শিলিগুড়ি, 15 অগাস্ট : বয়সের ভারে ন্যুব্জ । হাতে ক্রাচ নিয়ে কোনওক্রমে হাঁটছেন ৷ স্মৃতিশক্তিতে কিছুটা মরচে পড়লেও বয়সের তুলনায় তা বেশ উজ্জ্বলই ৷ শোনালেন দেশ স্বাধীনের কাহিনী ৷ যদিও যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়েছিলেন, তা এখনও পূরণ হয়নি ৷ তাই আক্ষেপ গলায় ৷ আর সেই আক্ষেপ বুকে নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন টিকেন্দ্রজিৎ মুখার্জি ৷
জন্মের সময় স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল দেশ ৷ থাকতেন অধুনা বাংলাদেশের সুন্দরবনের কাছে এক গ্রামে ৷ ছোটো থেকেই স্বদেশি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন ৷ ছাত্রাবস্থায় সেই অঙ্কুর আরও বিকশিত হয় ৷ ম্যাট্রিক পাশ করেই সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন ৷ তখন তাঁর কাজ ছিল, গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ রোপণ করা ৷ সেজন্য সাইকেলে করে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতেন ৷ সুর তুলতেন, "মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই ।" ইংরেজদের প্রতি অনুরক্ত জমিদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য গ্রামবাসীদের একজোট করেছিলেন ৷ একই সঙ্গে চলত আফিমের বিরুদ্ধে প্রচার ৷
এই সংক্রান্ত আরও খবর : রাসবিহারী বসুর জন্মভিটেয় এখন খড়ের গাদা
উদ্বুদ্ধ ছিলেন গান্ধিজির ভাবধারায় ৷ মন্ত্রমুগ্ধের শুনতেন তাঁর কথা ৷ টিকেন্দ্রজিৎ মুখার্জির মনের মণিকোঠায় সংরক্ষিত রয়েছে গান্ধিজির সেই কথাগুলি ৷ টিকেন্দ্র বলেন, "গান্ধিজি বলেছিলেন, স্বাধীনতার আন্দোলনের পথে অনেক বাধা আসবে ৷ প্রতিকূলতা আসবে ৷ বিপ্লবীদের মনোবল ভাঙতে জেলে ঢোকাবে ইংরেজ পুলিশ ৷ তাই সদ্য যৌবনে পা দেওয়া প্রজন্মকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাটন হাতে তুলে নেওয়ার আহ্বান করেছিলেন ৷" কথাটা বলার সময় টিকেন্দ্রজিতের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল, শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে আজও তাঁর রোমাঞ্চ ও শিহরণ জাগছে ৷ স্মৃতি হাতড়ে বললেন, "গান্ধিজি বলেছিলেন, তোমাদের নেতা হতে হবে । গান্ধিজির বক্তব্যে রক্তে শিহরণ জেগেছিল । শুরু হল ইংরেজদের তাড়ানোর লড়াই । গান্ধিজিই আমাদের নেতা ছিলেন ৷"
এই সংক্রান্ত আরও খবর : ক্ষুদিরাম বসুকে বাঁচাতে লড়েছিলেন নরেন্দ্রকুমার
একবার বোমা আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যুবক টিকেন্দ্রজিতকে ৷ কাজটা একেবারেই সহজ ছিল না ৷ নদীপথে ব্রিটিশ পুলিশের রক্তচক্ষুকে ফাঁকি দেওয়াটাই চ্যালেঞ্জ ৷ প্রবল ঝুঁকি ছিল ৷ কিন্তু, তার কি পরোয়া করে স্বাধীনতার আদর্শে টগবগ করা রক্ত ? গেলেন বোমা আনতে ৷ পুলিশের নজর এড়িয়ে কলকাতা হয়ে খুলনায় গিয়ে বোমা নিয়ে এলেন ৷ যখনই যে কাজ দেওয়া হয়েছে, নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ৷ এগিয়ে গেছেন অসীম সাহসের সঙ্গে ৷ গ্রেপ্তারও হয়েছেন অসংখ্যবার । তা যেন আরও উদ্যম বাড়িয়েছে ৷ বেড়েছে আরও মনের জোর ৷ স্থানীয় জেলে বোমা মেরেছেন ৷ উড়িয়ে দিয়েছেন জেলখানার প্রাচীর ।
এই সংক্রান্ত আরও খবর : অবহেলায় স্বাধীনতা সংগ্রামী বিমলপ্রতিভার শেষচিহ্ন
বৃথা যায়নি টিকেন্দ্রজিতের মতো অসংখ্য বিপ্লবী, যুবকের লড়াই ৷ 1947 সালের 15 অগাস্ট স্বাধীন হয়েছে দেশ ৷ সেদিনের যুবক আজ 94 বছরের বৃদ্ধ ৷ এখন থাকেন শিলিগুড়ির রবীন্দ্রনগরে ৷ ঘরের বাইরে বার হওয়া বন্ধ ৷ ঘরের মধ্যেই হাঁটাহাঁটি করেন ৷ সেভাবে কারও সাহায্য লাগে না ৷ ক্রাচ নিয়েই হাঁটতে পারেন ৷ আর্থিক কোনও অনটন নেই ৷ তবে, স্ত্রী মারা গেছেন ৷ ছেলে-বউমার সঙ্গে থাকেন ৷ কিছুটা হলেও একাকীত্ব গ্রাস করেছে ৷ বললেন, "সঙ্গীসাথি সকলেই মারা গেছেন । আমিও দিন গুণছি । আগে স্বাধীনতা দিবসের নানা অনুষ্ঠানে যেতাম । এখন ঘরবন্দী ৷ জানালা দিয়ে আকাশ দেখি । মুক্ত পাখির দল উড়ে বেড়ায় । ওদের দেখি ।" পেয়েছেন তাম্রলিপ্ত সম্মান ৷ পরে তাঁকে সংবর্ধিত করেছেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল ৷ তবে, আক্ষেপও রয়েছে ৷ যে স্বাধীনতার ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছিলেন, সেই স্বাধীনতার স্বাদ অবশ্য পাননি বলে মন্তব্য টিকেন্দ্রজিতের ৷ তা নিয়ে গলা থেকে কিছুটা আক্ষেপও ঝরে পড়ল ৷ তাঁর কথায়, "এটা কেমন স্বাধীনতা? আমরা এমন স্বাধীনতা চাইনি । দেশভাগ চাইনি ৷ আরও একবার স্বাধীনতার লড়াই দরকার । সকলের জন্য আচ্ছাদন দরকার । প্রয়োজন অন্নসংস্থান, বাক স্বাধীনতা । " কথাগুলি বলার সময় চোখদুটো যেন চিকচিক করে উঠল ৷ তারপর হারিয়ে গেলেন ভাবনার জগতে ৷
এই সংক্রান্ত আরও খবর : বিপ্লবীদের অনুশীলন সমিতি এখন ব্যাডমিন্টন ক্লাব, আগামীতে সংগঠনের ব্যাটন কে ধরবে তা নিয়ে প্রশ্ন