বংশীহারি, 7 জুলাই: তাঁরা জানেন, ভোট তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার ৷ তাঁরা এটাও জানেন, নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে হলে গ্যাঁটের কড়ি ভালোই খসাতে হবে ৷ কারণ, ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে যেতে হলে তাঁদের পয়সা খরচ করে জীবন হাতে নিয়ে বর্ষার ভরা টাঙন পেরোতে হবে ৷ নইলে 15 কিলোমিটার ঘুরপথে পাড়ি দিতে হবে বুথের উদ্দেশ্যে ৷ এতদিন গরমে ভোট হয়েছে ৷ কোনওরকমে নদী পেরিয়েছেন ৷ প্রতি ভোটের সময় রাজনীতির কারবারিদের কাছে আকুতি জানিয়েছেন, টাঙনের সেতুটা হয়ে গেলে তাঁদের কোনও সমস্যা থাকবে না ৷ আশ্বাসের অনেক জল টাঙন দিয়ে গড়িয়ে গিয়েছে ৷ সেতু হয়নি ৷ তাই এবার তাঁরা কেউ গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে ভোট দিতে যেতে রাজি নন ৷ এবার ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোরই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গ্রামবাসীরা ৷
এবারের ভোটে এটাই কাহিনী বংশীহারি ব্লকের এলাহাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের চকচাঁদমুখ গ্রামের ৷ গ্রামে 62টি পরিবারের বাস ৷ ভোটার সংখ্যা প্রায় 200 ৷ এই গ্রামে কোনও ভোট গ্রহণ কেন্দ্র নেই ৷ গ্রামবাসীদের পাঁচ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা উজিয়ে টাঙন নদী পেরিয়ে বরখোর ও দাসুল বুথে গিয়ে ভোট দিতে হয় ৷ ঘোর বর্ষায় গ্রামের রাস্তা দিয়ে এখন চলাচল করাটাও কষ্টসাধ্য ৷ তাঁরা প্রশাসনের কাছেও বহুবার সমস্যা সমাধানের আর্জি জানিয়েছেন ৷ অভিযোগ কাজ হয়নি ৷ তাঁদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেনি প্রশাসনও ৷ গ্রামে মূলত আদিবাসী ও নমশূদ্র পরিবারের বাস ৷ সবাই দিনমজুরি করে পেট চালান ৷ গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, ভরা বর্ষায় নৌকায় টাঙন পার করা মানে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া ৷ মাঝির কাছেও পারাপারের পয়সা গুনতে হবে ৷ নদী এড়াতে গেলে ঘুরপথে 15 কিলোমিটার পথ তিনবার যানবাহন পরিবর্তন করে বুথে যেতে হবে ৷ ভোটের দিন অত গাড়ি মিলবে কোথায় ! তাই এবারের ভোট আর তাঁরা দেবেন না ৷
গ্রামের বাসিন্দা মতি টুডু বলেন, "বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে আমরা নারায়ণপুর বুথে ভোট দিই । ওই বুথটা তুলনামূলক কাছে ৷ কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচন আসলেই আমাদের সমস্যায় ফেলে দিচ্ছে প্রশাসন। এমনিতেই আমরা শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। এত টাকা খরচ করে জলকাদা রাস্তায় ঘুরপথে তিনবার বাহন পালটে কী করে ভোট দিতে যাব ? আমাদের গ্রামের নিকটবর্তী ব্রজবল্লভপুর পঞ্চায়েতের বুথে ভোট নেওয়া হলে তবেই আমরা ভোটে অংশগ্রহণ করব। আমাদের পাশে উত্তর লক্ষ্মীপুর গ্রাম। ওই গ্রামের মানুষ যদি ব্রজবল্লভপুরের বুথে ভোট দিতে পারে তবে আমরা কেন সেই সুযোগ পাব না? আসলে আমরা গরিব বলে সাহেবদের ভাবার সময় নেই।"
আরেক গ্রামবাসী বনানী সরকারের বক্তব্য, "মাঠ উজিয়ে, নদী পেরিয়ে এলাহাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের বরখইর বুথে ভোট দিতে যাওয়ার মানসিকতা আমাদের নেই । ঘুরপথে তিনবার যানবাহন পরিবর্তন করে শুধুমাত্র ভোট দিতে যাওয়া আমাদের কাছে বিলাসিতা ৷ এত কষ্ট করে, টাকা খরচ করে কেন ভোট দিতে যাব? তাই এবার আমরা গ্রামের কেউই ভোট দিতে যাচ্ছি না। এই সমস্যা নিয়ে প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল ৷ প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি ৷"
বংশীহারি ব্লকের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার সুব্রত বাউল বলছেন, "এনিয়ে আমি কোনও অভিযোগ পাইনি ৷ বিষয়টি খতিয়ে দেখছি ৷ ওই গ্রামের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা করা হবে৷ " প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, বুনিয়াদপুর পৌরসভা গঠনের আগে এই এলাকা শিবপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে ছিল ৷ তখন চকচাঁদমুখ গ্রামের বাসিন্দারা গ্রাম থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে নারায়ণপুর গ্রামের বুথে ভোট দিতেন ৷ পৌরসভা গঠনের পর এই গ্রামটি এলাহাবাদ ও ব্রজবল্লভপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ডিলিমিটেশনে চকচাঁদমুখ গ্রামের ভোটকেন্দ্র করা হয়েছে বরখোর ও দাসুল বুথে ৷
আরও পড়ুন: দু'দশকেরও বেশি সময় পর পাহাড়ের পঞ্চায়েত নির্বাচন, অতীত হয়েও প্রাসঙ্গিক সুভাষ ঘিসিং !
তবে পাশের ব্রজবল্লভপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এই গ্রামের বুথ করা হলে গ্রামবাসীদের কোনও সমস্যা থাকত না ৷ যে গ্রামে এখনও প্রশাসন যোগাযোগের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি, সেই গ্রামের বাসিন্দাদের ওই প্রশাসনই কীভাবে ভোটদানের জন্য এতটা পথ পাড়ি দেওয়াতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলিরও ৷ যদিও ভোটের আগে এনিয়ে মুখ খুলতে রাজি নয় কোনও রাজনৈতিক দলই ৷