ডায়মন্ডহারবার, 28 সেপ্টেম্বর: জমিদারি আর নেই । কিন্তু রয়ে গিয়েছে জমিদারদের বৈঠকখানা, ঘরদালান থেকে জমিদারি আমলের লোহার সিন্দুক ৷ আর তার সঙ্গে রয়ে গিয়েছে সে যুগ থেকে চলে আসা দুর্গাপুজো ৷ ডায়মন্ডহারবারের বারদ্রোণ গ্রামের মণ্ডলদের জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো । এ বছর 158তম বর্ষে পা রাখল এই পুজো ৷ মণ্ডল বাড়ির পুজোর বিশেষত হল সপ্তমীর হোমের আগুন নেভে দশমীতে ৷
1866 খ্রিস্টাব্দে জমিদার গোলকচন্দ্র মণ্ডলের জীবদ্দশায় মণ্ডলবাড়িতে শুরু হয় উমার আরাধনা । প্রথম থেকেই মণ্ডল বাড়িতে পূজিত হয়ে আসছে একচালা প্রতিমা । আগে মাটির সাজের দেবী দুর্গার আরাধনা হত । সাতের দশক থেকে প্রতিমার ডাকের সাজ শুরু হয় । রথযাত্রাতে হয় কাঠামো পুজো । ষষ্ঠীর দিন বেলতলায় দেবীর বোধন । পরিবারের কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির রয়েছে দুর্গাদালানের পাশেই । সেই মন্দির থেকে কুলদেবতাকে সিংহাসনে বসিয়ে দুর্গাদালানে দেবী দুর্গার পাশে আনা হয় । পুজোর চারদিন গৃহদেবতারও পুজো হয় । সপ্তমীর হোমের আগুন নেভে দশমীতে । অষ্টমীতে কুমারী পুজোর রীতি রয়েছে । জমিদার আমলে সন্ধিপুজোয় হত গানফায়ার । বর্তমানে তা আর হয় না । আগে রেওয়াজ ছিল পাঁঠাবলিরও । তবে এখনও রীতি মেনে পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ দম্পতি পুজোয় উপবাস করেন ।
তৎকালীন হাজিপুরের (অধুনা ডায়মন্ডহারবার) বারদ্রোণ গ্রামের বাসিন্দা অযোধ্যা রামের পৌত্র গোলকচন্দ্র মণ্ডল । সেই সময় মণ্ডল পরিবার ছিল পুরোমাত্রায় ব্যবসায়ী । ধান, চাল, নুন ও সাবানের ব্যবসায় ক্রমেই ফুলেফেঁপে উঠেছিল পরিবারটি । ব্যবসার মুনাফার টাকায় একের পর এক জমি কিনেছিলেন বংশধরেরা । পাশ্ববর্তী সরবেড়িয়া, ঘটকপুর, বাজারবেড়িয়া, তালডাঙা, লালবাটি, বদরতলা, রামচন্দ্রপুর, কালিনগর, বাহাদুরপুর গ্রামে প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক মণ্ডল পরিবার । শুধু তাই নয়, লাট অঞ্চলের ছয়ের ঘেরি, এগারোর ঘেরি, পিঁপড়েখালি-সহ বহু জায়গায় বিস্তার লাভ করে তাঁদের জমিদারী । সেসময় পালকি চেপে লাট অঞ্চলে জমিদারী দেখাশোনা করতে যেতেন তাঁরা । পুকুরঘাট, কাছারিবাড়ি, বিশাল দুর্গাদালান তো ছিলই, তৈরি হয়েছিল জমিদারের নায়েব, গোমস্তাদের কাজের জন্য একাধিক ঘর ।
আরও পড়ুন: পুজোর থিমে শ্রমজীবী মহিলাদের জীবনকথা, তেলেঙ্গাবাগানের ভাবনায় 'প্রান্তজনের আত্মকথা'
