কাকদ্বীপ, 29 অগাস্ট : মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের সংগ্রাম কতটা কঠিন ছিল, তা জানা নেই ৷ তবে বাস্তবের জীবন সংগ্রামটা বোধহয় মারাত্মক কঠিন অর্জুনের ক্ষেত্রে । এই অর্জুন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে ৷ আটটার আপ নামখানা-শিয়ালদা লোকাল । কাকদ্বীপ স্টেশন থেকে ছাড়ার পর একটি কামরার মধ্যে একটি বছর 14-র কিশোরের দেখা মিলবে । কোনওদিন সিটের ওপর আবার কোনওদিন মেঝেতে বই, খাতা নিয়ে এক মনে পড়াশোনা করে চলেছে ওই কিশোর । পাশের সিটে ঘুমে কাতর বছর সাতের ছোট বোন । পাশে আছেন বছর ত্রিশের আরতি দাস ৷ সেই মহিলার চোখ-মুখ জুড়ে একরাশ ক্লান্তি। তিনিও কখনও সখনও ঢুলে পড়ছেন । ওই মহিলা কিশোরের মা । একের পর এক স্টেশনে ট্রেন থামছে ৷ যাত্রীরা ওঠা-নামা করছেন, কিন্তু ওই কিশোরের অন্যদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই , এক মনে পড়ে চলেছে সে ৷
অভাবের সংসার, দু'বেলা দু'মুঠো ভাত জোগাড় করতেই যেখানে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে বাড়ি ঘরের স্বপ্ন দেখা অলীক কল্পনা । তাই দিনের কিছুটা সময় কাকদ্বীপ স্টেশন চত্বর, বাকিটা সময় চলন্ত ট্রেন ও রাতে শিয়ালদহ কোর্ট চত্বরই ঠিকানা স্বামী পরিত্য়ক্তা, ফলবিক্রেতা আরতি দাস ও তাঁর দুই সন্তানের । অর্জুনের পড়াশোনার বেশিরভাগটাই হয় চলন্ত ট্রেনে ফলবিক্রেতা মায়ের পাশে, কিংবা প্ল্য়াটফর্মের ধারে বসে ৷ নেই মাথা গোঁজার ঠাই ।
কাকদ্বীপের বামুনের মোড় এলাকায় বছর আটেক ধরে মরশুমি ফল বিক্রি করেন আরতি দাস । বছর 15 আগে এলাকার যুবক বলাই দাসের সঙ্গে আরতির বিয়ে হয়েছিল । দুই সন্তান হওয়ার পর আরতিকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় স্বামী । দুই নাবালক সন্তানকে নিয়ে তখন অথৈ জলে আরতি। আরতির বাপের বাড়ি রায়দিঘির কাশীনগর গ্রামে । বাপের বাড়িতেও টানাটানির সংসার ৷ সেইসময় আরতির দরিদ্র মা মেয়ের হাতে 500 টাকা তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ''নিজের মতো করে কিছু করে সংসার চালা । '' সেই শুরু । মরশুমি ফল নিয়ে একসময় কাকদ্বীপ বাজারে বসতেন আরতি । দুই সন্তান তখন খুব ছোট । কিন্তু কোন বাড়ি নেই । তাই দোকানের পাশেই শুইয়ে রাখত । দিনে এভাবে কাটলেও রাত্রি কাটত কাকদ্বীপ প্ল্যাটফর্মে ।
এরপর শিয়ালদা থেকে ফল কেনা শুরু করেন আরতি । ছেলে অর্জুন ততদিনে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে । বর্তমানে স্থানীয় জ্ঞানদাময়ী বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে সে । মেয়ে পূর্ণিমা যায় স্থানীয় ICDS সেন্টারে । প্রতিদিন রাত্রি 8টা নাগাদ ট্রেনে দুই সন্তানকে নিয়ে কাকদ্বীপ থেকে শিয়ালদার দিকে রওনা দেন আরতি। ছোট মেয়েটি ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়লেও অর্জুন ট্রেনের কামরাতেই পড়াশুনা করে । একদিকে মা ছোট বোনকে নিয়ে বসে থাকে, অন্যদিকে অর্জুন নিজের মত করে চালিয়ে যায় পড়াশোনা ।
মাসখানেক আগে সোশাল মিডিয়ার দৌলতে রাতারাতি সেলেব্রেটি হয়েছেন রানাঘাট স্টেশনের গায়িকা রানু মণ্ডল । আর সেই সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতেই সম্প্রতি আরতি ও তাঁর সন্তানদের লড়াই নজরে আসে কাকদ্বীপের প্রতাপাদিত্য পঞ্চায়েতের কর্মকর্তাদের । শুরু হয় খোঁজখবর । অবশেষে সেই কিশোরের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে কাকদ্বীপের প্রতাপাদিত্য গ্রাম পঞ্চায়েত । পড়াশোনার পাশাপাশি ওই পরিবারের একটু মাথা গোঁজার ঠাঁইও হয়েছে । এবার থেকে পঞ্চায়েতের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি ঘরে থাকবে ওই পরিবার । মাসে এক হাজার টাকা করে ভাতাও দেওয়া হবে । লড়াই ছাড়বে না অর্জুন ৷ ভবিষ্যতে সেনা বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দিতে চায় সে ।