শিলিগুড়ি, ২৬ এপ্রিল : রাস্তায় সারি দিয়ে পড়ে আছে সবজি । কেনার কেউ নেই । লকডাউনে এটাই চিত্র সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে । রাজ্যের মধ্যে সবজি চাষে উত্তরবঙ্গের স্থান বরাবরই উপরের দিকে । এবারও তার অন্যথা হয়নি । উত্তরবঙ্গের প্রায় সব জেলা জুড়েই চাষ হয়েছে চাল কুমড়ো, পটল, ঝিঙে, করলা সহ বেশ কিছু সবজির । এবং এবারে আবহওয়া অনুকূল থাকায় ফলনও হয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে ।
কিন্তু এবারের চিত্রটা একটু আলাদা । কোরোনা মোকাবিলায় রাজ্য তথা দেশজুড়ে লকডাউন । আর এই লকডাউনেই সমস্যায় পড়েছেন উত্তরবঙ্গের কয়েকহাজার সবজি চাষি ও সবজি বিক্রেতা । কোথাও দেখা নেই মহাজনের । কোথাও মিলছে না সবজি পরিবহনে ট্রাক । কোথাও আবার পসরা সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা, কিন্তু ক্রেতার দেখা মিলছে না । ফলে সবজি বাজারে ফেলেই চলে আসতে হচ্ছে তাদের ।
কোচবিহার জেলায় দিন দিনহাটা-১ , কোচবিহার-১ ,সিতাই, শীতলকুচি ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকায় সবজি চাষ হয় । এখানকার উৎপাদিত সবজি রাজ্যের অন্যান্য জেলার পাশাপাশি অসম , মেঘালয় ,অরুনাচল প্রদেশ ও বিহারে যায় । বিভিন্ন পাইকারি সবজি বাজার থেকে ট্রাকে করে অথবা বিভিন্ন ষ্টেশন থেকে ট্রেনে চাপিয়ে গন্তব্যস্তলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু লকডাউনের জেরে বন্ধ পরিবহন ব্যবস্থা। ফলে ভিনরাজ্যে যাচ্ছে না সবজি । ফলে স্থানীয় বাজারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে চাষীদের । কিন্তু স্থানীয় বাজারে এই বিপুল পরিমাণ সবজি লাগছে না । চাহিদা অনুপাতে বেশি সবজি বাজারে আসায় দাম মিলছে না। মাঠে উৎপাদিত সবজি বাজারে নিয়ে এলে পাইকাররা কিনছেন না। যাঁরা কিনছেন তাঁরাও ঠিকমতো দাম দিচ্ছেন না । ফলে দিশেহারা চাষিরা । তাঁদের বক্তব্য আরও লকডাউন চললে তাঁরা বিপাকে পড়বেন ।
এক চাষি সিরাজুল হক বলেন, "এই লকডাউনের জন্য আমাদের বিপুল ক্ষতি হল । ফসল বাজারে কেউ কিনছে না । বেগুন বিক্রি না হওয়ায় গাছ কেটে ফেলেছি । কী করে যে দিন চলবে জানি না ।" চালকুমড়ো চাষি আহমদ আলি ইটিভি ভারতকে তাঁর সমস্যার কথা জানালেন । তিন বলেন, "বাজারে তো চালকুমড়ো কেউ আর নেয়না । যে টাকা খরচ করছি তা উঠছে না । আরও লকডাউন চললে কৃষকরা মারা পড়বে ।"
একই সমস্যায় পড়েছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের চাষিরাও । তাদের উৎপাদিত ফসলের দাম পাচ্ছেন না তাঁরা । দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট ব্লকের চকভৃগু, বোয়ালদাড় এবং বোল্লা গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কিছু এলাকায় মিষ্টি কুমড়ো চাষ হয় । পলিমাটি হওয়ায় এই এলাকায় মরশুমি মিষ্টি কুমড়ো চাষ ব্যাপক হারে হয়। প্রত্যেক বছর কয়েক হাজার কৃষক এই মিষ্টি কুমড়ো চাষ করেন । এবারও বালুরঘাট ব্লকে প্রায় 150 হেক্টর জমিতে মিষ্টি কুমড়ো চাষ করেছেন কৃষকরা। অন্যবারের তুলনায় এবারে মিষ্টি কুমড়োর ফলন ভালো হয়েছে। তবে লকডাউনের জন্য মিষ্টি কুমড়ো বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা। কারণ লকডাউনের জন্য বাইরে থেকে মহাজনরা আসতে পারছেন না জেলায়। এদিকে কুমড়ো উঠে যাওয়ায় কৃষকরা মাঠের মধ্যেই তা জমা করছেন। আবার কেউ কেউ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। বৈশাখ মাসে ঝড় বৃষ্টির সম্ভবনা বেশি থাকে। মাঝে মাঝে কালবৈশাখি ঝড় হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে কৃষকদের ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর ।
