হিলি, 29 অক্টোবর : 87 বছর পর প্রথমবার ঐতিহাসিক হিলি মেল ডাকাতি দিবস পালিত হল ৷ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা পুলিশের তরফে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ৷ 87 বছর পর সরকারিভাবে বিপ্লবীদের সম্মান জানানোয় খুশি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পরিবারের সদস্যরা ৷
1933 সালের 28 অক্টোবর হিলিতে বাংলার বিপ্লবীরা আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে দার্জিলিং মেলে ডাকাতি করেন । বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য তখন টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে । উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং থেকে সেই সময়ে রাজস্ব আদায় করে টাকা পাঠানো হত কলকাতায় । ট্রেনে করে আসত টাকা ৷ সেই ট্রেনে ডাকাতির ছক কষার পাশাপাশি ট্রেন লুট করে বিপ্লবীরা । ঘটনার 87 বছর পর প্রথম দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা পুলিশের তরফে ঐতিহাসিক হিলি মেল ডাকাতি দিবস পালন করা হয় ।
অবিভক্ত দিনাজপুরের ইতিহাসে হিলির দার্জিলিং মেল ডাকাতির ঘটনা একটি অন্যতম রোমাঞ্চকর ঘটনা । সেই সময় হিলির রেল স্টেশন দিয়ে দার্জিলিং মেলে ইংরেজ সরকারের ডাক বিভাগের সমস্ত অর্থ আদানপ্রদান করা হত । তা লুট করে নিজেদের সংগঠনের এবং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন অনুশীলন সমিতির সদস্যরা । সেই উদ্দেশ্যে 1933 সালের 27 অক্টোবর রাতে হিলি রেল স্টেশনে জড়ো হয়েছিলেন 15 জনের একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল । দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী । তাঁদের প্রত্যেকের হাতেই ছিল আগ্নেয়াস্ত্র । 28 অক্টোবর গভীর রাতে ট্রেনটি স্টেশনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মেল ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া চেষ্টা করেন বিপ্লবীরা ৷ সেই সময় উপস্থিত রেলকর্মী ও মালবাহকেরা হইচই শুরু করে দেন ৷ স্টেশনমাস্টার সতীশ চন্দ্র দে গুলি চালাতে শুরু করলে বিপ্লবীরাও পালটা গুলি চালায় । বিপ্লবীদের গুলিতে কালীচরণ মাহাত নামে এক রেলকর্মী গুরুতর আহত হন । এদিকে সেই সুযোগে মেলব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে বিপ্লবীরা স্টেশন ত্যাগ করেন । আহত রেলকর্মীকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয় ।
বিপ্লবীরা মেলব্যাগ চুরি করার পর সেখান থেকে তিনভাগে পালিয়ে যান ৷ কুমারগঞ্জের সমজিয়া এলাকায় একটি নৌকা করে নদী পার হওয়ার সময় সেখানকার জমিদারের নেতৃত্বে ধরা পড়ে যান । 15 জনের মধ্যে 13 জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে । তার নেতৃত্বে ছিলেন প্রাণকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, হৃষিকেশ, সত্যব্রত চক্রবর্তী, সরোজকুমার বসু, অশোকরঞ্জন ঘোষ, হরিপদ বসু, প্রফুল্লনারায়ণ সান্যাল, শশধর সরকার, কালীপদ সরকার, লালু পাণ্ডে, আবদুল কাদের চৌধুরি, কিরণচন্দ্র দে, রামকৃষ্ণ সরকার, বিজয়কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুবোধ দত্ত । তাঁদের মধ্যে চারজনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় । বাকিদের সশ্রম কারাদণ্ড হয় । বিপ্লবীদের হয়ে দীর্ঘদিন আইনি লড়াই লড়েন নিশিথনাথ কুন্ডু । অবশেষে বিপ্লবীদের ফাঁসির আদেশ রদ করে কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয় । এদিন বিপ্লবীদের পরিবারের মধ্যে রামকৃষ্ণ সরকারের ছেলে প্রণবকুমার সরকার, কালীপদ সরকারের ছেলে কুমার সরকার এবং কিরণচন্দ্র দে'র পুত্র প্রদীপ কুমার দে উপস্থিত ছিলেন । এছাড়াও জেলা পুলিশ সুপার দেবর্ষি দত্ত, DSP হেডকোয়ার্টার ধীমান মিত্র, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহম্মদ নাসিম এবং ইতিহাসবিদ ও গবেষক সমিত ঘোষ, কৃষ্ণপদ মণ্ডল, হিমাংশু সরকার সহ অন্যান্য বিশিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন । সকলেই বিপ্লবীদের স্মৃতিচারণা করেন ।
এবিষয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার পুলিশ সুপার দেবর্ষি দত্ত বলেন, "1933 সালের এই দিনে হিলির বীর বিপ্লবীরা মেল ডাকাতি করেছিলেন । সেই দিনটিকে আজ স্মরণ করতেই এদিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় । এই অনুষ্ঠান আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা ৷ আগামী প্রজন্মের কাছে তাঁদের বলিদানের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করা । তাই সেই দিনটিকে স্মরণ করতে অনুষ্ঠান উদযাপিত করা হয় ।" এবিষয়ে ইতিহাসবিদ সমিত ঘোষ বলেন, "হিলির এই মেল ডাকাতির ঘটনা ইতিহাসের এক অন্যতম সংগ্রামের সূচনা করে । এই ঘটনাটি যেখানে ঘটেছিল তা এখন বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে । জেলায় প্রথম পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে বিপ্লবীদের স্মরণ করা হয় । তাই পুলিশ প্রশাসনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই ।"
হিলির মেল ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী রামকৃষ্ণ সরকারের ছেলে প্রণবকুমার সরকার বলেন, "দেরিতে হলেও পুলিশ প্রশাসন আমার বাবা এবং তাঁদের সহকারী বিপ্লবীদের স্মরণ করতে এই ধরনের আয়োজন করেছে । তাতে খুব ভালো লাগছে । আগামীদিনে চাইব হিলিতে সেই বিপ্লবীদের একটি স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হোক ।"