ঘরের পুরু দেওয়ালে ছিল রকমারি সব কারুকাজ । সমগ্র বাড়িতে ছিল 33টি কক্ষ । দারোয়ান, জমিদারের পালকি বাহকদের জন্যও আলাদা ঘরের ব্যবস্থা ছিল । কাছারিবাড়ির মূল প্রবেশপথের উঁচু তোরণের উপরে দু'পাশে মুখোমুখি দুটি সিংহমূর্তি । আর ফটকের ঠিক উপরে সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি । সদর দরজার পূর্বদিকে লম্বা বারান্দা । জমিদারের কাছারিবাড়িতে ঢোকার মূল ফটকের দু'দিকে থাকত গাদা বন্দুকধারী দুই দারোয়ান । জমিদার বাড়িতে টাকাপয়সা ও সোনাদানা রাখার জন্য ছিল বড় বড় চারটি লোহার সিন্দুক । ওই সিন্দুকের পাশে রাখা থাকত কাতান । ডাকাতির সময় যাতে ওই কাতান সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করতে পারা যায় । সে এক রূপকথার গল্প । আজও জমিদার বাড়ির সেসব চিহ্নের কিছু কিছু অবশিষ্ট রয়েছে ।
পরিবারের সদস্য নচিকেতা মণ্ডল বলেন, "এ বছর আমাদের দুর্গাপুজো 158তম বর্ষে পদার্পণ করল । জমিদারি আমলে নবমীতে নরনারায়ণ সেবায় দই-চিঁড়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল । গেঁয়োখালি থেকে হুগলি নদীপথে নৌকায় মণ মণ দই হাঁড়ার ঘাট হয়ে বোলসিদ্ধির খালপথে আসত বারদ্রোণ গ্রামে । বস্তা বস্তা চিঁড়ে তালপুকুরের জলে ভিজিয়ে স্নানের ঘাটে চাটাই বিছিয়ে তাতে রেখে মেশানো হত হাঁড়ির পর হাঁড়ি দই আর চিনি ।"
আজ সেসব ইতিহাস । পরিবারের সদস্যদের অনেকেই এখন কর্মসূত্রে দেশবিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকেন । পুজোর সময় দালানবাড়িতে নিয়ম করে আসতেন সকলেই । কিন্তু করোনার কারণে গত বছর পুজোর চারদিন মণ্ডল বাড়ির সেই মিলনমেলায় পরিবারের সদস্যদের অনেকেই অনুপস্থিত ছিলেন । এ বছর যদিও বাড়ির পুজোয় যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে অনেকেরই । প্রতিবছর পূজো উপলক্ষে মণ্ডল পরিবারের পক্ষ থেকে একটি করে পত্রিকা প্রকাশিত করা হয় । এই পত্রিকার মাধ্যমে গ্রামবাসীদের পুজোর নির্ঘণ্ট ছাড়াও পুজোর ইতিহাস লেখা থাকে ।
আরও পড়ুন: অযোধ্যার জমিদার বাড়ির 'ব্যাঘ্রবাহিনী'র আরাধনা এবার 199 বছরে
পরিবারের অপর সদস্য বিকাশ মণ্ডল জানান, আগে সন্ধিপুজোর সময় তিনি বাড়িতে গানফায়ার দেখেছেন । দেখেছেন পাঁঠাবলিও । কিন্তু পঞ্চাশের দশক থেকে পাঁঠাবলিও বন্ধ হয়েছে । পরিবারের মহিলা সদস্য চিত্রা মণ্ডলের কথায়, অতীতের সেই জৌলুস ফিকে হলেও এখনও প্রাচীন রীতিনীতি মেনে মণ্ডল বাড়ির পুজোর চলে আসছে । পুজোর চারটে দিন পরিবারের মহিলাদের কার্যত ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটে । নৈমিত্তিক থেকে শুরু করে বিজয় দশমী পর্যন্ত চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন তাঁরা । বিজয় দশমীর দিন মায়ের বরণ করার সময় এই পরিবারের মহিলা সদস্যরা কেঁদে ফেলেন ৷ কিন্তু আসছে বছর আবার হবে এই আশায় বুক বেঁধে মাকে বিদায় জানানো হয় । তিনি বলেন, "আমরা পুজোর এই চারটে দিন খুবই আনন্দের সঙ্গে কাটাই ।"