এবিষয়ে দুর্লভপুর এলাকার মিষ্টি কুমড়ো চাষি জয়ন্ত মণ্ডল ও রাজু মণ্ডল জানিয়েছেন, এই এলাকার প্রায় এক হাজার জন কৃষক মিষ্টি কুমড়ো চাষ করেন। ফল ওঠার সময় হয়। এই সময় বাইরে থেকে পাইকাররা এসে মাঠ থেকেই তা কিনে নিয়ে যেতেন। নদিয়া, বীরভূম, এমনকি অন্ধ্রপ্রদেশ সহ বেশকিছু বাইরের রাজ্য থেকে পাইকাররা আসেন। তবে লকডাউনের ফলে এবার পাইকাররা আসতে পারছেন না। এর ফলে কুমড়ো তারা বাড়িতেই আপাতত জমা করে রাখছেন। এদিকে পাইকাররা দ্রুত না আসতে পারলে অনেক ফল নষ্ট হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে তাঁদের।
শিলিগুড়ির বিভিন্ন বাজারে গেলেই দেখাযাচ্ছে হঠাৎ করেই দাম পড়ে গিয়েছে শাক সবজির। ঝিঙা, আলু, টম্যাটো লংকা বিক্রি হচ্ছে নামমাত্র দামে। ক্ষতি স্বীকার করেই সেসব বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। কিন্তু এভাবে দাম কমল কেন শাকসবজির ? খোঁজ নিলে মূলত দেখা গিয়েছে, একদিকে হোটেল রেস্তরাঁ বন্ধ থাকায় চাহিদার তুলনায় জোগান বেড়ে গিয়েছে । এই পরিস্থিতিতে কম দামে বিক্রি হচ্ছে উত্তরবঙ্গে উৎপাদিত বহু শাকসবজি । এর পাশাপাশি ভিনরাজ্যে রপ্তানীর পথ বন্ধ থাকায় কার্যত উৎপাদন খরচটুকু উঠলেই সবজি বিক্রি করে দিতে চাইছেন বিক্রেতারা । এর জেরে ক্রেতাদের লাভ হলেও আখেরে চরম অনটনের মুখে পড়েছেন সবজি উৎপাদক চাষি ও বিক্রেতারা।
পাশাপাশি সবজি বিক্রেতারা বলছেন বহু কলকারখানা বন্ধ। লোকের হাতে টাকাও নেই। কাজ হারিয়ে বহু যুবক রাতারাতি সবজি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে বাজারে কমছে ক্রেতার সংখ্যা। শিলিগুড়ির বিধান মার্কেট, ক্ষুদিরামপল্লী বাজারসহ নানা বাজারের ছবিটা একই রকম। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের অনটনের কথা জানিয়েও কম দামে সবজি বিক্রি করছেন বিক্রেতারা ।
উত্তরবঙ্গের মধ্যে সবজির চাষ জলপাইগুড়ি জেলায় সবচেয়ে বেশি হয়। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি, ধুপগুড়ি,রাজগঞ্জ ব্লকেই বিশেষ করে সবজির চাষ হয়ে থাকে । অন্যদিকে আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটা এবং কোচবিহার জেলার বিভিন্ন জায়গায় হয় । কিন্তু প্রতিবছর ভিনরাজ্যে সবজি রপ্তানি এই জলপাইগুড়ি থেকেই হয় । কিন্তু এবার লকডাউনের জেরে সবজির বাজার একদমই মন্দা । উৎপাদন বেশি চাহিদা কম । ভিন রাজ্য থেকে পাইকাররা আসছেন না । কিনছেন না সবজিও ।
সবজি ব্যবসায়ী শ্যামল সরকার, তহিদুল ইসলামরা বলছেন, আমরা ভিন রাজ্যে সবজি পাঠাতে পারছি না । কারণ সব রাজ্যে ট্রাক যেতে দিচ্ছে না । লকডাউনে পঞ্জাবে কোনও সবজি পাঠানো যাচ্ছে না। সেখানে একেবারেই অন্য রাজ্য থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । অন্যান্য বছর কৃষকরা যেমন দাম পেতেন এবার কিছুই পাচ্ছে না । কৃষকদের চাষের দামই উঠছে না ।
কৃষিজাত পণ্যের দাম না পেয়ে হাটেই সবজি ফেলে দিচ্ছেন বিক্রেতারা । কয়েক কুইন্টাল করলা, টম্যাটো ফেলে চলে যাচ্ছেন কৃষকরা । এই পরিস্থিতিতে এই সবজি চাষি ও বিক্রেতা চরম সমস্যায় । তবে এত কিছুর পরও তাঁরা হাল ছাড়ছেন না । তাঁদের আশা ফের সুদিন ফিরবে সবজি চাষে ।