বারিকুল, 11 অগাস্ট : জায়গাটা এখনও বাঁধানো ৷ রয়েছে ক্ষুদিরামের আবক্ষ মূর্তি ৷ সেখান থেকে মেরেকেটে 500 মিটার দূরে জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে এক গুহা ৷ এককালে যেখানে অন্য বিপ্লবীদের সঙ্গে পা পড়ত ক্ষুদিরাম বসুর ৷ কিন্তু, ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি সেই কাহিনী ৷ যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন অসংখ্য বিপ্লবী, সেই এলাকাই আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে ৷ পুলিশ-মাওবাদী সংঘর্ষে ঝরেছে রক্ত ৷ কিন্তু, অন্তরালে থেকে গেছে সেখানকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ৷ বরং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অস্তিত্ব সংকটের মুখে সেই গুহাও ৷
বাঁকুড়া জেলার একেবারে দক্ষিণে বারিকুল থানার ছেঁদাপাথর গ্রাম । বাঁকুড়া সদর থেকে দূরত্ব প্রায় 80 কিলোমিটার ৷ পাথুরে অঞ্চল ৷ চারপাশ জঙ্গলে ঘেরা ৷ স্বাধীনতার ইতিহাসে সেভাবে ঠাঁই না পেলেও বাঁকুড়ার এই গ্রামের একটি গুহা কীভাবে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা হয়ে উঠেছিল? উত্তরটা জানতে পিছিয়ে যেতে হবে ঠিক 116 বছর ৷
অবিভক্ত মেদিনীপুরের অন্তর্গত মুগবেড়িয়া ৷ সেখানকার জমিদার ছিলেন দিগম্বর নন্দ বিদ্যানিধি ৷ বরাবরই স্বদেশি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন ৷ 1903 সালে মেদিনীপুরে আসেন ভগিনী নিবেদিতা ৷ দেশের জন্য অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন ৷ কিন্তু, প্রথমে তাঁর অনুরোধ মানা হয়নি ৷ পরে সুযোগ মেলে যোগ দেওয়ার ৷ ইতিমধ্যে 1905 সালে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করেন লর্ড কার্জন ৷ আরও জোরদার হয়ে ওঠে স্বদেশি আন্দোলন ৷ ঘরে ঘরে তখন স্বদেশি ভাবধারার বিস্তার ঘটছে ৷ দেশের জন্য এগিয়ে আসছেন অসংখ্য যুবক ৷ তাঁদের দমন করতে তৎপর ছিল ইংরেজরা ৷ তাঁদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজন গোপন আস্তানা, লোকচক্ষুর আড়ালে নিরাপদ জায়গার ৷ কিন্তু, মেদিনীপুরে ইংরেজ পুলিশের রক্তচক্ষু এড়িয়ে কোথায় বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে? 1906 সালে উপযুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব পান দিগম্বরবাবু ৷ যোগাযোগ করেন পার্শ্ববর্তী জেলা বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের অম্বিকানগরের জমিদার রাইচরণ ধবলদেবের সঙ্গে । রাইচরণবাবুও বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুব্ধ ছিলেন ৷ তাঁর সাহায্যে অম্বিকানগরের কাছে সাদা পাথর জঙ্গলে গুহার মধ্যে গড়ে তোলা হয় প্রশিক্ষণ শিবির ৷ দৈর্ঘ প্রায় আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার ৷ বৈপ্লবিক আন্দোলনের রেশ বাঁকুড়ায় পড়লেও জেলাটি ইংরেজদের বিশেষ নজরে ছিল না ৷ এটাকেই হাতিয়ার করেন বিপ্লবীরা ৷ নিরিবিলি জঙ্গলের মধ্যে পাথরের গুহায় চলত অস্ত্র প্রশিক্ষণ ৷ শেখানো হত বোমা বাঁধার কৌশল ৷ অনুশীলন সমিতির সদস্য হওয়ার সুবাদে আস্তানায় আসতেন ক্ষুদিরাম বসুও ৷ আলোচনা করতেন অন্য বিপ্লবীদের সঙ্গে ৷ 1907 সালের নভেম্বর মাস থেকে 1908 সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই গোপন আস্তানায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ চলেছিল ৷
সেই গুহার বর্তমানে কী অবস্থা তা দেখতে যাওয়া হয় ছেঁদাপাথর গ্রামে ৷ বিপ্লবীরা যেখানে বসে আলোচনা করতেন সেটিকে বাঁধানো হয়েছে ৷ গড়া হয়েছে ক্ষুদিরাম বসুর মূর্তি ৷ সেখান থেকে 500 মিটার দূরেই রয়েছে গুহাটি ৷ তবে, এখন সেটিকে পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৷ স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষুদিরাম মাহাত বলেন, "ক্ষুদিরাম বসু বঙ্গভঙ্গের সময় এখানে আসতেন ৷ আত্মগোপন করতেন ৷ তবে ভিতরে কী রয়েছে তা পরিষ্কার নয় ৷ 10-12 ফুট নিচে পাথর বসানো রয়েছে ৷ সেখানে কোনও কিছু আঘাত করলে আওয়াজ হয় ৷ গুহাটি গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উলফার্নের খনির কাছে উঠেছে ৷" জঙ্গলটি এখন "ক্ষুদিরামের আশ্রয়" হিসেবে পরিচিত ৷ ছেঁদাপাথর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক মানস মুখার্জি বলেন, "স্কুলে এসে শুনেছিলাম, এখানে ক্ষুদিরাম বসু আসতেন ৷ গুহার মধ্যে বিভিন্নরকম বৈপ্লবিক কাজ চলত ৷"
বাঁকুড়ার জেলাশাসক ডাঃ উমাশঙ্কর এস বলেন, "এলাকাটিকে জনপ্রিয় বানানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি ৷ স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরার জন্য এলাকাটিকে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব আমরা রাজ্য সরকারকে দেব ৷" তিনি আরও জানান, ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম ও বলিদান দিবস স্মরণ করে প্রতি বছর বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয় ৷ কিন্তু, তা সীমিত রয়েছে এলাকাবাসীদের মধ্যে ৷ ছড়িয়ে পড়েনি রাজ্যের অন্য প্রান্তে ৷ ঠাঁই পায়নি ইতিহাস বইয়ের পাতাতেও ৷ তাই স্বদেশি আন্দোলনের সাক্ষ্য বহন করা এই গ্রামকে (বিশেষত বারিকুল থানা) আজ মানুষ জানে মাওবাদী আর যৌথবাহিনীর সংঘাতের কারণে ৷ সত্যিই, বিচিত্র এক দেশ !