবং ভিতরে উভয় দিক থেকেই সিঙ্গুরে যেন হয়ে উঠেছিল যুদ্ধে ক্লান্ত এক প্রান্তর ৷ আজ সেই রণক্ষেত্রে রক্তের দাগ হয়তো নেই, কিন্তু অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি আর ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন নিয়ে আজ সিঙ্গুরের চেহারাটা বড্ড কঙ্কালসার ৷ এই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তৃণমূল স্তরের দুর্নীতির অভিযোগ ৷ এ সবই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা ফেলেছে ৷ আর সন্দেহ নেই, পরিস্থিতি বামেদের পক্ষে কিছুটা হলেও সহায়ক হতে শুরু করেছে ৷
বামেরা এবার একজন তরুণকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছে ৷ এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক 27 বছরের সৃজন ভট্টাচার্য নিঃসন্দেহে বৃদ্ধ এবং পোড় খাওয়াদের প্রচারের মাঝে সতেজের বার্তা ৷ কলকাতা থেকে 40 কিলোমিটার দূরে সিঙ্গুরে জমি আঁকড়ে লড়াই চালাচ্ছেন তিনি ৷ এর সঙ্গে রয়েছে সিঙ্গুরে 8 শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট ৷ তৃণমূল এবং বিজেপি দুই দলই এই ভোট ব্যাঙ্কের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে ৷
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্লোগান 'খেলা হবে' এবং মোদি-শাহের 'আসল পরিবর্তন'-এর আহ্বান সিঙ্গুরে একটি লক্ষণীয় বাতাবরণ তৈরি করেছে ঠিকই ৷ তবে বঙ্গ নির্বাচনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যে হাওয়া, সেই হাওয়াটাই যেন কোথাও নেই সিঙ্গুরের নির্বাচনে ৷ দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে সামান্য দূরে টাটাদের পরিত্যক্ত জমি বা ধান খেত বা খেজুরের ঘর গুলির উপর দিয়ে কোনও পক্ষের হাওয়া না বওয়ার ফলে, সিঙ্গুরের নির্বাচন এই বার অনেকটা ব্যক্তি কেন্দ্রীক ৷ সেখানে লড়াইটা আর কৃষি বনাম শিল্পের নয়, জমি অধিগ্রহণ বা দলের রাজনীতির না ৷ সিঙ্গুর সবই দেখেছে বড্ড কাছ থেকে ৷ এই বারের শনিবাসরীয় সিঙ্গুরের ভোট-যুদ্ধ নবীন বনাম প্রবীণ বনাম চেনা ময়দানের লড়াই ৷ ফল 2 রা মে ৷
(লেখক, ইটিভি ভারতের নিউজ় কো-অর্ডিনেটর )