বগটুই, 28 মার্চ : কেটে গেল এক সপ্তাহ ৷ বীরভূমের বগটুইয়ের (Bagtui Massacre) নারকীয় হত্যালীলা তোলপাড় ফেলে দিয়েছে গোটা রাজ্যে ৷ ঘটনার রেশ ছড়িয়েছে জাতীয় ক্ষেত্রেও ৷ উত্তপ্ত রাজনীতির আঙিনা ৷ চলছে দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপ (Rampurhat incident) ৷ একইসঙ্গে চলছে তদন্তও ৷ অভিশপ্ত 21 মার্চের পর থেকে কীভাবে কাটল এই সাতটা দিন, কোনদিকে এগোল তদন্তের গতিপ্রকৃতি, কতটা চড়ল রাজনীতির পারদ, দেখে নেব একনজরে (what happened in seven days after Rampurhat incident)৷
1) 21 মার্চ রাত্রি সাড়ে 8 টা ৷ বগটুই মোড়ে দুটি বাইক চড়ে আসে চার দুষ্কৃতী ৷ বোমা ছুড়ে খুন করে রামপুরহাট 1 নম্বর ব্লকের বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান ভাদু শেখকে ৷ উপ-প্রধান থাকার পাশাপাশি পুলিশের ডাক মাস্টার হিসেবে পরিচিত ছিল ভাদু ৷ অভিযোগ, পুলিশের হয়ে সে টাকা তুলত । দীর্ঘদিন ধরে এই টাকার বখরা নিয়েই গণ্ডগোল বাঁধে অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে ৷ তার জেরেই তাঁকে খুন করা হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে ।
2) এরপরই ঘটে নারকীয় হত্যালীলা ৷ ওই রাতেই ভাদু শেখের অনুগামীরা বগটুই গ্রামে তাণ্ডব চালায় । প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, দেড়শোর বেশি বোমা ছোড়া হয় গ্রামজুড়ে ৷ কমপক্ষে 10টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয় ৷ প্রথমে বাড়ি থেকে বের করে বেধড়ক মারধর করা হয় ৷ পরে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে পেট্রল বোমা ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ৷ নৃশংস ভাবে পুড়িয়ে মারা হয় শিশু ও মহিলাদের ৷ সরকারি ভাবে মৃতের সংখ্যা 8 । যদিও, বেসরকারিভাবে হিসেবটা আরও বেশি ৷ একই বাড়ি থেকে মহিলা-শিশু সহ 7টি দগ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় ৷
3) প্রশ্ন উঠেছে,
- কেন উপ-প্রধান খুনের পর গ্রামে পুলিশ পিকেট বসানো হল না ? কেন পুলিশ মোতায়েন করা হল না ?
- এসডিপিও বাংলো থেকে মাত্র 700 মিটার দূরে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটল, অথচ রাতে গ্রামে পুলিশ বাহিনী গেল না কেন ?
- ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে দমকল কর্মীরা 10টি মৃতদেহ উদ্ধার করেছি বললেও, সাংবাদিক বৈঠক করে রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালব্য 8 জন মৃত কেন বললেন ?
আরও পড়ুন: TMC-BJP MLAs fight : বিধানসভায় তুলকালাম, তৃণমূল-বিজেপি বিধায়কদের হাতাহাতি
4) এই ঘটনা নিয়ে রাজ্যজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে ৷ 22 মার্চ নবান্নে মুখ্যসচিরের তত্ত্বাবধানে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজিরা ৷ এই বৈঠকের পরেই রামপুরহাটের এসডিপিও সায়ন আহমেদ ও আইসিকে ত্রিদিব প্রামাণিককে ক্লোজ করা হয় ৷ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ঘটনাস্থলে যান পরিবহণ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডল ও লাভপুরের বিধায়ক অভিজিৎ সিংহ । ওই দিনই সিট গঠন করে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।
5) বগটুইয়ে নারকীয় হত্যালীলায় দ্রুত রিপোর্ট তলব করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ।
6) নিন্দায় সরব হয় বিজেপি, সিপিআইএম, কংগ্রেস-সহ অন্যান্যরা । ঘটনাস্থলে যান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, বাম নেতা বিমান বসু, লোকসভা বিরোধী দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী । এই ঘটনায় 22 জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ।
8) ঘটনার নৃশংসতা ও সামাজিক প্রতিফলন বিচার করে 23 মার্চ স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের করে কলকাতা হাইকোর্ট ৷ হাইকোর্ট রাজ্যের কাছে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তলব করে ৷
9) 24 মার্চ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে যান বগটুই গ্রামে ৷ নিহতদের পরিজনের সঙ্গে কথা বলে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেন তিনি ৷ পাশাপাশি দলের রামপুরহাট 1 নম্বর ব্লক সভাপতি আনারুল হোসেনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী । তবে গ্রামে এসে নিহতের পরিবারের অনেকের সঙ্গেই তিনি দেখা করেননি বলে অভিযোগ ওঠে ৷ কান্নায় ভেঙে পরে নিহতের পরিবার ৷ অনেকেই বলেন, "ক্ষতিপূরণ নয়, অভিযুক্তদের ফাঁসির সাজা চাই ।" মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারাপীঠ থেকে গ্রেফতার হন তৃণমূল নেতা আনারুল হোসেন । ক্লোজ করার পর সাসপেন্ড করা হয় রামপুরহাটের এসডিপিও ও আইসিকে ।
10) 25 মার্চ হাইকোর্ট মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয় । 7 এপ্রিলের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট হাইকোর্টে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ । তদন্তভার হাতে পেয়েই গ্রামে গিয়ে পোড়া বাড়িগুলি থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন সিবিআইয়ের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা ।
11) 26 মার্চ সিটের কাছ থেকে তদন্ত ভার নেয় সিবিআই অফিসারেরা ৷ রামপুরহাট থানায় গিয়ে নথি সংগ্রহ করে সিবিআই ।
আরও পড়ুন: Soumitra Demands 355 for Bengal : শুভেন্দুদের মারধরের অভিযোগ, লোকসভায় 355-র দাবিতে সরব সৌমিত্র
12) 27 মার্চ রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে আহত শিশু-সহ 4 মহিলার জবানবন্দি রেকর্ড করেন সিবিআই অফিসারেরা । এছাড়া মূল অভিযুক্ত আনারুল হোসেনকে রামপুরহাট থানা থেকে সিবিআইয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ প্রশ্ন উঠেছে,
- দগ্ধ মৃত দেহ ডিএনএ টেস্ট ছাড়া সনাক্ত হল কীভাবে ?
- দেহ সনাক্তের আগেই কীভাবে রাতারাতি কবরস্থ করা হল ?
ঠিক কী ঘটেছিল ওই রাতে ? কার কার মদত ছিল ? জানা গিয়েছে, আনারুল হোসেনের ফোন কল রেকর্ড-সহ অন্যান্য নথি খতিয়ে দেখে তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার তথা রামপুরহাটের বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, লাভপুরের বিধায়ক অভিজিৎ সিংহ, জেলা পুলিশসুপার নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠী, সাসপেন্ড হওয়া রামপুরহাটের এসডিপিও সায়ন আহমেদ, আইসি ত্রিদিব প্রামাণিক-সহ একাধিক তৃণমূল নেতা ও পুলিশ আধিকারিককে জেরা করতে পারেন সিবিআই অফিসারেরা । তদন্তের মোড় কোন দিকে ঘুরবে সেদিকেই তাকিয়ে সকলে ।